বিল গেটস- মেলিন্ডা ফাউন্ডেশনের স্কলার্শিপের কথা অনেকেই জানেন কিন্তু বাংলার হাজি মহসিনের ওয়াকফ এস্টেটের কথা কয়জনেই বা জানি; আজকে আমরা সেই গল্পই করব। যা আমাদের গৌরবের এবং যা আমাদের গর্বের। ইউরোপীয়দের বাংলায় আগমনের বহু আগে থেকেই সুরাট, কেরালা, মাদ্রাজ, চট্টগ্রাম, সপ্তগ্রাম ইত্যাদি বন্দরগুলিতে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান ব্যাবসায়ীরা আসত। তাদের অনেকের নামের শেষে তাদের জন্মস্থান-সূচক পদবী থাকত। হুগলির ওলন্দাজ কোম্পানির কাগজপত্রে এই অঞ্চলের অধিবাসীদের সেরকম অনেক নাম দেখা যায়। সেসব নামের মধ্যে একাধিক ইস্পাহানি, সিরাজি, তেহেরানি, খোরাসানি, বাগদাদি ইত্যাদি নাম-পদবী রয়েছে। দানবীর হাজি মহম্মদ মহসিনের নামের শেষেও ছিল ইস্পাহানি পদবী। তাঁর সমাধি ফলকেও হাজি মহম্মদ মহসিন ইস্পাহানি লেখা রয়েছে। কে এই দানবীর হাজি মহম্মদ মহসিন ইস্পাহানি? জানতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে অনেক পেছনের ইতিহাসে। আসলে ২০০ বছর আগে তার মত দানবীর শিক্ষা ক্ষেত্রে যে অবদান রেখে গেছেন তা এক বিরাট অবিস্মরণীয় বিষয় যা ব্রিটিশরাও করতে পারেনি এবং তার কারণেই মুসলমানরা বিরাট শিক্ষার সুযোগ পায়।
তার অগাধ সম্পত্তি থাকলেও নিজে খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে তিনি নামাজ-কালাম নিয়মিত আদায় করতেন। সারাজীবন জাতিধর্ম নির্বিশেষে তিনি আর্ত মানবতার সেবা করে গেছেন। দানবীর হাজী মহাম্মদ মহসিন ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে সাধারণ জনগণের জন্য বহু লঙ্গরখানা চালু করেন এবং প্রচুর পরিমাণ অর্থ দান করেন। তাঁর মহানুভবতা ও দানশীলতার কথা আজও গোটা বাংলার মানুুষ স্মরণ করে । জনশ্রুতি রয়েছে যে, একদিন তাঁর বাড়িতে একজন চোর ধরা পড়লে তিনি সেই চোরকে পুলিশে না দিয়ে তার জন্য একটি কর্মের ব্যবস্থা করে দেন। আরেকটা ঘটনা থেকে জানা যায়়় যে, সন্তানদের খাবার দিতে না পেরে এক মা খুব কান্না করছেন। তখন তিনি তার কাছে সবকিছু শুনে তার জন্য পেনশন এর ব্যবস্থা করে দেন।
পরবর্তীতে দেখা যায় প্রায় কয়েকশ পরিবার তাঁর এস্টেট থেকে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে পেনশন পেয়ে থাকে। আরো অবাক করার বিষয় হলো বা, তার সবচেয়ে বড় যে কাজটি, তা হল- ১৮০৬ সালে তৈরী করা একটি ওয়াকফ ডিড । সেইটার অনুসারে, তাঁর সমস্ত সম্পত্তি নিয়ে একটি ওয়াকফ বা ট্রাস্ট গঠন করা হয়, যার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকা। এই হুগলি ইমামবাড়ার পূর্বদিকের দেওয়ালে ইংরাজি ও ফার্সি ভাষাতে ওয়াকফ ডিডটি লেখা রয়েছে। ২০০ বছর আগে দেড় লক্ষ টাকা কিন্তু অনেক বড় অংকের টাকা। হিসাব করলে হয়তো আজকের দেড়শ কোটি টাকার মত হবে ।
এবার একটু আবার পেছনে ফিরে যেতে চায়। পর্তুগিজরা ইরানের প্রধান বন্দর হর্মুজ দখল করে নেওয়ার পর থেকে ভারতের সাথে ইরানের নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা শুরু হয়। ইস্পাহান শহর থেকে স্থলপথে কাবুল, কান্দাহার ও লাহোর হয়ে আগ্রায় আসা যাওয়ার নতুন পথ চালু হয়। এই স্থলপথ ধরেই হাজি মহম্মদ মহসিন বড় হয়ে মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণে গিয়েছিলেন । এভাবে আগ্রাসী পর্তুগিজদের