সত্যজিৎ রায়কে নতুন করে পরিচয় করানোর তো কোন দরকার নাই! তিনি যে কি ছিলেন সেটা আমরা সবাই জানি। আজ আমরা তার তরুন বয়সে প্রেম ও বিয়ের স্মৃতিতে একটু উঁকি দিবো।

জানবো মানিক আর মঙ্কুব প্রেম ও বিয়ের উপাখ্যান ———

তার স্ত্রী বিজয়া রায় ছিলেন তার পিসতুতো বোন আর বয়সে তিনি ছিলেন সত্যজিৎয়ের বড়, কাজেই বিয়ের ব্যাপারে এটা ছিলো অনেক বড় বাধা। তারপরও কিভাবে এই অসাধ্যটা সাধন হলো জানতে ইচ্ছা হয়না?

বিজয়া রায়

আত্মীয়তার কারনে তারা কলকাতায় একই বাড়িতে ছিলেন।তখন যুদ্ধ চলছিলো, মঙ্কু বেথুন স্কুলে চাকরি করেন, সন্ধ্যার পর মানিক আর মঙ্কু দুজনে একসাথে বসে রেডিওতে ক্ল্যাসিক্যাল ওয়েস্টার্ন মিউজিক শুনেন, এভাবেই তাদের প্রেমটা শুরু হয় । তারা ঠিক করলেন, সেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক, তারা কোনদিন বিয়ে করবেন না, কারন তাদের বিয়ে মানিকের মা ( মঙ্কুর মেজো পিসি) কোনদিনও মেনে নিবেন না।

মানিক অসাধারন শিস দিতে পারতেন, একবার কিছু শুনলেই অনায়াসে সেটা তুলে নিতে পারতেন। যখন বাইরে থেকে বাড়ি ফিরতেন, তিনি শিস দিতে দিতে সিঁড়ি দিয়ে উঠতেন, তখন তার চোখ দুটিও আনন্দে হেসে উঠতো।মঙ্কু তার সেই সেই শিসের অপেক্ষায় বসে থাকতেন।

এছাড়া পাশ্চাত্য ক্যাসিক্যাল মিউজিকেও মানিকের এর ছিলো অগাধ জ্ঞান। তিনি প্রথম নোট শুনেই বলে দিতে পারতেন কোন মিউজিক আর কে কম্পোজার।

১৯৪০ সালে মানিক বি এ পাশ করলেন। তাঁর মায়ের  মনে হয়েছিল যে চাকরি করার পক্ষে তার বয়সটা অনেক কম।তাই তিনি মানিককে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে পেইন্টিং এর উপর পড়াশোনা করার কথা বললেন।প্রথমে তিনি  আপত্তি করলেন ঠিকই কিন্তু পরে মায়ের কথা ফেলতে পারলেন না, শুনলেন বাবা সুকুমার রায়েরও নাকি এমন ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু ফাইন আর্ট শেখার আসলে কোন ইচ্ছা তার ছিলোনা।

তিনি বলতেন, দেশে বিদেশে এতো অসাধারন চিত্রশিল্পী আছেন যে, তাদের ছাড়িয়ে যাবার মতো শক্তি তার আছে বলে মনে করতেন না।

যেতে না চাওয়ার আরও একটা কারন ছিলো, মঙ্কুকে ছেড়ে দুরে যেতে হবে। এটা ছিলো তার জন্য খুব কষ্টের, শেষে মঙ্কুই তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সেখানে পাঠান।

তিনি শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় পড়েন এবং সেখানে গিয়ে তিনি ভারতীয় শিল্পের প্রতি গভীর ভালোবাসা খুঁজে পান।

শান্তিনিকেতনে আড়াই বছর থাকার পর,তিনি উপার্জন করার তাগিদে সেখান থেকে চলে আসেন।

বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ খুঁজছিলেন, পেয়েও গেলেন।তখনকার দিনে বিখ্যাত বিজ্ঞাপন সংস্থা ছিলো ডি, দে, কিমার আ্যান্ড কোং। সেখানকার ডি, কে, গুপ্ত ছিলেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আর ডিরেক্টর ছিলেন মিষ্টার ব্রুম। কাজে ঢুকলেন পঁচাত্তর টাকার মাইনেতে, পরে অবশ্য কাজে উন্নতির সাথে সাথে মাইনাও বাড়লো।

