ভারতীয় পুরাণে উল্লিখিত দেবতা বিষ্ণুর দশ অবতারের কথা সর্বজনবিদিত। ধরায় যখন পাপাচার অনেক বেড়ে যায় তখন শিষ্ঠের পালন ও দুষ্টের দমনে  বিষ্ণু অবতার রূপ ধারন করেন।  কিন্তু পুরাণের আরেক প্রভাবশালী দেবতা মহাদেব শিবেরও বেশ কিছু অবতারের ব্যাপারে জানা যায়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শরভ অবতার।যদিও শৈব ধর্মে অবতারবাদ নেই তবুও বিভিন্ন উপনিষদে শিবের এই ভয়ংকর রূপের পরিচয় পাওয়া যায়, যা অনেক ডার্ক।

পুরাকালে দৈববর পেয়ে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু অত্যন্ত দুরাচারী হয়ে ওঠেন। তার অত্যাচারে স্বর্গের দেবতা , মনুষ্য, পশু-পাখি সবাই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। তার প্রবল পরাক্রমে শিষনাগকেও পাতাল ছেড়ে দিতে হয়। সমস্ত অত্যাচারিতের আকুতিতে বিষ্ণু নৃসিংহ রূপ ধারন করেন, যা তার চতুর্থ অবতার। এই রূপের মাথা ছিলো সিংহের ন্যায় আর শরীর ছিলো মানুষের ন্যায়।সিংহের মত ভয়াবহ শ্বদন্ত ও নখর ছিলো।মূলত এই রূপ ধারনের উদ্দেশ্য ছিলো হিরণ্যকশিপুর বর ছিলো যে মানুষ, পশু-পাখি,গান্ধর্ব,দেবতা, অসুর কেউই তাকে সকালে বা রাতে বধ করতে পারবে না। এই জন্য দিবস ও রাতের মাঝামাঝি সময়ে নৃসিংহ তাকে দুই উরুর উপর রেখে দুই হাত দিয়ে চিড়ে হত্যা করে।

হিরণ্যকশিপু বধ হওয়ার পরও নৃসিংহের ক্রোধ প্রশমিত হলো না। তিনি দৈত্যরাজের পারিষদদের উপর তার ধ্বংসলীলা চালিয়ে যেতে লাগলেন। তখন আতঙ্কিত দেবতারা অনুভব করলেন যে নৃসিংহকে থামানো না গেলে তিনি আরোও ধ্বংসলীলা চালাতে থাকবেন এবং এক পর্যায়ে হয়তো সৃষ্টির বিনাশ শুরু করবেন। তাই তাকে থামানো দরকার। তখন সমস্ত দেবতারা একত্র হয়ে দেবাদিদেব মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন এবং তাকে কাতরভাবে অনুরোধ করলেন নৃসিংহকে নিবৃত্ত করতে।তখন কৈলাস পর্বতে মহাধ্যানী শিব তার পুত্র বিঘ্ন দেবতা গজানন গণেশকে ডেকে জানতে চাইলেন ভগবান বিষ্ণুর মতিভ্রমের কারন। গণেশ তাকে জানালেন যে ভগবান বিষ্ণু হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করতে যাওয়ার সময় তার নিকট আশীর্বাদ নেন নি। যার কারনে তিনি তার কার্য সমাধা করার পরও ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছেন। আসলে বিষ্ণু হিরণ্যকশিপুকে বধ করতে যাওয়ার আগে গণেশের মাতা দেবী পার্বতীর আশীর্বাদ নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন দেবী পার্বতী মহাদেবকে জানান তিনিই বিষ্ণুকে আশীর্বাদ করেছেন।আর বিষ্ণুকে একমাত্রও মহাদেবই থামাতে পারবেন। দৈত্যরাজ হিরণ্যক শিপুও পার্বতীর পূজারী ছিলেন।

দেবী পার্বতীর আশীর্বাদেই তিনি অজয় ছিলেন। কিন্তু দৈত্যরাজ তাঁর আশীর্বাদের ভুল প্রয়োগের ফলে দৈত্যরাজকে তিনি তখন পরিত্যাগ করেছিলেন, যার কারনে বিষ্ণুদেব তাকে হত্যা করতে পারেন।তখন মহাদেব তার অনুচর বীরভদ্রকে প্রেরণ করেন নৃসিংহকে থামানোর জন্য। কিন্তু তিনি ব্যার্থ হয়ে ফিরে আসলে সংহারকর্তা শিব তখন তার সবচাইতে ভয়ংকর রূপটি ধারন করেন। এই রূপের নাম শরভ অবতার বা শরভেশ্বর।এই শরভ রূপটি ছিলো মানুষ, পশু ও ঈগলের সংমিশ্রণে।এর সহস্র মুখ, দুইটি বিশাল ডানা, আটটি পা ও নানান অস্ত্রে সজ্জিত চার হস্তের কথা বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়। মুখ দিয়ে আগুন বর্ষিত হচ্ছিলো।নৃসিংহের সামনে উপস্থিত হয়ে তাকে আহবান করলে প্রচন্ড ক্রোধে নৃসিংহদেবও “কান্ডাবেড়ুন্ডা” নামে এক বিকট রূপ ধারন করেন।বিশালাকার পাখির ন্যায় আট মুখবিশিষ্ট এইরূপ ধারণ করে তিনি শরভের মুখোমুখি হলেন। দুজনের প্রচন্ড যুদ্ধ আরম্ভ হয়। স্বর্গ হতে দেবতারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে এই মহাসংগ্রাম প্রত্যক্ষ করছিলেন।মূলত শিব ও বিষ্ণুর মধ্যেই লড়াই চলছিলো।আর তারা তাদের নিজ নিজ রূপে ছিলেন।প্রায় ১৮ দিন পর এ মহাসংগ্রাম শেষ হয়। শরভের প্রচন্ড আঘাতে নৃসিংহ মাটিতে পড়ে গিয়ে তার আত্মসংবরণ করেন। এর মধ্য দিয়ে বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতারের লীলা শেষ হয়ে যায়।

বিভিন্ন পুরাণে যদিও শরভ অবতারের উল্লখ পাওয়া যায় এবং ভারতের দক্ষিণদিকে শরভ অবতারের আরাধনা বেশি করা হয়। আবার বৈষ্ণব মতে নৃসিংহের এমন পরিনতির কথা স্বীকার করা হয় না। এক্ষেত্রে , তাঁর স্বয়ং স্বম্বরণ হয়েছিলো মানা হয়। হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করার পর দেবী লক্ষ্মী, হিরণ্যকশিপুর পুত্র পরম বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদ প্রমুখের অনুরোধে তিনি শান্ত হন বলে বিশ্বাস করা হয়।