সাথে সন্ধি করে ইরানিরা ভারতের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে থাকে। তারপর পর্তুগিজরা যখন সপ্তগ্রাম ছেড়ে হুগলির ঘোলঘাটে তাদের পোর্ট পিকানো বন্দর তৈরি করল। তখন ইরানিরাও তাদের পাশাপাশি সেখানে শিয়াদের আবাসস্থল গড়ে তোলে। ইরানিরা অনেক আগে থেকেই শিয়া অবলম্বী ছিলেন। পরবর্তীতে আমরা দেখতে পাই যে তাঁদের এই শিয়া বংশধরেরা বাংলার অনেক স্থানের সুবেদার ও প্রশাসনের অনেক বড় বড় পদ লাভ করে এবং ঢাকা ও মুর্শিদাবাদসহ বাংলার বিভিন্ন জায়গায় শিয়া কলোনি গড়ে তোলে। হাজি মহম্মদ মহসিনের দাদা আগা মহম্মদ মোতাহারও ছিলেন সেরকম একজন জায়গিরদার।
আগা মহম্মদ মোতাহার ছিলেন একজন ইস্পাহানের লবণ ব্যবসায়ী। তারপর তিনি মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে আসেন। এবং খুব অল্প সময়েই তিনি সম্রাটের বিশেষ স্নেহভাজন হয়ে ওঠেন। সম্রাট তাকে খাজাঞ্চির চাকরিতে নিয়োগ দেন। পরবর্তীতে তিনি সম্রাটের কাছ থেকে জায়গির হিসাবে বিপুল পরিমাণ জমি লাভ করেন। আওরঙ্গজেবের দিল্লিতে শিয়াদের তেমন কোনো অনুষ্ঠান করার রেওয়াজ ছিল না । আর মোতাহার এবং তার স্ত্রী মহরমের মাতম করতেন এবং শিয়া অবলম্বী ছিলেন। সেজন্য স্ত্রীর ইচ্ছায় বাংলাকে বেছে নেন। তারা পরবর্তীতে হুগলিতে চলে আসেন এবং আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে তিনি যশোর, চিতপুর ও সপ্তগ্রাম জায়গির হিসাবে লাভ করেন। ১৭১৭ সালের দিকে হুগলিতে যখন তারা সপরিবারে চলে আসেন সেখানে তার একমাত্র মেয়ে মরিয়মের জন্ম হয়। যাকে মুন্নুজান খানম নামে সবাই চেনেন। মুন্নুজান খানম হলেন সম্পর্কে হাজি মহসিনের সৎ বোন।
আসলে, ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, মধ্য ইরানের ইস্পাহান শহরের সাথে হুগলির সম্পর্ক কয়েক শতাব্দীর। ইস্পাহান ছিল ইরানের সাফাভিদ রাজ্যের রাজধানী। সাফাভিদ সম্রাট শাহ আব্বাস ইস্পাহান নগরীকে জাঁকজমকপূর্ণ করে গড়ে তোলেন। মধ্য এশিয়ার মধ্যে ইস্পাহান নগরী শিল্প সংস্কৃতি সাহিত্য ও ব্যবসার জন্য প্রসিদ্ধ পরিচিতি পায়। পাশাপাশি নগরের আধুনিকমনস্ক লোকজনও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সারা বিশ্বে পরিচিতি পায়। এভাবে ভারতের সাথে তারা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তোলেন যা আজও কিছু বিদ্যমান এবং কলকাতার বহু সমাধি ও স্থাপত্য
তাদের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় , নানা দেশের ওমরাহদের মধ্যে ইরানিদের প্রতি আওরঙ্গজেবের বিশেষ দুর্বলতা ছিল। সম্রাট হুমায়ুনের সময় থেকেই ভারতের সাথে পারস্যের একটা খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সংস্কৃতি ও ব্যবসা ক্ষেত্রে তারা খুবই সুনাম অর্জন করে। তেমনি শাসনকার্য ও যুদ্ধবিদ্যাতেও ইরানিদের বিশেষ পারদর্শিতা লক্ষণীয়। আপনারা সবাই জানেন, মীর জুমলা ও শায়েস্তা খান দুজনেই ইরানি বংশোদ্ভূত এবং বাংলার সুবেদার ছিলেন।
এবার আসি মন্নুজানের সাথে হাজী মহসিন এর পরিবারের সম্পর্ক কিভাবে গড়ে উঠলো। আসলে হাজি মহম্মদ মহসিনের দাদা আগা ফয়জুল্লা ইস্পাহানি আঠারো শতকের শুরুতে ব্যবসা করতে ভারতে আসেন। তাঁদের ছিল চালের ব্যবসা। তিনি মুর্শিদাবাদে ব্যবসা শুরু করেন।
নবাব আলিবর্দি খানের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠলে , তিনি মুর্শিদাবাদেই বসবাস করতে থাকেন। পরে তাঁর ছেলে হাজি ফয়জুল্লা ইস্পাহানি তার ব্যবসাকে হুগলিতে নিয়ে চলে আসেন। হুগলিতে আসার পর আগা মোতাহারের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হাজি ফয়জুল্লা আগা মোতাহারের ব্যবসার প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন জায়গার ব্যবসা দেখাশোনা করতে থাকেন। সেই সুবাদে তিনি যখন সুরাটে তার ব্যবসা দেখাশোনা করতে গিয়েছিলেন সেই সময় ১৭২৮ সালে আগা মোতাহার মারা যান।
ইসলামী শরীয়া মোতাবেক উত্তরাধিকারসূত্রে, তিনি মারা গেলে তার সমস্ত সম্পত্তির মালিক হন তার একমাত্র মেয়ে মুন্নুজান। পরে কিশোরী মেয়ে মুন্নুজান ও তাদের ব্যবসা দেখাশোনার পুরো হাল ধরেন হাজী ফয়জুল্লা এবং মন্নুজানের মা জায়নব খানমকে হাজি ফয়জুল্লা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে করেন। ১৭৩২ সালে তাঁদের একমাত্র ছেলে মহম্মদ মহসিন ইস্পাহানির জন্ম হয়। তারা আগা মোতাহারের বাড়িতেই বাস করতেন। মহসিন ও মন্নুজানের পড়াশোনা বাড়িতেই আগা সিরাজি নামে এক পণ্ডিত ব্যক্তির কাছে শুরু হয়। সিরাজি যেমন ছিলেন পণ্ডিত ও তেমন খাসা পরিব্রাজক। তিনি বহু দেশ ভ্রমণ করেছিলেন ও সেইসব গল্প তিনি তাদের বলতেন। এভাবেই শিশু মহসিনের মনে প্রথম দেশ ভ্রমণের ইচ্ছা তৈরি হয়। আমরা জানি পরবর্তীতে হাজি মহসিন প্রায়় ২৭ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যয, সৌদি আরবসহ বহু দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন ।
শোনা যায়, ছোটবেলা থেকেই মহসিন ছিলেন অনেক মেধাবী। পাশাপাশি তিনি মল্লযুদ্ধে পারদর্শী এবং তলোয়ার চালনায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। আরবি ও ফারসি ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি তিনি কোরআন ও হাদিসে বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এছাড়া আরবি ও ফার্সি ক্যালিগ্রাফিতে মহসিনের বিশেষ পারদর্শিতা ছিল । তাঁর নিজের হাতে লেখা কোরআনের কপি আজও হুগলি ইমামবাড়া ও হুগলি মহসিন কলেজের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। মুন্নুজান সম্পর্কে সৎ বোন হলেও ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হওয়ার কারণে তাঁদের দুজনের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। অন্যদিকে বাবা হাজি ফয়জুল্লা মারা গেলে মন্নুজানের সম্পত্তির ওপরে বিভিন্ন লোকের নজর পড়তে শুরু করে। তাছাড়া মন্নুজানের বিপুল সম্পত্তি দখলের লোভে তাঁকে পরিবারেরই কিছু মানুষ বিষ খাইয়ে হত্যা করার পরিকল্পনা করছেেজানতে পেরে মহসিন দেরি না করে মন্নুজানকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। তারপর মন্নুজানের সাথে মির্জা সালাউদ্দিন নামে একজনের বিয়ে হলে, বোনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে হাজী মহসিন বিদেশ ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়েন। তাঁর বয়স তখন বত্রিশ।
