মির্জা আসাদুল্লা খান গালিব তথা মির্জা নৌশা, ৮ রজব, ১২১২ হিজরি তথা ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে আগরায় জন্মগ্রহণ করেন। ছোটোবেলা থেকেই গালিব খুব আত্মমগ্ন ছিলেন, সারা দিন টো টো করে ঘোরা, ঘুড়ি-পায়রা ওড়ানো – এই সবে মত্ত থাকতেন। ফারসি শিখেছিলেন ইরানী যাত্রী আবদুস সামাদের কাছ থেকে। ১৮১৩ সালে গালিব স্থায়ী ভাবে দিল্লি চলে আসেন।

গালিব শুধু একজন কবি নন, ছিলেন একটি যুগ ও নতুন সভ্যতার যুগ। মুঘলরা ভারতকে তিনটি জিনিস দিয়েছিল – তাজমহল, উর্দু ও গালিব। এই তিনটি একই সভ্যতার একত্বের বিভিন্ন দর্শনীয় রূপ। তাজমহলের পাথর ও ইটকে যদি শব্দে ও বর্ণনায় মিশ্রণ করা যায়, তা হলে সেটা গালিবের শায়েরি ছাড়া আর কিছু নয়।

মীর যেমন অষ্টাদশ শতাব্দীর উর্দু কাব্যকে উজ্জ্বল করে রেখেছিলেন তেমনই গালিব ঊনবিংশ শতাব্দীর উর্দু কাব্যকে করেছিলেন উজ্জ্বল।

১৮২৭ সাল। গালিবের জীবনে ঘটে গিয়েছে অনেক দুর্ঘটনা। তাঁর সাতটি সন্তানই জন্মের এক বছরের মধ্যেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছে। গালিব এখন ধারেদেনায়, দুঃখের ভারে জর্জরিত। তাঁকে মাসিক পেনশন দিতেন ঝিরকার (বর্তমান হরিয়ানা রাজ্যের নূহ জেলা) নবাব আহমদ বখস খান। ১৮২৬ সালে তিনি নবাবি ছেড়ে দেন। ইংরেজ প্রতিনিধিদের মধ্যস্থতায় ঠিক হয়, ঝিরকার নবাব আহমদ বখসের বড়ো ছেলে শামসুদ্দিন পাবেন ফিরোজপুর ঝিরকার আয় আর শামসুদ্দিনের বৈমাত্রেয় ছোটো দুই ভাই আমিনুদ্দিন ও জিয়াউদ্দিন পাবেন লোহারু জায়গিরের আয়। ব্রিটিশরাই গালিবের জন্য ধার্য করে দিয়েছিলেন পেনশন, টাকা আসত নবাব আহমদ বখস খানের রাজকোষ থেকে। আহমদ বখস খান ফিরোজপুর ঝিরকার নবাবি পেয়েছিলেন ইংরেজদের দয়াতেই। গালিব ছিলেন আমিনুদ্দিনের ঘনিষ্ট বন্ধু। বৈমাত্রেয় ভাইদের সঙ্গে খারাপ সম্পর্কের জেরে শামসুদ্দিন তাঁর পেনশন প্রথমে অনিয়মিত করে দেন, পরে একেবারেই বন্ধ করে দেন।

মির্জা গালিব

গালিব পড়লেন অথৈ জলে। চিরকালই তাঁর ছিল আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত তিনি, পেনশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁর হয়েছিল দুর্দশার অবস্থা। গালিব ঠিক করলেন কলকাতা যাবেন, ব্রিটিশদের আদালতে বিচার চাইবেন। ১৮২৭ সাল। তিনি দিল্লি থেকে রওনা দিলেন কলকাতার অভিমুখে – লোহারু, ফিরোজপুর, ঝিরকা, ভরতপুর, কানপুর হয়ে এসে পৌঁছোলেন লখনউ। লখনউ ছিল তাঁর প্রিয় ও পরিচিত শহর।

