ব্যাক্ট্রিয়ার তীরে এসে আটকে গেলো ‌সিকান্দারের সৈন্যরা। অবশ্য সিকান্দার যেভাবে আটকা পড়েছেন তার সৈন্যরা সেভাবে আটকা পড়েনি। সিকান্দার ওরফে মেসিডোনিয়ার রাজা ফিলিপের সন্তান। পৃথিবীর পূর্বপ্রান্ত জয়ের নেশা নিয়ে বেরিয়েছিলেন তিনি হাজার হাজার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে। পারস্য জয় করে আজ এসে পৌঁছেছেন ব্যাক্ট্রিয়াতে, “সগডিয়ান” দুর্গের সম্মুখে। স্থানীয়বাসির মতে সগডিয়ান দুর্গ ছিলো অপরাজেয়। কিন্তু যে আলেকজান্ডার দেশ-বিদেশের বহু রাজা, বহু সম্রাটকে পরাজিত করেছেন, বহু দুর্গকে জয়‌ করেছেন, কেনোই বা তিনি আজ সগডিয়ান দুর্গের কাছে হার মানবেন? সিকান্দারের সৈন্য এগিয়ে যাচ্ছে সগডিয়ান দুর্গের কাছে।

সগডিয়ান

সগডিয়ানের পাথর দুর্গের উপর থেকে অক্সিয়ার্টেস ও তার দলবলেরা ক্ষণে ক্ষণে তীর-ধনুক মেরে ছত্রভঙ্গ করছে আলেকজান্ডার এর সৈন্যদলকে। সগডিয়ানরা হুঙ্কার ছেড়ে বললো

“সগডিয়ান দুর্গ জয় করবে এমন বীর-পুরুষের জন্ম এখনো এই ভূখণ্ডে হয়নি, তোমাদের কারো যদি পাখা গজিয়ে থাকে তবে উড়ে আসো।”

এই বলে একযোগ হাসি হেসে সগডিয়ানরা ঢুকে যায় দুর্গের ভেতর। নেমে আসে রাতের অন্ধকার। ওহ, অক্সিয়ার্টেস কে তা তো জানা হলো না। অক্সিয়ার্টৈস হলেন সগডিয়ান ওরফে ব্যাক্ট্রিয়ার অধিপতি। পশ্চিমা সৈন্যরা যখন তাদের অভিযান পথের সমস্ত রাজ্য পদানত করছে, বিশেষত সমরখন্দ, বোখারা, ব্লগ, আমুদরিয়াতে আক্রমণ চালাচ্ছিলো; তখন তাদের প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে স্ত্রী-কন্যা-পরিবার-পরিজন নিয়ে ব্যাক্ট্রিয়া থেকে অনেক দূরে এসে আজ আশ্রয় নিয়েছেন অভেদ্য সগডিয়ানের দুর্গে। রাতের অন্ধকারে অক্সিয়ার্টেস ভাবছেন তার নিজ জাতি-গোষ্ঠীর কথা, নিজের অতীতের কথা।

ওদিকে হার না মানা আলেকজান্ডার তার সৈন্যদের কাছে ঘোষণা করলেন যে, যারা এই খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দুর্গ জয় করতে পারবে তাদেরকে মহামূল্যবান পুরষ্কারে ভূষিত করা হবে। সকালের মধ্যেই আলেকজান্ডার এর ৩০০ জন সৈন্য পর্বতের চূড়ায় পৌঁছে গেলো, যদিও আরোহণের সময় ৩০ জন সৈন্য ছিটকে পড়ে মারা যায়। হতভম্ব অক্সিয়ার্টেস আর তার সৈন্যদের পরাজিত করে কিছুক্ষণের মধ্যেই সমগ্র দুর্গ জয় করে নেয় আলেকজান্ডার এর সৈন্যরা। দুর্গ জয় এর পর আলেকজান্ডারের সৈন্যরা বিজয় উপলক্ষে দুর্গে নাচ-গানের আসর বসায় এবং সেখানেই আলেকজান্ডার প্রথম দেখেন রূপসী ‘রোকসানা’ কে। ‘রোকসানা’ নামের অর্থ ‘আকাশের ছোট্ট তারা’। ঠিক সেরকম একটি তারা হয়েই যেনো বীর যোদ্ধার চোখে ভেসে থাকলেন ‘রোকসানা’। প্রাচীন গ্রিক উচ্চারণে নামটা যা-ই হোক, সহজভাবে বলতে গেলে রোকসানা ছিলেন ব্যাক্ট্রিয়ার রাজকুমারী।

ইতালীয় শিল্পী বারোক পিয়েত্রো রোটারি ১৭৫৬ আঁকা একটি চিত্রকলায় আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এবং রোকসানা।

৩৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার জন্ম সগডিয়ানে। ব্যাক্ট্রিয়ার অভিজাত অক্সিয়ার্টেস হলেন তার বাবা। পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত থাকায় এই ব্যাক্ট্রিয় নেতা জীবনভর সংগ্রাম করে গেছেন পারস্যের বিরুদ্ধে। আলেকজান্ডার যখন তার যাত্রাপথের একের পর এক ভূখণ্ড দখল করছিলেন, সে সময়ে অক্সিয়ার্টেস পারস্যের যুদ্ধবাজ নেতা স্পিটামেনেসের সঙ্গে চুক্তি করে মেসিডোনিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তবে আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে তিনি বেশিদিন টিকতে পারেন নি। সগডিয়ান দুর্গে দিনের পর দিন লড়াই চালিয়ে তাকে অবশেষে হার মানতে হয়। অপরদিকে দেশের পর দেশ জয় করে আসা আলেকজান্ডার বুঝতে পারেন যে, শুধু রাজ্য জয় করে এখানকার মানুষের আনুগত্য পাওয়া যাবে না, তাদের সাথে সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে হবে।

পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুস

তাই সসম্মানে রোকসানার পিতা অক্সিয়ার্টেসকে তার নিজ অঞ্চলসহ আরো বৃহৎ অংশের অধিপতি নিয়োগ করলেন তিনি। তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে তিনি ও তার যোদ্ধারা সে অঞ্চলের প্রথা অনুসরণ করে তাদের মতো পোশাক পরতে লাগলেন। এমনকি অপরাপর সমস্ত সেনাপ্রধান ও পরিজনদের মতামত অগ্রাহ্য করে খেয়ালি আলেকজান্ডার সগডিয়ানের রাজকন্যাকে বিয়ে করে বসেন। স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী এক টুকরো রুটি তলোয়ার দিয়ে কেটে দুই টুকরো করে বর ও কনেকে খাওয়ানোর মাধ্যমে বিয়ে সুসম্পন্ন হয়। আলেকজান্ডারের বিয়ের দিনে তার দশ হাজার সৈন্যও স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করে। এতে গ্ৰীক-ব্যাকট্রিয়ার সম্পর্ক মজবুত হয়। কিছুদিনের মধ্যেই রোকসানা বুঝতে পারেন, যে ভালোবাসা দেখিয়ে আলেকজান্ডার তাকে বিয়ে করেছিলেন, সে ভালোবাসা তার একার জন্য নয়, আক্রমণ পথে পরাজিত সম্রাটদের কন্যাদেরকেও তিনি রাজসেবিকা করে নিয়ে এসেছেন। পরে ভাগ্যাহত রোকসানা বুঝতে পারেন আলেকজান্ডারের ভালোবাসায় সবচেয়ে বেশি ভাগ বসাবে ‘হেফাশ্চিয়ান’ নামক পশ্চিমা দেশীয় এক যুবক।

আলেকজান্ডারের বিয়েতে সবচেয়ে বেশি মর্মাহত হয়েছিলো এই যুবক। হেফাশ্চিয়ান সব সময়েই ছিলো আলেকজান্ডারের প্রিয় সঙ্গী। তাছাড়া বিভিন্ন রাজসেবিকার সাথেও ছিলো আলেকজান্ডারের মেলামেশা। প্রথম প্রথম রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে আলেকজান্ডার কে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন রোকসানা। তবে যে যোদ্ধা রাজ্যের পর রাজ্য নিজ হাতে পরাস্ত করেছেন; তাকে রাগ, ক্ষোভ দিয়ে পরাস্ত করা যায় না; বরং সমর্পণ এর মাধ্যমে জয় করতে হয় তাকে। সাহস এবং সৌন্দর্য এর সমমিলনে দেখা রোকসানাকে আলেকজান্ডার অবহেলা করে ফেলে রাখতে পারেননি। রোকসানাকে নিয়ে ‌তিনি পাড়ি জমিয়েছেন আরও পূর্ব প্রান্তে। তবুও রোকসানা পারলেন না আলেকজান্ডার কে আটকে রাখতে। পারস্য অভিজাত কুলের সাথে সম্পর্ক গভীর করার জন্য এবং পারসীয় সুন্দর চোখগুলো এড়াতে না পেরে আলেকজান্ডার বিয়ে করে বসেন পারসীয় অভিজাত কুলের দুই শাখার রাজকন্যাকে, দ্বিতীয় স্টেটেরিয়া এবং তৃতীয় প্রেস্টিসাটিসকে বিয়ে করেন তিনি। বার্সাইন নামক আরেক অভিজাত নারী ছিলেন আলেকজান্ডার এর প্রেমিকা, যার গর্ভে হেরোক্লিস নামক এক সন্তান হয় আলেকজান্ডার এর। কিন্তু পরবর্তীতে ঐ সন্তান স্বীকৃতি পায় নি।

হেফাশ্চিয়ান

পৃথিবীর শেষ প্রান্ত জয় করার অভিপ্রায়ে আলেকজান্ডার এবার আরো পূর্বে যাত্রা শুরু করেন এবং সগডিয়ান রাজ্যে স্ত্রী হিসেবে তার জীবনে আসে রোকসানা। রোকসানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতবর্ষ আক্রমণকারী আলেকজান্ডার আজ ঝিলম নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ভাবছেন যে, এবার কি ফেরত যাওয়া উচিৎ নিজের রাজ্যে, যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেই মেসিডোনিয়ায়? ঝিলমের তীরে স্থানীয় হিন্দু রাজা ‘পুরু’ অসীম সাহস আর বীরত্ব দেখিয়ে যুদ্ধ করেন তার সাথে। আলেকজান্ডার তার বিশ্বজয় শুরু করেছিলেন সেই থিবস নগরী পুনঃস্থাপনের মধ্য দিয়ে রাজ্য পরিচালনা শুরু করে। এক পর্যায়ে, ৩১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কাসান্ডার বন্দী করে আলেকজান্ডারের মা অলিম্পিয়াস, স্ত্রী রোকসানা এবং পুত্র চতুর্থ আলেকজান্ডারকে। কাসান্ডার অলিম্পিয়াসকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে, কিন্তু তার সৈন্যরা সে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে অস্বীকৃতি জানায়। অবশেষে, অলিম্পিয়াস পূর্বে যাদেরকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছিলো তাদের স্বজনদের মাধ্যমে কাসান্ডার অলিম্পিয়াসের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করায়। অন্যদিকে, থ্রেসর অ্যাম্ফিপোলিসে বন্দী থাকে রোকসানা আর আলেকজান্ডারের পুত্র সন্তান এবং ৩১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কাসান্ডারের নির্দেশে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় আলেকজান্ডারের শেষ বংশধর, তার তের বছর বয়সী সন্তান এবং স্ত্রী রোকসানা। যুদ্ধে এক চোখ হারিয়ে ফেলা আলেকজান্ডারের পিতা রাজা ফিলিপের স্বপ্ন ছিলো একদিন গ্রীস, মেসেডোনিয়ার সীমান্ত পার হয়ে পারস্য জয় করবেন।

কিন্তু কে হবে ফিলিপের উত্তরসূরী, আর এতো বড় সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী? একদা সদ্য বিবাহ করে আসলে বিবাহ উপলক্ষে করা ফিলিপের পানাহারের আসরে নতুন রাণীর বয়োজ্যেষ্ঠ অভিভাবক সেই প্রশ্ন তুলে উস্কানিমূলক মন্তব্য করতে গেলে তার মুখে সুরার পাত্র থেকে সুরা ছুঁড়ে মারেন আলেকজান্ডার। উত্তপ্ত, মাতাল ফিলিপ তলোয়ার নিয়ে ছেলেকে শায়েস্তা করতে আসার সময় এক কদম এগিয়েই মেঝেতে ঢলে পড়েন। সেদিন আলেকজান্ডার বাবাকে তিরস্কার করে বলেছিলেন, “যে রাজা এক কদম পার হতেই পরাস্ত হয়, সে রাজা কি করে স্বপ্ন দেখেন গ্রীস পার হয়ে পারস্য আক্রমণ করার।”

আলেকজান্ডার

উচ্চাভিলাষী মা অলিম্পিয়াস সবসময় সুযোগে থেকেছেন কি করে অন্য সব উত্তরাধিকারীকে নিশ্চিহ্ন করে ছেলে আলেকজান্ডারকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা যায়। তারই ধারাবাহিকতায় প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে ৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, তার বিশ্বস্ত সাতজন দেহরক্ষীদের একজন এবং পুরুষ শয্যাসঙ্গী পসানিয়াসের হাতে নিহত হন রাজা ফিলিপ। নিজের সম্মুখে বাবার এই অপমৃত্যু আলেকজান্ডার খুব সহজভাবে মেনে না নিলেও মাত্র বিশ বছর বয়সে পিতার অপমৃত্যুর মধ্য দিয়ে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন সম্রাট আলেকজান্ডার। মেসিডোনিয়ান অন্য সব রাজ্যের যুবরাজসহ সিংহাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্ভাব্য সব ধরনের ব্যক্তি, যারা ভবিষ্যতে সিংহাসনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে, তাদের সবাইকে খুন করানোর মধ্য দিয়ে আলেকজান্ডার তার রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন। ওদিকে, মা অলিম্পিয়াস আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন ফিলিপের অন্য স্ত্রী এবং তার শিশু সন্তানদেরকে, যার কারণে আলেকজান্ডার মায়ের উপর ক্ষিপ্তও হন।

রোম সাম্রাজ্যের একটি পদকে অলিম্পিয়াসের প্রতিচ্ছবি

ক্যাসান্ডারের হাত থেকে রেহাই পাননি ক্ষমতাশালী ‌অলিম্পিয়াস‌, যে হাজার‌ বাধা পেরিয়ে নিজের সন্তানকে করেছিলেন পৃথিবীর সম্রাট, এমনকি রক্ষাও করতে পারেন নি তার পুত্রবধূ ও নাতিকে। পৃথিবী বিজয়ী আলেকজান্ডার এর শাসন এবং রক্ত এভাবেই শেষ হয়। ইতিহাস হুররামকে মনে রেখেছে বহু রক্তপাতের পর নিজের সন্তান‌কে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন বলে; ঘষেটি বেগমকে মনে রেখেছে, কারণ সাময়িক ভাবে হলেও তিনি সফল হয়েছিলেন; অলিম্পিয়াসকেও মনে রেখেছে আলেকজান্ডারকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন বলে। কিন্তু এই ভারতবর্ষের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও আমরা মনে রাখতে পারি নি আলেকজান্ডারের প্রথম স্ত্রীকে, রোকসানাকে। যুগের চাহিদায় পু্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি অনেক হত্যা করেও সফল হন নি এবং ঢাকা পড়েছেন ইতিহাসের ধুলোবালিতে।

তবুও ‘রোকসানা’ চরিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ হাজার মাইল পেরিয়ে ব্যাক্ট্রিয়ার এই রাজকন্যাকে নিজের মহিষীরূপে উপযুক্ত মনে করেন আলেকজান্ডার। রোকসানাকে বিয়ে করার সময় দশ হাজার সৈন্যের সাথে ব্যাক্ট্রিয় কন্যাদের বিয়ে দিয়ে আলেকজান্ডার ভারত-গ্রীক মিলিত সংস্কৃতি সৃষ্টি করেন ব্যাক্ট্রিয়ায়, যার পরবর্তী ফলাফল সুদূরপ্রসারী। তবুও সময়ের বালিতে মিশে যায় সকল ইতিহাস।

বি.দ্র. এই লেখাটিতে কিছু কিছু কল্পকাহিনীর আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে।