মাস্টারদাকে ব্রিটিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়া বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেনের স্ত্রীর অনন্যসাধারণ কাহিনী
“দশ হাজার টাকা! বলি, দশ হাজার মানে কত টাকা কল্পনা করতে পারো? মেয়েমানুষের বুদ্ধি, তাই চোখের ওপর এতবড় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে দিচ্ছিলে,” জলের গ্লাসটা পাতের পাশে নামিয়ে রাখেন গৈরালার নেত্র সেন। ‘মেয়েমানুষ’-টি উত্তর দেন না, হ্যারিকেনটা একটু উসকে দিয়ে আবার নীরবে পাখার বাতাস করতে থাকেন।
সোনামুগের ডালের বাটি ভাতের উপর উপুড় করে ব্যঙ্গের স্বরে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেন নেত্র, “বলি বাড়িশুদ্ধু সকলেরই কি মগজধোলাই করে দিয়েছে ওই মাস্টার? আবার দুবেলা রেঁধে খাওয়ানো হচ্ছিল! ব্রজেনটা তো সহমরণে গেল, বলি লাভের লাভ হল কিছু?”
“পুরস্কার মিলেছে?”
আত্মগর্বে মশগুল নেত্র সেন ঘরে কখন একটি ছায়ামূর্তির প্রবেশ ঘটেছে লক্ষ্য করেননি, আচমকা স্ত্রীর হাত থেকে পাখাটা খসে পড়ায় পিছু ফেরেন।
“দশ হাজার টাকা। মিলেছে?” আগন্তুকের শীতল কণ্ঠস্বরে হতচকিত হয়ে বাক্য সরে না তাঁর।
“ইংরেজ সরকারের পুরস্কার আসতে দেরি হয়, না? স্বাধীন চট্টগ্রাম সরকার এখনই তোমায় পুরস্কৃত করতে চান!”
আগন্তুকের হাতের কাটারিটা হ্যারিকেনের আলোয় ঝলসে ওঠে। পরমুহূর্তেই ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাতের থালার উপর লুটিয়ে পড়ে নেত্র সেনের মাথাটা।
পরদিন সদ্যবিধবাকে পুলিশি জেরায় প্রশ্নোত্তর চলে।
– আপনি তখন সামনে ছিলেন? কী দেখেছেন?
– সমস্তটাই দেখেছি সাহেব। ভাত খেতে বসেছিলেন, এমন সময় একজন ঘরে ঢুকে দা-এর এক কোপে…
– চিনতে পেরেছিলেন তাকে? এখানের কেউ? ছেলে না মেয়ে? আজকালকার ব্যাপার, বলাও যায় না…
– জানি। কিন্তু বলতে পারব না।
বিস্মিত অফিসার প্রশ্ন করেন, “বলতে পারব না” মানে!
“যে এসেছিল, তাকে দেখেছি। চিনেছি। কিন্তু বলব না। আমার স্বামী পাপ করেছিলেন। চট্টগ্রামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত পুরস্কার একটাই। আমাকে আমার প্রায়শ্চিত্তটুকু করতে দিন।”
গলার স্বরে, বলার ভঙ্গিতে স্পষ্ট আনুগত্য। যে আগুন নেভালেও নেভে না, সেই চট্টলসূর্যের প্রতি আনুগত্য। অফিসার আর কোনও প্রশ্ন করতে ভরসা পান না, বিনা অভিবাদনেই পিছু ফেরেন।
হত্যাকারী কিরণ সেনের নাম পুলিশ কোনোদিনই জানতে পারেনি।
“Ideal and unity is my farewell message. The rope is dangling over my head. Death is knocking at my door. My mind is soaring towards eternity.”