গালিবের পিতা ওয়ালিদ আবদুল্লা বেগ খান নবাব আসাফুদ্দৌল্লার অধীনে কাজ করতেন। যদিও কলকাতার যাত্রাপথে লখনউ পড়ে না, তা-ও গালিব স্থির করলেন কিছু দিন লখনউ শহরে কাটিয়ে যাবেন। তাঁর মনে ক্ষীণ আশা ছিল হয়তো নবাবের দরবারে পৌঁছোতে পারলে তাঁর ভাগ্যেও জুটে যেতে পারে নবাবদের আনুকূল্য।

তখন ছিল নবাব গাজীউদ্দিন হায়দরের শাসনকাল। গালিব দ্বারস্থ হলেন নবাব গাজীউদ্দিন হায়দরের মন্ত্রীর সচিব বা সহকারী সুভান আলী খানের কাছে। গালিব দু’টি শর্ত দিয়েছিলেন – এক, প্রথাগত মর্যাদায় তাঁকে অভ্যর্থনা দিতে হবে, দুই, তাঁর নজরানা মাফ করতে হবে। সচিব সুভান আলী খান রাজি হলেন না গালিবের শর্তে, এমনকি গালিবের আগমন-সংবাদও জানালেন না নবাবকে। দরবারি আনুকূল্য, নিদেনপক্ষে রাহাখরচ পাওয়ার আশাও সফল হল না গালিবের।

মির্জা গালিবের সমাধি, নিজামুদ্দিন বস্তি, দিল্লী

লখনউ দরবার হারাল উর্দুর মহানতম কবিকে। লখনউ সুযোগ পেল না তাঁর গজল-বাগানের ফুলের স্বাদ নিতে, লখনউর শান ও শৌকতে গালিবকে আর পাওয়া যায়নি। অথচ লখনউয়ের শ্রেষ্ট উর্দু কবি বৃদ্ধ মীর তকী মীর গালিবের গজল দেখে বলেছিলেন, “অগর ইস লড়কে কো কোই কামিল উস্তাদ মিল গয়া অওর উসনে ইসে সিধে রাস্তে পর ডাল দিয়া তো লা-জবাব শায়র বনেগা”। গালিব কিন্তু তখন গালিব হয়ে ওঠেননি, তিনি অসদ ছদ্মনামেই লিখতেন। পরে তিনি তার তখল্লুস বা ছদ্মনাম পালটে করেছিলেন গালিব, অর্থ বিজয়ী।

লখনউর মুশায়রায় যথেষ্ট সমাদর না পেয়ে, কিছুকাল কাটিয়ে গালিব লখনউ ত্যাগ করেছিলেন, রচনা করেছিলেন –

লখনউ আনে কা বায়স নহী খুলতা, য়ানী

হবস-এ সৈর ব তামাশা, সুদহ কম হ্যায় হম কো।

মুকতহ-এ সিলসিলা শৌক নহী হ্যায় য়ে শহর

অজম-এ সৈর-এ নজফ ব তৌফ এ হরম হ্যায় হম কো।

লখনউ আসা আমার ব্যর্থ হল

সফর ও তামশা দেখার বাসনাও ঘুচল না।

কাব্যমালার শখ নেই এ শহরের

আমার উদ্দেশ্যও সফল হল না।

কলকাতা সফরের সময় লখনউর নবাব নাসিরুদ্দিন হায়দরকে (১৮২৭-৩৭) উদ্দেশ করে গালিব প্রচলিত ধারায় একটি কসীদা লিখেছিলেন,

