আগামী দিনগুলো আমাদের জন্য ভীষণ কঠিন হতে যাচ্ছে। আগামী ত্রিশ বছরের মধ্যে এই পৃথিবীর জলবায়ু  ভীষণভাবে পরিবর্তিত  হয়ে যাবে এবং এই পরিবর্তিত জলবায়ুকে সাথে নিয়েই প্রায় ১০ বিলিয়ন মানুষের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে হবে আমাদেরকে। তখন পানিও থাকবে কম, আবার আবাদযোগ্য জমির পরিমাণও  যাবে কমে। তাই স্বল্প সম্পদের মাধ্যমে কতো সফলভাবে এই বিশ্বের মানুষকে নিরাপদে খাদ্য সরবরাহ করা যায়, তার জন্য আমাদের এখন থেকেই চিন্তা-ভাবনা শুরু করতে হবে। আর এই সমস্যা সমাধানের জন্য পৃথিবীর সূচনালগ্নের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারলেই আমরা আমাদের খাদ্য ব্যবস্থাকে ভবিষ্যতে নতুন আকার দেবার ক্ষেত্রে কিছু ধারণা পেতে পারি। এমনই একটি ধারণা পাবার জন্য আমাদেরকে যেতে হবে কিংবদন্তী ব্যবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানে।

ব্যবিলনীয় সভ্যতা, যা ক্যালডীয় সভ্যতারই আরেক নাম। যীশুর জন্মের প্রায় ৬২০ বছর আগে এই ব্যবিলনের রাজা ছিলেন দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার। হিব্রু বাইবেলীয় ড্যানিয়েলের পুস্তকের প্রাচীন আক্কাদীয় ভাষায় তার নামের অর্থ দাঁড়ায়, “হে প্রভু, আমার পুত্রকে রক্ষা করো”। জানা যায়, এই রাজাই জেরুজালেমের মন্দির ধ্বংস করেছিলেন।

ব্যবিলনের নেবুচাদনেজারের সিংহাসন

ব্যাবিলনে নেবুচাদনেজারের প্রাসাদের সিংহাসন কক্ষ থেকে চকচকে ইট।

প্রায় আড়াই হাজার বছরেরও আগের কথা। রাজা দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার তখনও বিয়ে করেন নি। প্রজারা চেয়েছিলেন তাদের প্রিয় রাজা সুন্দরী এক রাজকুমারীকে রাণী করে নিয়ে আসবেন প্রাসাদে। প্রজাদের দাবি মেটানোর জন্য বিয়ে করতে রাজি হলেন রাজা।

আশেপাশের সব দেশে খোঁজাখোঁজির পরে অবশেষে রাজার যোগ্য রাজকুমারী পাওয়া গেলো মিদিয়াতে। মিদিয়াতে রাজকুমারী আমিতাসের সুনাম, সৌন্দর্য, শিক্ষা, গুণ, ভদ্রতা ও নম্রতা সম্পর্কে সবাই জানতো। কবিতা লেখা থেকে শুরু করে নাচ, গান, আবৃত্তি কোনো কিছুরই জুরি মেলে না তার। নেবুচাদনেজার আমিতাসের সমস্ত ব্যাপারগুলোতে মুগ্ধ হয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন মিদিয়াতে।

ব্যাবিলনের রাজধানী বাগদাদ তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম রাজ্যগুলোর একটি। শিক্ষা, জ্ঞান ও সভ্যতার তীর্থভূমি ছিলো বাগদাদ। তাই এতো ভালো ও প্রভাবশালী সম্বন্ধ পেয়ে মিদিয়ার সবাই খুব খুশি। বিশাল আয়োজন ও অনেক ধুমধাম করে বিয়ে সম্পন্ন হলো।

বিয়ের পর রাজা-রাণীর দিনগুলো খুব ভালোই কাটছিলো। হঠাৎ এক দিন রাজা লক্ষ করলেন রাণীর মনটা ভার হয়ে আছে। রাজা ভাবলেন, কি এমন হলো রাণীর! তিনি রাণীর মন খারাপের কারণ জানতে চাইলেন। রাণী জানালেন, মরুভূমির এই রাজ্যে সব কিছু থাকা সত্ত্বেও তার নিজের রাজ্যের মত ভালো লাগা কোথাও তিনি পাচ্ছেন না। তার নিজের দেশের সেই সুন্দর প্রকৃতি, গাছপালা, ফুল-ফল, নদী ভরা জল, পাহাড়-পর্বত, পাখিদের গান, ফুলে ফুলে প্রজাপতির উড়ে বেড়ানো, সব কিছুরই তিনি ভীষণ অভাববোধ করছেন। নিজের রাজ্যের অপার সৌন্দর্যে ঘেরা সেই প্রকৃতি দেখলেই রাণীর মন জুড়িয়ে যেতো। তার শুধু নিজের দেশের কথাই বার বার মনে পড়ছে। রাজা ভাবলেন, এ তো খুবই সামান্য ব্যাপার, রাণীর মন ভালো করার জন্য কিছু তো করতেই হয়। তখনই তিনি একটি সুন্দর বাগান তৈরীর সিদ্ধান্ত নিলেন। রাজ্যের সকল স্থাপত্যবিদ, নগরবিদ ও প্রকৌশলীদের ডেকে পাঠালেন এবং বাগান তৈরীরর কাজ শুরু করলেন।

ব্যাবিলনীয় সীল

একটি ব্যাবিলনীয় সীলমোহর যা ষাঁড় এবং গাছের চিত্র আনুমানিক ১৫৯৫-১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। ল্যুভর, প্যারিস।

নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীর বিষণ্ণ মনে খানিকটা আনন্দ দেবার উদ্দেশ্যে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে রাজা দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার তৈরী করেছিলেন প্রকৃতির অপরূপ সাজে সজ্জিত একটি উল্লম্ব বাগান। মরু অঞ্চলে মনকাড়া সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ চমৎকার একটি ঝুলন্ত বাগান ছিলো এটি। ধাপে ধাপে সজ্জিত এই উল্লম্ব বাগানটির প্রতিটি ধাপেই ফুল এবং ফলের গাছ লাগিয়ে অল্প জায়গাকেই স্ত্রীর জন্য চমৎকারভাবে সাজিয়ে তুলেছিলেন তিনি। হাজার রকমের ফুল-ফল-গাছ, আর নয়নাভিরাম ঝর্ণা যেনো চমৎকার সেই বাগানটির সৌন্দর্য আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলো। রাণী তার জানালা দিয়ে হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারতেন গাছের পাতা। ইউফ্রেটিস নদী থেকে পানি তুলে উপরে নিয়ে এই ঝুলন্ত বাগানে যেভাবে সেচের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো, সেটি নিঃসন্দেহে একটি অমূল্য শিক্ষণীয় বিষয়।

ঝুলন্ত বাগানটি বিশেষভাবে তৈরী করা হয়েছিলো। এর ভিতটি মাটি থেকে অনেক উপরে। বাগানের আয়তন ৮০০ বর্গফুট এবং উচ্চতা ৮০ ফুট। ৫ থেকে ৬ হাজার শ্রমিক কাজ করেছেন এই বাগান তৈরীর জন্য। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ডিওডোরাস সিকুলাসের মতে, ইউফ্রেটিস নদী থেকে পাম্পের সাহায্যে রোজ ৮২০০ গ্যালন পানি পাম্প করে উপরে উঠানো হতো, যদিও বর্তমান বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

ব্যাবিলনের উদ্যানে

ব্যবিলনের এই ঝুলন্ত উদ্যানের কতোটুকু সত্য বা মিথ্যা, তা এখনো বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি জানতে পারেন নি। জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৫১৪ সালে পারস্যের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো এই উদ্যান। তবে এই বাগান নাকি কেউ কোনদিনই দেখেন নি। আধুনিক গবেষকদের ধারণা, ব্যবিলনের শুন্য উদ্যান বলতে কখনোই কিছু ছিলো না এবং পুরোটাই সাহিত্যিকদের কল্পনামাত্র।

আরেকটি আধুনিক গবেষণা এই ঝুলন্ত উদ্যানের ধারণাটির মোড়ই ঘুরিয়ে দিয়েছে। ড. স্টেফানি ড্যালীর মতে, ঝুলন্ত উদ্যানের অস্তিত্ব সত্যিই ছিলো, কিন্তু তা ব্যবিলনে নয়, ব্যবিলন থেকে ৩০০ মাইল উত্তরে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী নিনেভেহ-তে তৈরী করা হয়েছিলো এই ঝুলন্ত উদ্যান। তার বিশ্বাস, দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার নন, বরং অ্যাসিরীয় রাজা সেনাকেরিব তৈরী করেছিলেন এই চমৎকার বাগানটি। খ্রিস্টপূর্ব ৬৮৯ সালে ব্যবিলন যখন অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন নিনেভেহকে ডাকা হতো ‘নতুন ব্যবিলন’ বলে। আর এ কারণেই ঝুলন্ত উদ্যানের উৎপত্তিস্থল নিয়ে একটি ভুল বোঝাবোঝির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন ড্যালী।

ব্যবিলনের বাগান

অ্যাসিরিয়ান প্রাচীরের নিনেভেতে বাগান দেখাচ্ছে

তবে সত্য হোক, কিংবা মিথ্যা, ব্যবিলনের শুন্য উদ্যানের এই ধারণাটি কিন্তু আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে শিক্ষণীয়। এমন উল্লম্ব ঝুলন্ত বাগান তৈরীর মাধ্যমে কিন্তু অচিরেই আমরা আমাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সমস্যাগুলোর সমাধান করে ফেলতে পারি।

রেফারেন্স: