‘হাম্মাম’ আরবি শব্দ। ‘হাম্মাম’ থেকে ‘হাম্মামখানা’ শব্দটি এসেছে, যার অর্থ ‘স্নানাগার’ অর্থাৎ ‘গোসলখানা’। তবে সর্বসাধারণের নয়, রাজকীয় গোসলখানা। হাম্মামখানা আদতে সুইমিং পুলের মতো একটি চৌবাচ্চা। মাটি থেকে কিছুটা উঁচুতে তৈরি করা হত। পোড়ামাটির নল দিয়ে গরম ও ঠান্ডা জল চৌবাচ্চায় সরবরাহের ব্যবস্থা থাকত। হাম্মামখানার পাশেই থাকত পোশাক পালটানোর ঘর, থাকত বিশ্রামকক্ষ, আরও অনেক কক্ষ। এ ভাবেই হাম্মাম হয়ে উঠেছিল একটি জটিল স্থাপত্য।

তবে মুঘল আমলে ‘হাম্মামখানা’ শুধু গোসলখানাই ছিল না, সম্রাটের বিশেষ সভাকক্ষ হিসাবেও ব্যবহৃত হত। গোপন বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন হলে সম্রাট তা আম-খাসের বদলে হাম্মামখানাতে করতেন। এখানে প্রবেশ ছিল সংরক্ষিত। অল্প আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠার জন্য হাম্মামখানায় মসৃণ টাইলস ব্যাপক ব্যবহার করা হত, প্রয়োজনে আলো-আঁধারির ব্যবস্থাও ছিল।

তা সেই ‘হাম্মামখানা’ দেখতে চলে এলাম বুরহানপুরে।

তাপ্তি নদীর পশ্চিম পাড়ে ফারুকি সাম্রাজ্যের আমলে তৈরি সাততলা ‘শাহি কেল্লা’। ফারুকি সুলতান দ্বিতীয় আদিল খান (১৪৫৭-১৫০৩ খ্রিস্টাব্দ) এই কেল্লা তৈরি করেন। কেল্লায় প্রবেশের আটটি গেট ছিল, চার পাশ ঘিরে ছিল অভিজাত ও বণিকদের বাড়ি, সামনেই ছিল এক চক।

১৬০১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের আমলে সমগ্র বুরহানপুর মুঘল আধিপত্য স্বীকার করে নিলে মুঘলসম্রাট ও শাহজাদাদের আবাসস্থল হয়ে ওঠে শাহি কেল্লা। সম্রাট শাহজাহানের বড়ো প্রিয় ছিল এই কেল্লা। জীবনের সুখ-দুঃখের অনেকটা সময় তিনি এখানে অতিবাহিত করেছিলেন। ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে বুরহানপুরেই তাঁর প্রথম কন্যা সন্তান, রওশনআরার জন্ম হয়, তখন তিনি যুবরাজ খুররম! তাঁর আমল থেকেই বুরহানপুর তৎকালীন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর হয়ে উঠতে থাকে, তাঁর আমলেই ‘শাহি কেল্লায়’ গড়ে ওঠে সম্রাজ্ঞী মমতাজমহলের জন্য হাম্মাম।

শাহি হাম্মামের সিলিং-এ কারুকাজ

সেই শাহি কেল্লার বেশিটাই আজ ধ্বংস, কিন্তু সম্রাজ্ঞী মমতাজ ব্যবহৃত ‘হাম্মাম’ বা রাজকীয় স্নানাগার ও তাঁর দেওয়াল ও ছাদের কারুকার্য আজও প্রমাণ করে চলেছে ফেলে আসা ইতিহাসের বৈভব। মুঘল ও পারস্য স্থাপত্যরীতির এক অনবদ্য নিদর্শন শাহি কেল্লা বা বাদশাহি কেল্লার ‘জেনানা হাম্মাম’। এখানকার ছাদের ফ্রেস্কো, পরচিনকারী শিল্প ও মোটিফের কারুকার্য ও আর তার সঙ্গে রঙের ব্যবহার, যেন পাথর ও রঙের বন্দিশ! শৌখিন সম্রাট শাহজাহান তাঁর বেগম মমতাজের জন্য গড়ে তোলেন এই বাদশাহী হাম্মাম, বাদশাহী আমেজ ও মেজাজের এক চরম কোলাজ!

হাম্মামের বাইরে বড়ো পাত্রে জল গরম করা হত, নালির মধ্যে দিয়ে আসত সেই গরম জল আর অন্য নালি দিয়ে আসত ঠান্ডা জল। হাম্মামের জলে গোলাপের পাপড়ি ও সুগন্ধী মেশানো থাকত, শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট থাকত আর একটি গোলাপের পাপড়ি আকারের হাম্মাম। সারা হাম্মাম জুড়ে জ্বলত শুধুই প্রদীপ। শিখার আলো ছাদের সিলিংয়ের কারুকার্যে প্রতিফলিত হয়ে সৃষ্টি হত স্বর্গের আলোকবর্তিকা। দেওয়ালে ও ছাদে লাগানো থাকত হিরে। আলোর দুত্যি ছড়িয়ে পড়ত সারা হাম্মামে, সৃষ্টি হত অনন্ত জীবনের হাসনুহানা-দিন।

মর্মর সৃষ্টির এই ফোটাঝরার কাব্য, বিরহী ভাবনার এক মুক্ত প্রকাশ, যা তাজমহলেও অনুভূত হয়। মার্বেলের মেঝে, মাঝখানে ফোয়ারা, মাথার ওপরে গম্বুজে মৌচাকের নকশা ফিকে হয়ে গেলেও রঙ মুছে যায়নি এখনও। দেওয়ালের পাথরে মাছের আঁশের নকশা খোদাই করা, তার ওপর জল পড়লে মনে হয় মাছ সাঁতার কাটছে। দেওয়াল বেয়ে নেমে আসত ঝরনার মতো ঠান্ডা ও গরম জল, হাম্মামের মধ্যবর্তী পুলটির গভীরতা এক দশমিক আট মিটার। এখানেই মমতাজমহল নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন পরিচারিকাদের সঙ্গে জলকেলিতে। তাই তো অনেকে বলে ‘শাহি হাম্মাম’।

মুঘল স্থাপত্যভাবনায় হাম্মামখানা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। তাঁদের সময়ে ‘আবদারখানা’ বলে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ ছিল। তাদের কাজই ছিল খাবারের জল বা গোসলের জলকে ঠান্ডা করা বা গরম করা, জলের সুস্থ সরবরাহের দ্বায়িত্বও ছিল তাদের।

১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে পেশায় চিকিৎসক ও দার্শনিক ফরাসি পর্যটক বের্নিয়ে ভারতে এসেছিলেন। তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে মুঘল সম্রাটদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, দরবারের জাঁকজমক বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি লিখেছিলেন, “হাম্মামখানার আয়তন আম-খাসের মতো বিশাল নয়, তবে ঘরটি বেশ বড়ো, হলরুমের মতন এবং চমৎকার ভাবে রঙিন চিত্র ও নকশায় সুশোভিত, দেখতে অতি সুন্দর ও মনোরম। চার-পাঁচ ফুট উঁচু ভিতের ওপর তৈরি বড়ো প্লাটফর্মের মতন।”

শাহি হাম্মামের কারুকাজ

শাহজাহান সম্রাট হওয়ার মাত্র তিন বছরের মধ্যে ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে বুরহানপুরের শাহি কেল্লাতেই চতুর্দশ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু হয় বেগম মমতাজমহলের। মমতাজমহলের দেহ তাজমহলে শায়িত করার পূর্বে বুরহানপুরের ‘আহুখানা’তে ছ’ মাস শায়িত ছিল! সেই ‘আহুখানা’রও আজ ভগ্নদশা।

১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে বুরহানপুর থেকে তাঁর দেহ কফিন বাক্সে নিয়ে আসা হয় আগ্রায়, শায়িত করা হয় অসমাপ্ত তাজমহলে, যা সম্পূর্ণ হয়েছিল ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে।

হাম্মামটি সম্প্রতি সংস্কার করা হয়েছিল।

সারা হাম্মাম জুড়ে পরচিনকারী শিল্পের (মূল্যবান বা দুর্লভ পাথর মার্বেলের ওপর বিভিন্ন অবয়ব বা নকসা ফুটিয়ে তোলার শিল্পকে ভারতীয় ভাষায় বলা হয় ‘পরচিনকারী’ আর যাঁরা এই কাজ করেন তাঁদের বলা হয় ‘পরচীনকার’) নমুনা তাজমহলেও দৃশ্যমান। হয়তো সেই কারণেই স্থানীয় গাইডরা বলেন, তাজমহলের গর্ভধারিনী বুরহানপুরের এই হাম্মাম! যদিও এই তথ্য ইতিহাস-সমর্থিত নয়, তবুও বুরহানপুরের শাহি কেল্লার পরচিনকারী শিল্পের সঙ্গে তাজমহলের গায়ে অংকিত পরচিনকারদের শিল্পকর্মের সাদৃশ্যের দাবিটিকে ফুৎকারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না!

বুরহানপুরের শাহি কেল্লার জেনানা হাম্মাম আগামী পর্যটকদের কাছে জিজ্ঞাসার রসদ হয়ে তোলা থাক না!