প্রথম জীবনে মহসিন দিল্লি, আগ্রা সহ মুঘল উত্তর ভারতের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়ান। তারপর তিনি আরব দেশে যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেন। আরবে যাওয়ার পর তিনি মক্কায় গিয়ে হজ পালন করেন। তারপরে তিনি মদিনা ও নজফের এলাকায় যান। পথে ডাকাত দলের হাতে তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে পরবর্তী প্রায় সাত বছর টাকা-পয়সা শূন্য অবস্থায় ইরাক, আরব ও মেসোপটেমিয়ার নানা স্থান ঘুরে ঘুরে অবশেষে ইস্পাহান শহরে নিজের দাদার দেশের মাটিতে পৌঁছান। সেখানে পৌঁছে তিনি সেখানকার আত্মীয়দের কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা ও আতিথেয়তা লাভ করেন। ইস্পাহানে তিনি বেশ কয়েক বছর ছিলেন এবং খোরাসান প্রদেশের শিক্ষিত জ্ঞানীগুণী মহলে তাঁর পান্ডিত্যের বিশেষ কদর হয়। তিনি সেখান থেকে পরে তুর্কি ও মিশর ভ্রমণ করার পর অবশেষে প্রায় ষাট বছর বয়সে হাজি মহম্মদ মহসিন বাংলায় ফিরে আসেন।
তিনি দিল্লি, আগ্রা, পাটনা, বেনারস যেখানেই গেছেন সেখানেই তার পান্ডিত্যের জন্য পেয়েছেন বিশেষ সম্মান। ভারতে পারসিক সংস্কৃতির এক উল্লেখযোগ্য পীঠস্থান অউধ বা, লক্ষনৌ। লক্ষনৌ-এর নবাব আসাফ-উদ-দৌল্লা মহসিনের মত একজন পণ্ডিতকে পেয়ে নিজের দরবারে চাকুরি দিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। তবে মহসিন তা প্রত্যাখ্যান করে ফিরে আসেন মুর্শিদাবাদে। এদিকে মহসিন দেশ ভ্রমণে বেরনোর পর হুগলিতে মহসিনের বোন মন্নুজান খানম ও তাঁর স্বামী মির্জা সালাউদ্দিন হুগলির জমিদারি সামলাতে থাকেন। মির্জা সালাউদ্দিন মহম্মদ খান জায়গির হিসাবে যশোর ও সৈয়দপুরের বিপুল জমিদারি ছাড়াও হুগলির নায়েব ফৌজদার নিযুক্ত হন। হুগলিতে নিজের বাড়ির পাশেই তিনি একটি হাট চালু করেন যা ‘মির্জা সালার হাট’ নামে পরিচিত ছিল এবং যে অঞ্চলটি বর্তমানে ইমামবাজার নামে পরিচিত। একই সাথে তিনি ১৭৫০ সালে আগা মোতাহারের তৈরি ইমামবাড়াটি সংস্কারও করান। কিন্তু বিয়ের মাত্র ৯ বছরের মাথায় মির্জা সালাউদ্দিন হঠাৎ করেই মারা যান। স্বামী মারা যাওয়ার পরে বিপুল জমিদারি এষ্টেট সামলানোর সমস্ত দেখাশুনার দায়িত্ব নেন মন্নুজান নিজেই। মন্নুজান ছিলেন একজন শিক্ষিত ও স্বাধীনচেতা মহিলা । তার জমিদারি ও ব্যবসায চালনার বেশ জ্ঞানবুদ্ধি ছিল। জানা যায়, স্বামী মারা যাবার পর মন্নুজান কাছারিতে বসে কড়া হাতে নিজের এস্টেটের কাজকর্ম দেখা শোনা করতেন। তিনি অনেক জনপ্রিয় জমিদার ছিলেন। একবার হুগলির শেষ ফৌজদার খান জাহান খান যখন মন্নুজানকে বিবাহের প্রস্তাব দেন, তখন মন্নুজান উত্তরে ফৌজদারকে লেখেন, “আমি এমন ব্যক্তিকে বিবাহ করতে চাইনা, যিনি আমাকে বিবাহ করতে চান আমাকে ভালোবেসে নয়, আমার অর্থ ও সম্পদকে ভালোবেসে”। এই ঘটনা থেকে মন্নুজানের ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা ও স্বাধীনচেতা মনোভাবটি ফুটে ওঠে।
তবে বৃদ্ধাবস্থায় পৌঁছে মন্নুজান এস্টেটের কাজকর্ম সামলানোর মত উপযুক্ত শিক্ষিত ও বিশ্বস্ত একজনকে খুঁজতে শুরু করেন। ঠিক এই সময়েই হাজি মহম্মদ মহসিন দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন। মন্নুজান দেরি না করে তাঁর ভাই মহসিনকে হুগলির পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরতে অনুরোধ করেন। চিরকুমার মহসিন ছিলেন পরিবার ও বিষয়-সম্পত্তি থেকে অনেক দূরে। তিনি জীবনে কোনো চাকুরি করেন নি। চাকুরি পছন্দ না বলে, মহসিন অবলীলায় অউধের নবাবের চাকুরি প্রত্যাখ্যান করেছেন । কিন্তু এবার পারিবারিক ব্যবসার কারণে মন্নুজানের অনুরোধ আর ফেলতে পারলেন না।
এভাবে মহসিন পারিবারিক জমিদারি সামলাতে শুরু করলেন। তবে ১৮০৩ সালে ৮১ বছর বয়সে মন্নুজান মারা যান এবং তাঁর যাবতীয় সম্পত্তির মালিক হন হাজি মহম্মদ মহসিন। তবে মহসিনেরও খুব বেশীদিন নিজের হাতে সামলানোর সুযোগ হয়নি। ১৮১২ সালের ২৯শে নভেম্বর তারিখে ৮০ বছর বয়সে মহসিনও মারা যান। হাজি মহম্মদ মহসিনের মৃত্যুর পর, হুগলি ইমামবাড়ার পাশে তাঁদের পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে কবর দেয়া হয়। তাঁর নির্দেশমতই প্রথমে তাঁর সমাধির উপরে কোন বেদী বা সমাধি তৈরি করা হয়নি। পরে তাঁর শতবর্ষ উপলক্ষে তাঁর সমাধির উপরে পাঁচটি মিনার যুক্ত একটি মকবরা তৈরি করা হয়। এই পারিবারিক কবরস্থানে তার মা জয়নাব খানম, সৎ-বাবা আগা মহম্মদ মোতাহার, প্রিয় বোন মন্নুজান খানম ও বোনের স্বামী মির্জা সালাউদ্দিনেরও কবর রয়েছে।
এখানেই হুগলির বিখ্যাত সেই ইমামবাড়া রয়েছে। ইমামবাড়া কথার অর্থ ইমামের বাড়ি। হুগলি ইমামবাড়া বাংলার ইন্দো-পার্সিয়ান শৈলীর শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শনগুলির মধ্যে অন্যতম। ইমামবাড়ায় ঢুকতে গেলে প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে এর প্রশস্ত রাজকীয় প্রবেশপথ। এখান থেকে পবিত্র মহরম উপলক্ষ্যে তাজিয়া সাজিয়ে জুলুশ বার করা হয়। জন্মস্থান হুগলি ছাড়াও বাংলার নানা স্থানে হাজি মহম্মদ মহসিন ট্রাস্টের দানের অর্থে গড়ে উঠেছে অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও ইমামবাড়া। ইতিহাস থেকে জানা যায় বর্তমান খুলনা জেলায় হাজি মোহাম্মদ মহসিনের প্রায় চব্বিশ হাজার বিঘা জমির সম্পত্তি ছিল। বর্তমান খুলনা স্টেশনটি ছাড়াও খুলনা থেকে কলকাতা পর্যন্ত ১০৯ মাইল রেললাইনের মধ্যে প্রায় ৬৩ মাইল রেলের লাইন তার জমির উপরে নির্মাণ করা হয়েছে। তাছাড়া এই শহরে হাজি মহম্মদ মহসিনের নামে আরো দুটি সড়ক ও ছয়টি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজি মহম্মদ মহসিনের স্মরণে একটি হল আছে। চট্টগ্রামে রয়েছে হাজি মহম্মদ মহসিন কলেজ ও যশোরে রয়েছে হাজি মহম্মদ মহসিন ইমামবাড়া ও স্কুল। এছাড়া এই মহান মনিষীকে স্মরণ করে বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর ঘাঁটির নাম রেখেছেন বি এন এস হাজি মহসিন। তার আড়াই শত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নানা আয়োজন করা যেতে পারে যার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে তার অবদান তুলে ধরা যাবে। শুধু ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও এশিয়া ফাউন্ডেশনের স্কলারশিপের গল্প বললে হবে না; হাজী মহাম্মদ মহসিনের শিক্ষা ক্ষেত্রে যে স্কলারশীপ দিয়ে গেছে তা কোন অংশেই তাদের চেয়ে কম নয় এবং সেটা সামনে আনা এখন সময়ের দাবি। আর এই কাজ করতে হবে আমাদের ইতিহাসবিদদের।
তথ্যসূত্র:
Hooghly : Past and Present, Shambhoo Chunder Dey।
History of Bengal, Vol II Muslim Period, 1200-1757, Sir Jadunath Sarkar।
The Muslim Heritage of Bengal, Md. Mojlum khan।
বাংলাপিডিয়া।
হাজি মহম্মদ মহসিন ও হুগলি ইমামবাড়ি, (হুগলি হেরিটেজ) ; সুচিন্ত্য মল্লিক ও শঙ্খশুভ্র গাঙ্গুলি।
উইকিপিডিয়া।