সন্ধ্যার অবসরে ইদানিং বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার উল্টোদিকের বিশাল ভাঙাচোরা বাড়িটির দিকে তাকিয়ে থাকে চম্পা। মাঝে মাঝেই সিনেমার দৃশ্যের মত কিছু ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠে। হঠাৎ করেই যেন ঐ এলাকার চারিদিকের পরিবেশটি বদলে যায়l বদলে যায় রাস্তা থেকে আসা আওয়াজ, মানুষের কথোপকথন, তাদের ভাষা। শুনতে পায় ঘোড়ার খুরের শব্দl চোখের সামনে লোহার ফ্রেমের গেটl, বাড়ীর নাম লেখা “বড় কাটরা”। স্পষ্ট দেখতে পায় চম্পা মানুষগুলোকেl মাঝে মাঝে উদভ্রান্তের মত হাঁটাহাঁটি করছে, আবার কখনও একসাথে বসে পরামর্শ করছেl গত একমাস ধরে এমনই চলছেl আজ মনে হচ্ছে পরিস্থিতিটা বেশই জটিলl সকলের মুখ অন্ধকারাচ্ছন্ন। বোঝা যাচ্ছে তারা এই আস্তানা ছেড়ে যাবার প্রস্তুতিতে মগ্নl নতুন গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। বড় ছেলেকে প্রচুর অর্থ ও উপহারের বাক্স দিয়ে পাঠিয়েছেন আরাকান মুলুকেl আত্মীয়-পরিজনকে নিয়ে ঢাকা ছাড়বেন। রওনা দিবেন অজানার উদ্দেশ্যে। চম্পার এই এক অভ্যাস, মাঝে মাঝে কোথায় যেনো হারিয়ে যায় সে। চম্পার কল্পনায় যে দৃশ্যপটগুলো বারবার ভেসে আসে, সত্যি বাস্তবে তা ঘটেছিল কিনা জানা নেই, তবে প্রায় চারশ বছর আগে মোঘল সাম্রাজ্যে মঞ্চস্থ হয়েছিল এমনই এক নাটকl শাহজাহানকে বন্দী করে দিল্লীর ক্ষমতায় বসেন তার ছেলে আওরঙ্গজেব। শাহজাহানের অন্য তিন ছেলে দারাশিকো, মুরাদ আর শাহ সুজা এ’র বিরোধীতা করেছিল। তাই তো আওরঙ্গজেবের সঙ্গে তাদের বাঁধে সংঘর্ষ। পরাজিত হয়ে প্রাণ হারায় দারাশিকো আর মুরাদ। আওরঙ্গজেব সুজাকে বন্দী করার জন্যে বাহিনী পাঠান। সুজা প্রাণ বাঁচাতে স্ত্রীকে নিয়ে বর্তমান ঢাকার ওপর দিয়ে চট্টগ্রাম হয়ে আরাকানে (বর্তমানে মায়ানমার) পাড়ি জমান।
সুলতান মুহাম্মদ সুজা বাহাদুর, তিনি শাহ সুজা নামেই বেশী পরিচিত। সম্রাট শাহজাহান আর সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের দ্বিতীয় ছেলে ছিলেন শাহ সুজা। সম্রাটের কাছে সব সন্তান সমান ভাবে প্রিয় হলেও দারাশিকো ছিল তার সবচেয়ে বেশি আদরের। সুজাকেও তিনি কম ভালবাসতেন না। তবে সুজা ও তার দারার মধ্যকার সম্পর্কের রসায়নটা ছিল একদম আলাদাl চতুর্থ মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের চোখের মনি ছিলেন শাহ সুজা, তিনি তাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। তার নিজের কাছে এনে রাজকুমারকে রেখেছিলেনও বেশ কিছু দিনl সুজা যখন খুব ছোট তখন বিখ্যাত শিল্পী মনোহোরকে দিয়ে তার প্রতিকৃতি বানিয়ে ছিলেন সম্রাট। রাজকুমারের এটা একটি বিশেষ প্রাপ্তিl সুজা একবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রতিজ্ঞা করেন, তিনি শিকার ছেড়ে দিবেন। সুজা সুস্থ হয়ে উঠার পরেও বহুদিন তিনি তার শপথ ভঙ্গ করেন নি। এই তো গেল সুজার গল্পl এবার দৃষ্টিপাত করি সম্রাটের পুরো পরিবারের দিকেl
আমরা জানি মোগল সাম্রাজ্যের ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া খুব একটা সহজ ছিল নাl ক্ষমতা লাভের জন্য ভাইয়ে ভাইয়ে কোন্দল যেন একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এই কোন্দল থেকে তাদের দূরে রাখার জন্য সম্রাট শাহজাহান তাঁর প্রত্যেক সন্তানকে সাম্রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেবকে দক্ষিণাত্যে, মুরাদ বক্সকে গুজরাটে পাঠিয়ে ছিলেন, দারাকে দিল্লীতে রেখে শাহ সুজাকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার সুবেদার নিযুক্ত করেন।
দিল্লী থেকে ঢাকা আসলেন শাহ সুজাl তার দক্ষ পরিচালনায় সমগ্র বাংলায় নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি বজায় ছিল, সমৃদ্ধি ঘটেছিল বাংলায়। তবে ঢাকার উষ্ণ আবহাওয়া সুজার সহ্য হচ্ছিল না বলে তিনি বাংলার সুবার রাজধানী ঢাকা থেকে সরিয়ে বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তের পাশেই মালদহের কাছাকাছি রাজমহলে নিয়ে যান। রাজধানী সরিয়ে নিলেও ঢাকা ছিল প্রশাসনিক ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের কেন্দ্র বিন্দু। শাহ সুজা ছিলেন বাংলার একজন মহান স্থপতি। তার উল্লেখযোগ্য নির্মাণ স্থাপনাগুলো হলো, বড় কাটরা, ধানমন্ডীর শাহী মসজিদ, পুরান ঢাকায় অবস্থিত হুসেনি দালান, ইমামবাগ। শাহ সুজা কুমিল্লায় একটি মসজিদ তৈরি করে ছিলেন। চুড়িহাট্টায় মসজিদটি শাহ সুজার নেতৃত্বে নির্মিত হয়।
শাহ সুজা বুদ্ধি আর সাহসিকতার ছিলেন অসাধারণ। সৈনিক হিসেবে তিনি বেশ যোগ্য ছিলেন, তরুণ বয়সে অনেক যুদ্ধে তিনি বীরত্বের সাথে জয়ী হন। বড় ভাই দারার সাথে মিল ছিল তারl তিনি নিজেও শিল্প-সাহিত্য পছন্দ করতেন, বিশেষ করে পারস্য সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন তিনি। এই জ্ঞানী, সংস্কৃতিবান মোগল রাজকুমার পৃষ্টপোষকতায় ইরান থেকে আসা এবং শিয়া মতাবলম্বী ফারসী কবি ও পন্ডিত তাঁর দরবারকে অলংকৃত করেছিল। শিয়াদের প্রতি কিছুটা দুর্বলতা ছিল তাঁরl তাঁর মা, তাঁর দুই স্ত্রীও ছিলেন শিয়া। দরবারের প্রধান পারিষদ এবং এমন কি অধস্তন কর্মচারীদেরও বেশীর ভাগ ছিল শিয়া। ঢাকায় একটি প্রচলিত গল্প ছিল যে শাহ সুজা বাংলায় আসার সময় সঙ্গে করে তিনশো শিয়া নিয়ে আসেন এবং তাদেরকে বাংলার বিভিন্ন এলাকায় বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। তার এই শিয়া-প্রীতির ফলে দিল্লীতে মিথ্যা গুজবও রটে যে সুজা নিজেই শিয়া মতাদর্শ গ্রহণ করেছেন। গুজব যাই রটুক, সুজার নেতৃত্বে বাংলার মানুষ শান্তিতে বসবাস করছিল, আর উন্নয়নও হয়েছিল প্রচুরl
এই পর্যন্ত ভালোই চলছিল সবl কিন্তু হঠাৎই রাজপুত্রদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। ১৬৫৭ সালে সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েনl গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি মারা গেছেন, কিন্তু তাঁর বড় ছেলে দারাশিকো সিংহাসনে তাঁর অবস্থান দৃঢ় করার জন্য তা গোপন রেখেছেন। শুরু হয়ে যায় চার ছেলের মধ্যে সিংহাসনের দাবী নিয়ে ক্ষমতার লড়াই। বাকি তিন যুবরাজ সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর দিকে যাত্রার প্রস্ত্ততি নিতে থাকেন। মোগল সাম্রাজ্যের সিংহাসন দখলের জন্য দারাশিকোর উচ্চাকাঙ্খা শাহ সুজা বুঝতে পেরে তিনি সময় নষ্ট না করে রাজমহলে নিজেকে মোগল সাম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন ও রাজকীয় উপাধি গ্রহণ করেন। আর এর পরেই সুজা তার বাহিনী নিয়ে দারাশিকোর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য দিল্লীর দিকে রওনা দেন। সুজার এই পরিকল্পনা দারাশিকো জানতে পেরেই তার বড় ছেলেকে পাঠিয়ে দেন সুজাকে মোকাবেলা করার জন্য। দুই বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত হন শাহ সুজা। এরপর আওরঙ্গজেবের সাথে যুদ্ধ হয় দারাশিকোরl ইতোমধ্যে আওরঙ্গজেব দুবার (ধর্মাট ও সামগড়ে) দারাকে পরাজিত করেন এবং তাঁকে বন্দী ও হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই ভাবে এক এক করে মারা যান দারাশিকো এবং মুরাদ। এখন বাংলার পালাl বাংলা যে একটি সমৃদ্ধশালী অঞ্চল, আওরঙ্গজেব তা বেশ বুঝতে পেরেছিলেনl তিনি আরো অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, সিংহাসন আর বাংলা এই দুই দখলের ক্ষেত্রে তার জন্য বাধা হল শাহ সুজা। আওরঙ্গজেব সুজাকে পরাস্থ করার জন্যে সৈন্যবাহিনী পাঠালেন। ১৬৫৯ সালে প্রথমে সজওয়াহ নামের এক স্থানে যুদ্ধ হয় আওরঙ্গজেবের সাথে সুজার। সে যুদ্ধে শাহ সুজার বাহিনী পরাজিত হয়। তারপর তান্ডার যুদ্ধেও শাহ সুজা সম্পূর্ণ ভাবে পরাজিত হন। এই পরাজয়ের পরে তিনি বেশ বুঝতে পারেন যে, রাজমহলে তিনি আর নিরাপদ ননl প্রাণ বাঁচাতে তিনি ঢাকার দিকে রওনা দিলেন। শাহ সুজার ইচ্ছে ছিল, তিনি আরাকান রাজার সাহায্যে জাহাজে করে মক্কায় যাবেন এবং জীবনের বাকী অংশ সেখানে কাটাবেন। কিন্তু এক মাসের বেশী সময় পার হয়ে যায়, তবুও আরাকান রাজার কাছ থেকে কোন সাহায্য আসে নাl ঐ দিকে মীর জুমলার পিছু ধাওয়ার খবর শাহ সুজাকে ভীষণ ভাবে বিচলিত করে তোলে। এমন অবস্থায় নিরুপায় হয়ে তিনি নিজেই ঢাকা থেকে তার স্ত্রী, তিন ছেলে, তিন মেয়ে, বোন আর কিছু বন্ধু ও সৈন্য নিয়ে আরাকান যাবার পরিকল্পনা করেন। এক সময় রওনা দেন অজানা জীবনের পথেl
কোন রাস্তা ধরে শাহ সুজা আরাকান গিয়েছেন সে ব্যাপারে দু’ধরণের মতবাদ আছে। এক মতবাদ অনুযায়ী, তিনি ঢাকা থেকে প্রথমে ধাপায় হয়ে, শ্রীপুরে পৌছান। সেখান থেকে আরাকান রাজার পাঠানো কুখ্যাত পর্তুগিজ নাবিক ম্যানোয়েলের সাথে জালিয়া নৌকা করে আরাকানের দিকে রওনা হন। লক্ষীপুর, দেয়াঙ্গ হয়ে নাফ নদী পার হয়ে আরাকানের রাজধানী ম্রোহং-এ পৌছানl অন্য মতে, শাহ সুজা ঢাকা থেকে তার পরিবার ও অনুগত লোকদের নিয়ে মেঘনা নদীর তীরের একটি বন্দরে পৌছান। তার ইচ্ছে ছিল সেখান থেকে জালিয়া নৌকা দিয়ে মক্কায় যাবার। কিন্তু প্রকৃতিও শাহজাদার পক্ষে ছিল না! তখন ঘোর বর্ষাকাল, প্রকৃতি ছিল উত্তালl তাই মক্কায় তার আর যাওয়া হয় নি। বরং তিনি পার্বত্য ত্রিপুরা দিয়ে চট্রগ্রাম হয়ে নাফ নদী অতিক্রম করে আরাকানের রাজধানী ম্রোহং এ পৌছান।
শাহ সুজা এবং তার পরিবার আরাকানে পৌঁছলে তাদেরকে থাকতে দেয়া হয় রাজধানী বাবুডওং পাহাড়ের নিচে বাঁশের তৈরি ঘরে। রাজকুমার সেখানে পৌঁছে আরাকান রাজার মন জয় করার জন্য তার বড় ছেলেকে দিয়ে মনি-মুক্তা উপহার হিসেবে পাঠান। রাজাও তার অতিথিদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেন ও সৌজন্যস্বরূপ শাহ সুজার জন্য ফলমূল উপহার পাঠানl পরবর্তীতে রাজা কিন্তু তার কথা রাখেন নি। বরং আরাকানে রাজারই ছত্রছায়ায় মোগল সাম্রাজ্যের অত্যন্ত শক্তিমান রাজপুত্র এবং তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়।
কি ভাবে তাদের হত্যা করা হল, সে ব্যাপারে রয়েছে বিভিন্ন মতভেদ।
প্রথম মত অনুযায়ী, শাহ সুজাকে আরাকান রাজার আশ্রয় দেয়ার বিষয়টি আওরঙ্গজেবের পছন্দ হয় নি। তাই তিনি রাজাকে চিঠি দিয়ে সুজাকে ফেরত পাঠাতে বলেন, অন্যথায় আরাকান আক্রমনের ভয় দেখান। এই কারণে আরাকান রাজা হত্যা করেন সুজাসহ তার পরিবারের সবাইকে।
আরেকটি মতবাদে বলা হয় যে, সুজার ধনরত্ন এবং সুন্দরী মেয়েকে পাবার লোভে অন্ধ হয়ে আরাকান রাজা হত্যা করেন সবাইকে l আবার এমন কথাও শোনা যায় যে, আরাকানে মুসলমানদের সহায়তায় শাহ সুজা আরাকান রাজাকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করার ষড়যন্ত্র করেন। এজন্যই করুণ পরিণতি হয়েছিল তাঁদের।
কিন্তু সে সময় আরাকানে বসবাসরত ফরাসী, ওলন্দাজ ও পরবর্তী সময়ের ইংরেজ লেখক ও ঐতিহাসিকেরা শাহ সুজার বিদ্রোহ বা আরাকান রাজ্যের ক্ষমতা দখলের চেষ্টার কথা বিশ্বাস করেন নি। বরং তাদের মতে, সুজার মেয়ের সাথে আরাকান রাজার বিয়ের প্রস্তাব সুজা গ্রহণ না করায় তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বা অভ্যুত্থানের অভিযোগ করে তাদের সপরিবারে হত্যা করা হয়। সেই সময়ে আরাকানে বসবাসরত প্রবাসী কবি আলাউল বলেন, শাহ সুজার পরার্মশ দাতা বা মন্ত্রনাদাতাদের জন্য তাঁর এই পরিণতি হয়েছিল। তিনি আরো বলেন, তাঁর এই রাজ্য দখলের চেষ্টার কারণে, পরবর্তীতে আরাকানের বহু মুসলমানকে হত্যা ও নির্যাতন করা হয়। শাহ সুজার সাথে যোগাযোগ থাকার জন্য কবি আলাউলকে পঞ্চাশ দিন কারাগারে বন্দী রাখা হয়েছিল।
এখানেই শেষ নয়, পরবর্তীতে ভারতের অন্ধ প্রদেশের হায়দ্রাবাদে সংরক্ষিত দলিল থেকে শাহ সুজার হত্যার ব্যাপারে নতুন তথ্য জানা যায়। এতে বলা হয়েছে, শাহ সুজা ও তার পরিবারকে যখন হত্যা করা হয় তখন আরাকান রাজা চন্দ্র সুধর্মার বয়স ছিল আট/দশ। তাঁর বাবার মৃত্যুর পরে রানীর অভিবাকত্বে শিশু পুত্র চন্দ্র রাজা হয়েছিলেন, কিন্তু সর্ব ক্ষমতা ছিল রানীর। তাই আরাকানের রাজার পক্ষে শাহ সুজা ও তাঁর পরিবারকে হত্যা করা সম্ভব নয়। আরাকান রাজ্যের রানী, মুসলিম মন্ত্রী, শিশু রাজা দেখে সম্রাট শাহাজানের ছেলে সুজা আরাকান সিংহাসন দখলের জন্য লোভী হয়ে উঠেছিলেন, এবং সেই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়াতে তিঁনি নিজে ও তাঁর পরিবারই শুধু হত্যার শিকার হন নি, সাথে বহু মুসলিমের লাঞ্চনা ও প্রাণহানির কারণ ঘটিয়ে ছিলেন।
শাহ সুজার সাথে আসলে কি ঘটেছিল তা আজও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, কেউ বলেন-তাকে হত্যা করা হয়েছিল। আবার শাহ সুজাকে পরবরতীকালে জীবিত অবস্থায় মক্কায় দেখা গিয়েছিলো বলেও সংবাদ দিয়েছে কেউ কেউ। পাকিস্তানে তাঁর কবর রয়েছে এমন কথাও শোনা যায়। আবার অনেকে বলেন, মক্কায় যেতে না পেরে মোগল সৈন্যদের ভয়ে চট্রগ্রামেই লুকিয়ে ছিলেন তিঁনি এবং সেখানেই মারা গেছেন সুজা। মোগলরা বিখ্যাত ছিল তাদের সোনার গয়না ও রত্ন পাথরের জন্য।শাহ সুজাও এর ব্যাতিক্রম ছিলেন না। ধারণা করা হয়, যুদ্ধের সময় প্রচুর ধনরত্ন ও স্বর্ণমুদ্রা তাঁকে বিক্রি করে দিতে হয়। মগ রাজার হাত থেকে বাচাঁর জন্য তিঁনি সিদ্ধান্ত নিলেন ঐ সমস্ত রত্ন ভান্ডার নিয়ে পেগুতে পালিয়ে যাবার। কিন্তু পেগুতে যাবার রাস্তা ছিল দুর্গম, সর্বত্র পাহাড় -পর্বত ও গভীর জঙ্গল। বনভূমিতে ছিল প্রচুর বাঘ ও সিংহের আবাস। রাস্তা বলতে কিছুই ছিল না। পালাবার সময় সুজা ছিলেন সবার আগে, পেছনে তাঁর পরিবার ও সন্তানেরা। মগ সৈন্যরা আক্রমন করলে তাঁর পরিবার ধরা পরে যায়, সবার সামনে ছিলেন বলে তিঁনি পালাতে পেরেছিলেন কিনা তা’ জানা যায় নি। তাঁর ভাগ্য বির্পযয় সর্ম্পকে অনেক গল্পই প্রচলিত আছে। কিন্তু কোনটা যে সত্য তা’ নির্ণয় করা কঠিন। তবে অনেকে মনে করেন, মৃত্যুর আগে সুজার সাথে যে ধনসম্পদ ছিল তা’ হয়তো তিঁনি চট্রগ্রামের পাহাড়ের কোথাও লুকিয়ে রেখেছিলেন। এ সবই অনুমান। হয়তো একদিন কোন এক ভাগ্যবান পেয়েও যেতে পারে সেই সম্পদ -অসম্ভব কিছুই নয়।
সমাধী তৈরি মোগলদের একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। শাহ সুজার মা মমতাজ মহলের জন্য নির্মিত তাজমহল তার প্রমাণ। হতভাগ্য সুজার মৃত্যুর পর তাঁর কবর কোথায় হলো তা’ও আমরা জানি না, আদৌ হয়েছে কিনা, জানা নেই কারো।
বাহাদূর শাহ জাফর তার নিজের দেশে দু’ গজ কবরের মাটি পান নি। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত হতাশাগ্রস্ত নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন, কিন্তু এই হতভাগ্য যুবরাজ নিজ দেশে তো দূরের কথা, আদৌ তাঁর কবর হয়েছে কি-না তার কোন নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। সাম্রাজ্য আর সিংহাসন প্রচন্ড কঠিন এক বিষয়, এখানে অনেকে হারিয়ে যায়। ইতিহাস খুব নির্মম। সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজ মহলের আদরের সন্তান শাহ সুজার মত রাজপুত্রের জীবনের এমন পরিণতি, সত্যি দুঃখজনক।
ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। আকাশ থেকে মেঘ সরে যাওয়ায় চাঁদের আলোয় প্রকৃতি ভিন্ন রূপ নিলোl চম্পার চোখে ঘুমের কোনো দেখা নেই। চারদিকে সুনসান নীরবতা। সে শুধু ভাবছে, হয়ত এমনি এক চাঁদনী রাতে বাংলার এই হতভাগ্য সুবেদার তাঁর মায়ের জন্য তৈরি তাজমহলে দাঁড়িয়ে একটি শক্তিশালী প্রদেশ হিসাবে বাংলাকে তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেনl কে জানে?