প্রতিদিন আমরা কত ধরনের গানই তো শুনি— আধুনিক, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, বাউল, জারি- সারি, ভাটিয়াটি, ভাওয়াইয়া, লোকসংগীত ইত্যাদি নানা ধরনের গান। কিন্তু ‘হাপু’ গানের কথা আমরা কয়জন জানি ? আজ আমরা হাপু গানের কথা বলবো। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম – বাঁকুড়া – মুর্শিদাবাদ জেলার একটি প্রাচীন গান হচ্ছে এই হাপু গান । এই লোকগান অবশ্য এখন অবলুপ্তির পথে। এই গান খুব একটা প্রচারিত না হলেও এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। সাধারণভাবে একে দুঃখ-বেদনা ও হাহাকারের গান বলা হলেও গভীরভাবে শুনলে বোঝা যায় হাপু গানে যে মূল সুরটি ধ্বনিত হয় তা হল প্রতিবাদী সুর। যারা হাপু গান করে, তাদের আদি বাসভূমি ছিল দামোদর ও অজয়-সহ বিভিন্ন নদী তীরের কাছাকাছি এলাকায়। জমি, জঙ্গল ও জলাধারের অধিকার থেকে যখন তাদের উৎখাত করা হয়, সেই কষ্ট থেকে হাপু গানের সৃষ্টি হয় বলে অনেকে মনে করেন। এলাকা ভেদে ওই গানের নাম ‘হাপু’, ‘হাবু’ কিংবা ‘হাফু’। এই তিনটি নাম নিয়ে মত পার্থক্য থাকলেও ‘হাপু’ শব্দটিই সঠিক বলে মনে করা হয়।

যদি ‘হাপু’ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে পাওয়া যায় ‘হা’ ও ‘পু’। ‘হা’ অর্থাৎ হা-অন্ন, বা হাহাকার ও ‘পু’ শব্দের অর্থ পূরণ। মানে প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে বঞ্চিত মানুষ গান গেয়ে নিজেদের হাহাকার পূরণ করতে চাইতো। অর্থাৎ সব হারানো মানুষদের হাহাকারই হাপু। মুখে শব্দ-সহ পিঠে লাঠির আঘাত করে এই গান করা হয়। এই গান গাওয়ার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। হাপু গানের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ড: আশুতোষ বলেছেন – সাধারণত দুইজন লোক একসঙ্গে এই গান গাহিয়া থাকে। একজনের হাতে মদিরা বা গোপীযন্ত্র থাকে, আর একজনের হাতে ছোট একখানি লাঠি। লাঠিধারী লোকটি গান গায় এবং তাহার সঙ্গী লোকটি ধুয়া ধরে। গাহিবার পদ্ধতিটি একটু অদ্ভুত। এক পদ করিয়া গান গায়, আর মুখে একপ্রকার শব্দ করিয়া নিজের পিঠেই লাঠি দিয়ে তাল ভাজে। অবিশ্রাম লাঠি চালনার ফলে এনেকের পিঠের কালশিরা দাগ পড়িয়া যায়। কতকটা নমস্কারের ভঙ্গিতে লাঠিটাই হাত দিয়া ধরিয়া থাকে। যা স্থানীয় অঞ্চলে হাপু খেলা নামে পরিচিত।

বীরভূমে হাপু গান গানের একটি অনুষ্ঠান

আমরা জেনে নেই কোন সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই হাপু গান গাইতো —— সাধারনত বাজিকর, মাল, বাইতি, কাকমারা, বেদে, পটুয়া সম্প্রদায় এই গান গাইতো। দেশিয় রোগের নানান দেশজ ওষুধের –স্থানীয় ভাষায় টোটকার খনি ছিলো তারা, রোগ থেকে বাঁচবার নানান টোটকাও তারা বলতো নিজেদের গানে। হাপু গানের সঙ্গে নাচ দেখিয়ে তারা বাড়ির ভিতরে তাদের ওষুধের – পত্র নিয়ে ঢুকে যেত। টেটকা ওষুধের সঙ্গে থাকত নানান ধরনের বিক্রির জিনিসপত্র। তারা বেদে নৌকা করে দেশে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতো। সময়ের সাথে সাথে হাপু গানেও লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া, বর্তমানের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনার প্রতিফলন মিলছে বর্তমান সময়ের হাপু গানে। দেশ, সমাজ ও মানুষের সমস্যা ও অবক্ষয়ের বিভিন্ন দিকও উঠে এসেছে এই হাপু গানে। আগে গান গাওয়ার সময় একটি লাঠি বাবহার করা হলেও বর্তমানে অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে ওই লোকগানেও এসেছে বৈচিত্র। এখন হাপু গান গাওয়ার সময় লাঠি ছাড়াও থাকছে ঢোল।

বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলাদেশের সঙ নামের বইয়ে বেদে গানের নানান উদাহরণ পাওয়া যায়। এই গানে তাল রাখতে ঘুঙুর, খঞ্জনি আর ডাবকি ব্যবহার করা হয়। দ্রুত উচ্চারনের জন্য গানের আগে মুখে এক ধরনের শ্বাস নেওয়ার ধরণটাই হাপু গানের নিজস্ব ধারা। তারা গান পরিবেশন করতো বগল বাজিয়ে হাত দিয়ে শরীরের নানান জায়গায় আঘাত করে, মুখে বিচিত্র শব্দ তুলে এবং নানারকম শারিরীক অঙ্গভঙ্গী করে। যদিও বিশেষজ্ঞরা হাপুকে মোটাদাগের, অশ্লীল গান বলে উল্লেখ করেছেন, তবুও বলা যায় হাপুর তুলনা হাপুই।  যারা গান ভালবাসেন জন্য জানিয়ে রাখি – হাপু গান শুনলে মনে হবে যেন পশ্চিমি দ্রুত উচ্চারণে গাওয়া গান।

কয়েকটা হাপুগানের নমুনা——-

(ক) জামাই এলো কামাই করে খেতে দিব কি? হাত বাড়িয়ে দাও গামছা মুড়কি বেধে দি। উড়কি ধানের মুড়কি দেব পাতে জল খেতে। জ্যোষ্টি মাসে ছাতা দেব রোদে পথে যেতে।

(খ) হাপু আতা পাতা লো, হাপু সর্ষে পাতা লো, হাপু আম খাবি জাম খাবি, তেঁতুল খাবি লো, তেঁতুল খেলে প্যাট গুলোবে ছেলে হবে না, হাপু কাকে খেলে লো, হাপু ক্যা ঝাড়ুনি লো, হাপু বেদের মাকে লো ই ডাঙাড়ে ঐ ডাঙাড়ে শালিক বস্যেছেঁ বেদের মাকে বিয়া করতে পাল্কী আস্যেছেঁ হা ফুঃ কদম ফুঃ বুঢ়াতে বুঢ়ীতে লড়াই লাগ্যেঁছে বুড়া কপালে বুঢ়ী পাদ্যেঁ দিয়েঁছে হা ফুঃ কদম ফুঃ – ইত্যাদি

অথবা

হাই লো বামুন দিদি বাগদি ঠাকুরঝি আমি কেলে গয়লার বেটার ঠিয়ে কখন হাঁস্যেছি- হাঁস্যেছি বেশ করেছি তর বাপের কী যখন ছিলাম ছ বছরের তখন উঠে নাই গা এখন আমি বছর তেরো হব ছেলের মা মাছ ধরতে গিলাম আমি কুঁয়ে লুদির কুলে দেখি এ্যাক মিনসে রসির লাগর ডাঁড়া ফেলছে চারে জলে নেমে জাল ছাঁকি আর মিনসে থাকে চেঁয়ে ভাল্ কেনা তুই ঢ্যামনা মিনসে থানা কেনা চেয়ে তাকে দেখে উচএ যাব নইক তেমন মেয়ে মাছ ধরছি চিংড়ি চাঁদা গচি মাগুর গাগর কার্তিক মাসে মাছের রসে বলবো কি বুন্ বলবো কিলো আমার প্যাট হয়েঁছে ডাগর খোসার দুম খোলাক দুম কাঁথা চাপা দিঁয়ে মারব ঘুম ।।