সেনবাড়ির সকলে উচ্ছ্বসিত। বারমুখো ছেলেটার আপত্তিতে কান না দিয়েই বিয়েটা দিয়ে দেওয়া হল। কানুনগো পাড়ার নগেন দত্তের মেয়ে পুষ্পের রূপেগুণে ঘর আলো হবে, থিতু হবে ছেলেটা।
আত্মীয়দের হয়তো জানা ছিল না, ছেলেটির দুর্জয় জেদের কথা। ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা তার, ব্রহ্মচর্যের।
পুষ্পকুন্তলা অনুরোধ করলেন, স্বামীর কর্মসহচরী হওয়ার। দেশের কাজের যে নেশায় তখন মেতেছেন পঁচিশ বছরের যুবকটি, সেই কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার অনুরোধ করলেন। কিন্তু একরোখা তরুণটি সেই সূত্রেও তাঁকে সহধর্মিণী হওয়ার অধিকার দিল না। দেশের প্রতি কর্তব্য তাকে সর্বত্যাগী হওয়ার বাসনায় এতটাই পাগল করেছিল, ডাইনে-বাঁয়ে না চেয়ে, পরিবার পরিজন ফেলে ঝাঁপ দিয়েছিল স্বাধীনতা সাধনের মহাযজ্ঞে।
অথচ রাজনীতির আবর্তে জড়িয়ে যখন ছেলেটি বহুকাল পলাতক-জীবনযাপন করেছে, দেশের বিভিন্ন জেলে বন্দী হয়েছে, তখন বারবার এই সিদ্ধান্ত স্বস্তি দিয়েছে তাকে। পিছুটান না রাখার মতই প্রিয়জনকে বিপন্মুক্ত রাখার বাসনাও কী কখনও মনের বিচিত্র গতিকে প্রভাবিত করে থাকে?
যারবেদা জেলে তার কাছে একদিন চিঠি এসে পৌঁছায়। স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ।
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করে প্যারোলে ছুটি নিয়ে দ্রুত বাড়ি ফেরার পর একটিমাত্র সন্ধ্যা আর সময় ছিল। তার কোলে মাথা রেখে পরদিন শেষ নিঃশ্বাস ফেলেন পুষ্পকুন্তলা।
“অমরার পুষ্প তুমি অমরা ছাড়িয়া/ এসেছিলে ধরাধামে ক্ষীণ পুণ্যফলে/কঠোর জীবন-ব্রত নীরবে সাধিয়া/ফিরিলে আজিকে হে পুষ্পকুন্তলে!”
“সূর্যবাবু, এখনও ভেবে দেখুন। এই সব রাজনীতি করে কী হবে? প্যারোলের মেয়াদ ফুরিয়ে এল, এবার থেকে এসব ঝামেলা ছেড়ে শান্তি করে থাকুন না! ম্যাজিস্ট্রেটকে একটা জবান লিখে দিলেই…”
প্যারা-টাইফয়েডে শয্যাশায়ী বিপত্নীক ছেলেটি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়।
ভুল হয়ে গেছে। প্রকাণ্ড ভুল।
অর্ধেক আকাশকে ঘরের কোণে, ব্রহ্মচর্যের নামে, দৌর্বল্যের অজুহাতে আটকে রেখে একচক্ষু হরিণের মত লড়াই করবার ভুল। এর প্রায়শ্চিত্ত তাকে করতে হবে।
“This is the time of ‘Sadhana’. This is the time for preparation to embrace death as a friend and this is the time to recall lights of other days as well.”
– মাস্টারদা!
উমাতারা হাইস্কুলের শিক্ষকটির ঘরে হইহই করে ঢুকে পড়ে ছাত্র টেগরা। বাইরে ভিখিরি দাঁড়িয়ে আছে, একটা পয়সা দিচ্ছি।
খুলে রাখা জামাটার পকেট হাতড়ে একটাও পয়সা পাওয়া যায় না। মাস্টারদা মন দিয়ে কাগজ পড়ছেন।
বয়েসটা তেরো হলেও, পার্টির দাদাদের টাকার টানাটানির কথা টেগরা অর্থাৎ হরিগোপাল বলের অজানা নয়। একমুঠো চাল দিলেও চলবে ভেবে রান্নাঘরটাও ঘুরে আসে সে।
আধঘন্টা পর তার কাছে খবর পেয়ে দাদা লোকনাথ বল ও গণেশ ঘোষ এসে পৌঁছান। দুজনের সম্মিলিত জেরায় মাস্টারদা স্বীকার করেন, দুদিন যাবৎ ঘরে অন্ন বা অর্থ কিছুই নেই। কিন্তু অভুক্ত থাকতে কোনো অসুবিধাও হয়নি — বোঝাবার চেষ্টা করেন বার বার। নতুন সংগঠনের কাজ, সংবিধান রচনা, সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা — এর মাঝে তুচ্ছ খাওয়াদাওয়া নিয়ে অত ব্যস্ত হওয়ার কী আছে!
“Sweet remembrance of you all! My dear brothers and sisters, break the monotony of my life and cheer me up. At such a pleasant, at such a grave, at such a solemn moment, what shall I leave for you?”
“উল্টে মারতে শেখার খুব প্রয়োজন। সেটা শেখাবার ক্ষমতা তো আমার নেই অনন্ত। এ দায়িত্ব তোমাকেই দিলাম!”
অঙ্কের মাস্টারের অভয় আশ্রয়ে এসে জুটেছিল তাঁর উদাত্ত আহ্বানে অনুপ্রাণিত ছাত্রদল। তারা নাম লেখাল চট্টগ্রাম রিপাবলিকান আর্মিতে। তারা বিশ্বাস করত, পাঁচ হাজার গোরা-গোর্খা-সেনার মোকাবিলা পঞ্চাশজন বালক মিলে করতে পারে। জালালাবাদে ব্রিটিশবাহিনীকে ঐতিহাসিক পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য করেছিল তারা।
তবে মাস্টারদার রোগাপাতলা শরীরটার পক্ষে সত্যিই সম্ভব ছিল না অনন্ত সিংহ-পরিকল্পিত কমব্যাট ট্রেনিংএর ধকল নেওয়া। নিজের দুর্বলতা, অক্ষমতাকে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে তিনি সমরাধিনায়কের পদ নিশ্চিন্তে নির্দ্বিধায় দিয়ে দিতেন অনুজপ্রতিম শিষ্যদের, নিজে সাধারণ সহকারী আজ্ঞাবাহী সৈনিকের ভূমিকায় থেকে। স্কুলের ছাত্রদের কাছে সাইকেল চড়া শিখে উঁচু পাহাড়ে উঠতেন পায়ের জোর বাড়াবার জন্য।
এ-ই নাকি বিপ্লবী? অবিশ্বাসে ভ্রূ কুঞ্চিত করেছিল ইংরেজ গোয়েন্দারা। এই দুর্বল রোগজীর্ণ শরীর চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করেছিল? তাও সম্মুখসমরে, সশস্ত্রযুদ্ধে?
ধলঘাট থেকে জ্যৈষ্ঠপুরা চার মাইল পথ বর্ষার রাতে খানা-ডোবা পেরিয়ে, বুকে হেঁটে, পুলিশের বুলেট এড়িয়ে পৌঁছেছিল এই ক্ষীণস্বাস্থ্য মানুষটাই? দীর্ঘ অত্যাচারে শারীরিক দুর্বলতার চরম সীমায় চলে যাওয়া এই রুগ্ন, নিরীহ সামান্য অঙ্কের মাস্টারই চট্টগ্রাম রিপাবলিকান আর্মির সর্বাধিনায়ক?
“What shall I leave for you? Only one thing, that is my dream, a golden dream – a dream of free India. How auspicious a moment it was, when I first saw it! Throughout my life most passionately and untiringly, I have pursued it like a lunatic.”
১৬ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৩।
গৈরালায় ব্রজেন সেনের ঘরে রাতের খাবার খেতে বসেছেন সশিষ্য পলাতক মাস্টারদা।
হঠাৎ বাইরে দাঁড়ানো ব্রজেনের চোখে পড়ে, ওদিকের ঘরের জানলা দিয়ে দাদা নেত্র সেন হাত বাড়িয়ে কাকে যেন আলো দেখাচ্ছেন।
কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত, সুশীল দাশগুপ্ত চোখের পলকে বেরিয়ে আসেন বাইরের অন্ধকারে, পশ্চিম দিকের বাঁশবন পেরিয়ে ছুটতে থাকেন। ক্যাপ্টেন ওয়ামস্লের গোর্খা বাহিনী ততক্ষণে বাড়ি ঘিরে ফেলেছে।
সুশীল কল্পনাকে কোলে তুলে নিমেষে ডোবা পার করে দিলেন। মাস্টারদাকে সাহায্য করতে যাবেন, এমন সময় গুলি এসে লাগল তাঁর ডান হাতে।
ছদ্মবেশে তিন বছর আত্মগোপনের পর দেশবাসীর বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়লেন চট্টলসূর্য।
রাইফেলের কুঁদো দিয়ে মেরে রক্তাক্ত মাস্টারদাকে যখন মাঠের উপর দিয়ে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বসন্তের পরিস্কার আকাশেও হঠাৎই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল।
“I know not where I am compelled to stop my pursuit today. If icy hands of death give you a touch before the goal is reached, then give the charge of your further pursuit to your followers as I do today. ONWARD, MY COMRADES, ONWARD – NEVER FALL BACK. The day of bondage is disappearing and the dawn of freedom is ushered in. Be up and doing. Never be disappointed. Success is sure. God bless you!”
পটিয়া ক্যাম্প থেকে ট্রেনে করে নিয়ে যাওয়ার সময় ব্রজেন সেন ও মাস্টারদাকে খুশিমত মারধোর করে যায় গোর্খা সেনার দল। বোলশহরে গোয়েন্দার দল, পুলিশ সুপার হিকস, স্প্রিংফিল্ড এসে যোগ দেন তাতে।
“সূর্যবাবু, পাহাড়তলীতে প্রীতিকে তো জ্যান্ত খেলেন। কল্পনাকে কোথায় রেখে এসেছেন?”
কনডেমড সেলে জ্বরের ঘোরে ছায়াছবির মত এক-একটা মুখ ভেসে ওঠে। অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের দুঃসাহসী বীর, জালালাবাদের অজেয় সৈনিক, ফেণী-কালারপোলের দুর্দম শহীদদের মুখ।
নরেশ। বিধু। টেগরা। ত্রিপুরা। মধু। অর্দ্ধেন্দু। প্রভাস। পুলিন মতি শশাঙ্ক জিতেন রজত দেবু মনোরঞ্জন স্বদেশ অপূর্ব…যাদের বয়স কুড়ি পেরোল না কোনোদিন…
তরুণ নায়ক রামকৃষ্ণ…প্রিয়তম সহচর নির্মল…
আর সবচেয়ে আদরের রাণী, ভগ্নীসমা প্রীতিলতা — তাঁর প্রথম জীবনের নারীবর্জিত আন্দোলনের মূর্তিমতী সংশোধন, চরমতম মূল্য।
“মা, আনন্দময়ী মা আমার…আমি কি অন্যায় করে যাচ্ছি? এত মায়ের চোখের জল, এত বাপের বুকফাটা কান্না, এত ভাইবোনদের দীর্ঘশ্বাস, এ সবের কারণ হয়েছি বলেই আমি কি অন্যায় করছি?
কিন্তু আমার মনে হয়, আমি ঠিক পথে চলেছি। তাই চারিদিকে শ্মশান সৃষ্টি হচ্ছে দেখে মনে ব্যথা পেয়েও আমি লক্ষ্যটিকে বুকে চেপে ধরে আছি এই আশায়, যে এসকল পবিত্র শ্মশানস্তুপের উপরে একদিন স্বাধীনতার সৌধ নির্মিত হবে।
মা, তোমায় মিনতি জানাচ্ছি, যদি আমার ভুল হয়, আমার ভুল ভেঙে দিও, আর যদি ঠিক পথেই আমি চলে থাকি, তাহলে আমার বিশ্বাসকে আরও শক্ত করে দাও, আমাকে শক্তিমান করে দাও, আমার মধ্যে যেন কোন দুর্বলতা না আসে, আমি যেন আমার পথ থেকে কোনদিন এক চুলও না সরি।”
তারকেশ্বরকে দলের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য! এক মঞ্চে একই লগ্নে তাঁরই সঙ্গে ফাঁসি যেতে হবে তাকেও।
অকথ্য অত্যাচারে মৃতপ্রায় তাঁদের দেহদুটিকে অভূতপূর্ব পুলিশ-প্রহরায় ফাঁসি দেওয়ার পূর্বরাত্রে জেলের সকল সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে সূর্য্যকুমার সেন লিখলেন তাঁর শেষ বার্তা।
“Never forget the 18th of April 1930, the day of the Eastern Rebellion in Chittagong… Write in red letters in the core of your hearts the names of the patriots who have sacrificed their lives at the altar of India’s freedom.
My earnest appeal to you – there would be no divisions in our organization. My blessings to you all inside and outside the jail.
Fare you well.
Long live Revolution!
Bandemataram!”
Chittagong Jail, 11th Jan, ’34 at 7 p.m.
কলমে লেখা দেবদাস মাজী