স্বপ্নের রাজকীয় জীবন পাওয়ার জন্য মানুষ কতো কিছুই না করে থাকে। রাজকন্যা কিংবা রাজরাণী হওয়া তো অনেকের কাছেই স্বপ্ন। তবে আঠারো-উনিশ শতাব্দী, যেখানে মধ্যযুগের ছোঁয়া লেগে আছে, সে সময় একমাত্র তাদেরই ছিলো সৌভাগ্য আর মর্যাদা। উনিশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের আলমন্ডসবেরী গ্রামে এমন একজন মহিলা আসেন। তিনি কোথা থেকে এসেছেন তা জানা যায় নি। কিন্তু অদ্ভূত আচরণ করতেন তিনি। এক অদ্ভূত ভাষায় কথা বলতেন, যে ভাষা কেউ বুঝতো না। তার পরনে ছিলো নোংরা কাপড়। প্রথমে ভিনদেশী অথবা ভিখারিণী ভেবেছিলো লোকে। পরে একজন দোভাষীর সাহায্য নেয়া হয়। দোভাষী বলেন, তিনি নাকি রাজকুমারী, দীর্ঘ পথ পার করে নাকি এই গ্রামে এসেছেন তিনি। এটা শুনে গ্রামের মানুষ তার প্রতি আরও কৌতুহলী হয়ে পড়ে। সেই সময় ইংল্যান্ডের সাথে ফ্রান্সের যুদ্ধ চলছিলো। তাই গ্রামের অধিকর্তা প্রথমে তাকে ভালোভাবে জরীপ করলেন। অধিকর্তা তাকে নিয়ে স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যান। ম্যাজিস্ট্রেট মহিলাটিকে প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট একজন চাকর ডেকে আনলেন, যিনি নানা দেশের ভাষা জানতেন। তবে সে-ও বুঝলো না মহিলা কোন ভাষায় কথা বলছেন।

প্রিন্সেস কারাবু। এডওয়ার্ড বার্ডের আঁকা, ১৮১৭

মূলত ইশারার মাধ্যমেই কথা বলছিলেন মহিলাটি। তার পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইলে পুঁটলি থেকে তিনি কিছু পয়সা বের করে দেন। ম্যাজিস্ট্রেট ওয়ারেল তাকে নিয়ে সন্দিহান থাকলেও তার স্ত্রী মহিলাটিকে নিয়ে বেশ উৎসুক ছিলেন। মহিলাটিকে কাছের সরাইখানায় পাঠানো হলো, সেখানেও তার আচরণে সবাই আশ্চর্য হয়ে যায়। মহিলাটি হঠাৎ খাটে না শুয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েন। পরদিন মহিলাটি আবার নোল হাউজে গেলে হাত নাচিয়ে নিজের নাম বলেন কারাবু। মিস্টার ওয়ারেলের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে। তিনি মহিলাটিকে ভিখারিণী ভেবে জালিয়াতির অপরাধে ভবঘুরেদের সাথে রাখার আদেশ দেন। ধীরে ধীরে গ্রামে-শহরে এই রহস্যময়ী মহিলাটিকে নিয়ে খবর ছড়িয়ে পড়লে ম্যাজিস্ট্রেট আবারও মহিলাটিকে তার অফিসে ফিরিয়ে আনেন। বহু মানুষ চেষ্টা করে মহিলাটির পরিচয় জানার, কিন্তু ব্যর্থ হয়। অবশেষে এই রহস্যময়ী মহিলার কথা শুনে ম্যানুয়েল এয়েনেসো নামের এক পর্তুগীজ নাবিক ওয়ারেল অফিসে আসেন। পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরে ব্রিস্টল বন্দরে পৌঁছান তিনি। মহিলার সাথে অল্প কিছুক্ষণ কথা বলেই তিনি জানালেন, মহিলাটি সুমাত্রার ভাষায় কথা বলছেন। তিনি আরো জানান, মহিলাটি জাভাসু দ্বীপের রাজকুমারী। সমুদ্রের ডাকাতেরা তাকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছিলো, সেই সময় ব্রিস্টলের কাছে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে আসেন তিনি। এরপর নানা জায়গা পাড়ি দিয়ে আলমন্ডসবেরী গ্রামে এসে পৌছান। সব জানার পর মিস্টার ও মিসেস ওয়ারেল খুবই খুশি হন। কারাবুর মতো একজন রাজকুমারী তাদের নোল হাউজে ছিলেন, এটা তাদের জন্য গৌরবের ব্যাপার ছিলো। পরবর্তী প্রায় তিন মাস কারাবুর সম্মানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু আলমন্ডসবেরীবাসীদের জন্য আরো একটি বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো।