বিশ্বাসের শপথ আমার, তুষিনি কোনো রাজাকে কখনো

কবির আত্মগর্ব সদা বাধা দিয়েছে আমায়।

তবু আমিও কবি, দান করি কাব্য

লজ্জা নেই দানশীলের কাছে প্রত্যাশায়

অর্থের প্রয়োজনে জর্জরিত গালিব কবিতাটি লখনউ দরবারে লিখে পাঠিয়েছিলেন তাঁর বন্ধু মুনশি মহম্মদ হাসানের হাত দিয়ে। বহু দিন পরে গালিব তাঁর পরিচিত মুজফরউদ্দৌল্লার কাছ থেকে খবর পান, নবাব নাসিরুদ্দিন হায়দর কবিতাটির জন্য গালিবকে পাঁচ হাজার টাকা ইনাম দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। নিরুপায় গালিব লখনউয়ে তাঁর বন্ধু কবি ইমাম বকস নাসিখকে চিঠি লিখলেন। ইমাম বকস নাসিখ তখন লখনউর নামজাদা উর্দু কবি, গালিবের বন্ধু, উর্দু সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র। নাসিখ প্রত্যুত্তরে জানিয়েছিলেন, নবাবের দেওয়া পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে নবাবের মন্ত্রী রৌশনউদ্দৌল্লা তিন হাজার টাকা নিয়ে নিয়েছেন, কারণ গালিবের লেখা কসীদাটি তিনিই নবাবের কাছে পেশ করেছেন, সুতরাং তাঁর তো কিছু প্রাপ্য হওয়াই উচিত। বাকি দু’ হাজার টাকা গালিবের জন্য রাখা আছে। তিনি যেন তা তাঁর বন্ধু মুনশি মহম্মদ হাসানের কাছ থেকে সংগ্রহ করে নেন। নাসিখ গালিবকে পরামর্শ দিলেন তিনি যেন নবাবকে তার টাকা না পাওয়ার ঘটনাটা অবশ্যই জানান। জানিয়েছিলেন গালিব, চিঠি লিখেছিলেন নবাব নাসিরুদ্দিন হায়দরকে, কিন্তু চিঠি নবাবের কাছে পৌঁছোনোর পূর্বেই নবাব নাসিরুদ্দিন হায়দর ইহলোক ত্যাগ করেন। জানা যায় না লখনউ দরবার থেকে গালিব তাঁর প্রাপ্য ওই দু’ হাজার টাকা পেয়েছিলেন কিনা। তিনি লিখেছিলেন,

‘মনহসর মরনে পে হো জীস্-কী উম্মীদ

না উম্মীদী উসকী দেখা চাহিয়ে’।

‘মৃত্যুর আশায় যে বেঁচে রয়েছে

তার হতাশা দেখবার মতন’।

গালিবের হাভেলি

তখন মুঘল-মারাঠা-ইংরেজ, এই ত্রয়ীর মধ্যে রাজনৈতিক স্থিতিস্থাপকতার জন্য জীবনপণ যুদ্ধবিগ্রহ। এক দিকে মুঘল সাম্রাজ্যের ভেঙে পড়ার আওয়াজ, অন্য দিকে নতুন ইংরেজ সভ্যতার পদধ্বনি।

১৮৪৭ সালে মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহের রাজসভায় তাঁর চাকরি মেলে। ফারসি ছেড়ে উর্দুতে কবিতা লিখতে শুরু করেন। মাসিক ৫০ টাকার চাকরি পাকা হয়।

রুমী, খৈয়াম, হাফিজের কয়েক শতাব্দী পর মীর, মোমিন, গালিবের আবির্ভাব।

ইতিমধ্যে সুরাপাত্র, প্রেমের পাত্র ও প্রেমের মজলিসের চেহারা পালটে গিয়েছে। প্রেমের ও মজলিসের ভাবনায় এসে গিয়েছিল নান্দনিক গুণ।

নবাব ওয়াজিদ আলী শাহও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাই তো নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ তাঁকে ১৮৫৪ সালে প্রশংসাবাবদ বছরে ৫০০ টাকা দিতেন। গালিব ভবিষ্যতের জন্য লিখতেন কবিতা, লিখেছিলেন,

‘নহ গিলে নগমা হুঁ নহ পরদেশাজ

ম্যায় হু অপনী শিকস্ত কী আওয়াজ’

হয়তো বা রুমি দরওয়াজার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন..

‘সুরের পর্দা নই কিছুতেই, নই তো গীতের সার

আমি শুধু শব্দ – নিজের ভেঙে যাবার’।

১৮৫৬ সালে অযোধ্যা অধিগ্রহণ করল ইংরেজরা। গালিবের ভালোবাসার লখনউ, লখনউর উপর অভিমান করে থাকা গালিব লিখেছিলেন,

‘লখ্-নউ হম্ পর ফিদা হ্যায়

হম্ হ্যায় ফিদায়ে লখ্-নউ’।

‘লখনউ আমার জন্য পাগল

আমিও পাগল লখনউর জন্য’।

প্রথম পর্বের লিঙ্ক