বেকার জাভসুর লেখা

কারাবুর ঘটনাটি ব্রিস্টল জার্নালে একটি প্রবন্ধ আকারে প্রকাশ করা হয়। এই প্রবন্ধটি মিসেস নেইল দেখেন, তিনি লোকজন এর থাকার জন্য বোর্ডিং হাউজ ভাড়া দিতেন। তিনি কারাবুকে চিনে ফেললেন। তবে তার পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি জানালেন, কারাবু কোন রাজকুমারী নন, বরং তার বোর্ডিং হাউজের প্রাক্তন ভাড়াটে মেরী বেকার!! তিনি এ-ও দাবি করলেন, মেরী বেকার আসলে ব্রিস্টল থেকে ৭০ মাইল দূরে অবস্থিত একটি গ্রামে বসবাসরত মেরী উইদরিজ নামের এক মুচির মেয়ে। মিসেস নেইল দাবি করেন, রাজকুমারী কারাবুর কাহিনী পুরোটাই বানোয়াট। এই দাবি লোক মুখে মিসেস ওয়ারেলের কাছে পৌঁছায়। প্রথমে মানতে না চাইলেও মিসেস ওয়ারেল ঠিক করেন তিনি একবার ব্রিস্টলে গিয়ে খোঁজ নেবেন। কারাবুর একটা প্রতিকৃতি নিয়ে নেইল এর সাথে দেখা করেন তিনি। ওনার সাথে কথা বলে তিনি আরও স্পষ্ট হলেন যে, কারাবু আসলেই মেরী বেকার। এরপর তিনি মেরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে রাজকুমারী কারাবুর গল্পের পেছনের কাহিনী ফুটে ওঠে। মেরীর জন্ম ১৭৯৩ সালে ডেভন গ্রামে। মা-বাবার সাথে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান তিনি। এরপর দক্ষিণ ইংল্যান্ডের অনেক জায়গায় জীবিকার জন্য কাজ খুঁজতে থাকেন, কাজ না পাওয়াতে বাধ্য হয়ে ভিক্ষা শুরু করেন। এই সময় মেরী খেয়াল করেন, সাধারণ ভিখারীর তুলনায় বিদেশিনী ভিখারী বেশি ভিক্ষা পায়। মিসেস নেইলের কাছে ভাড়া থাকার সময় মেরী বাচ্চাদের সাথে খেলার ছলে এই অদ্ভূত ভাষা তৈরী করেন, সেই সাথে রাজকুমারী কারাবুর চরিত্রও দাঁড় করান। মেরীর এই গল্প প্রকাশ পেলে খবরের কাগজের লোকেরা খবরটা এভাবে প্রকাশ করে যে, লেখাপড়া না জানা গরীব ঘরের মেয়ে কিভাবে নিজের বুদ্ধি দিয়ে শ্রমিক-শ্রেণীর মেয়ে হয়েও অভিজাতদের ভেতরে ঢুকে তাদের বোকা বানিয়ে ছেড়েছে, তার সাথে তাদের মিথ্যে দর্পও ভেঙে দিয়েছে। এমনকি মিসেস ওয়ারেলও মেরীর প্রশংসা করেন।

যদিও তিনিও প্রথম দিকে ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। তবে পরে তিনি তার প্রতি সহানুভূতিশীল হন। মিসেস ওয়ারেল নিজে দায়িত্ব নিয়ে মেরীকে ১৮১৭ সালে ফিলাডেলফিয়াতে পাঠান, যেনো মেরী নতুন করে নিজের জীবন শুরু করতে পারেন। আমেরিকায় মেরী নিজ দক্ষতায় রাজকুমারী চরিত্রটি মঞ্চস্থ করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। কয়েক বছর পর ইংল্যান্ডে ফিরে এসে এই চরিত্রটি মঞ্চস্থ করলেও তখন পরিচিতি তেমন পান না। কারণ সময়ের সাথে সাথে ইংল্যান্ডের মানুষে ‘জন মেরী’ চরিত্রটি প্রায় ভুলে গেছে। ১৮২০ সালের পর মেরী ব্রিস্টলে থাকা শুরু করেন। ব্যবসায়িক দিক দিয়ে তিনি লাভবান হতে পারেন নি। শেষে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে জোঁক বিক্রি করতে থাকেন জীবনের বাকি ৩০ বছর। মেরী ১৮৬৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। আর তার সাথেই মৃত্যু হয় পর্দার বাইরে সৃষ্ট ‘রাজকুমারী কারাবু’ চরিত্রের শেষ চিহ্নটুকুও।