বাড়িভর্তি লোক, দিনের বেলা দুজনের মন খুলে কথা বলায় উপায় নাই। এরমধ্যেই মানিক মঙ্কুর সাথে কথা বলার উপায় বের করলেন, সে এক অভিনব পন্থা! গ্রীক অক্ষর ব্যাবহার করে দুজন দুজনাকে বার্তা পাঠাতেন। খবরের কাগজের মাথার উপর খালি জায়গায় লিখে প্রেমিকার কাছে চালান দিতেন, প্রেমিকাও সেইভাবে উত্তর দিতেন।এই সাংকেতিক উপায়টা দুজনেই বেশ উপভোগ করতেন।

বিজয়া রায় এবং সত্যজিৎ-রায়

দুজনে একসাথে হলিউডের ছবি দেখতে যেতেন, বাড়ি থেকে কোন বাধা আসতোনা।

সে সময় মঙ্কুর বিয়ের সম্বন্ধও আসতে থাকে,এটা নিয়ে তারা দুজন বেশ হাসাহাসিও করতেন।

মঙ্কু যখন বম্বেতে তার মেজদির বাড়িতে গেলেন, সে সময় তার মেজদি তার জন্য একটি সম্বন্ধ আনেন, তার নাম বলাই এবং যিনি বিলেত থেকে কেমিষ্ট্রির ডিগ্রি এনে বম্বের বুটস্ কোম্পানির বড়সাহেব ছিলেন,মাইনেও ছিলো খুব লোভনীয়। মেজদি মানিক আর মঙ্কুর ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। নিরুপায় মঙ্কু বলাইকে তার আর মানিকের ব্যাপারে সবকিছু খুলে বললেন, তিনি বুদ্ধিমান মানুষ সবকিছু বুঝে গেলেন।

মানিক আর মঙ্কুর মধ্যে শর্ত ছিলো, তারা প্রতিদিন দুজন দুজনাকে চিঠি লিখবেন।

ঠিক হলো বলাইয়ের মধ্যস্থতায় তারা চিঠি আদান প্রদান করবেন।

মানিক চিঠি দিবেন বলাইয়ের অফিসের ঠিকানায়, মঙ্কু সেটা সংগ্রহ করে, তার প্রতিউত্তর দিবেন বলাইকে পোষ্ট করার জন্য, কিন্তু মেজদি যেন না জানেন। বলাইবাবু রাজি হয়ে গেলেন।

মঙ্কু ঠিক করলেন রোজগারের জন্য তিনি বম্বের সিনেমায় অভিনয় করবেন, মানিক প্রথমে আপত্তি জানান কিন্তু পরে মত দেন।

প্রথমটা ‘জনতা’ ও পরে ‘রেনুকা’ ছবিতে তিনি অভিনয় করেন।

পরে পশুপতি চট্টাপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের ‘ শেষরক্ষা’ ছবির স্যুটিং চলাকালীন মনি ঘোষের ‘ সন্ধ্যা’ ছবিতে সাইন করলেন।

কিন্তু তার দুর্ভাগ্য ছবি দুটি ফ্লপ করে।

তারপর তিনি আর কোন ছবি করেন নি।

মানিক একদিন তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, তিনি আর্ট ডিরেক্টর হিসাবে যথেষ্ট ভালো রোজগার করছেন, কাজেই তিনিই প্রতিমাসে টাকা পাঠাতে পারবেন যাতে তাদের কোন অসুবিধা না হয়।

মঙ্কু রাজি হলেন না। বললেন, ‘আমাদের কোন দিনও বিয়ে হবেনা, আর সারাজীবন তুমি আমাকে সাপোর্ট করে যাবে? ভবিষ্যতে যদি তুমি অন্য কারো প্রেমে পড়ো?’

মানিক বললেন, ‘তুমি ভালো করেই জানো যে, তোমাকে ছাড়া আমি আর কাউকে কোনদিনই বিয়ে করবোনা, তাতে করে যদি বিয়ে না হয় তো হবেনা’।

‘তুমি তোমার মায়ের একমাত্র সন্তান, তুমি বিয়ে না করলে উনি কত কষ্ট পাবেন, সেটা ভেবে দেখেছো’?

‘ ভেবেছি, যে ভাবেই হোক তাকে রাজি করাতেই হবে, দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে’।

মানিকের এই এক গুন ছিলো, চরম দুঃসময় এবং আকাশচুম্বী দুর্দশায় কখনও মাথা নোয়ান নি, আর কেমন করে যেন সব ঠিকও  হয়ে যেত।

একদিন তিনি মঙ্কুকে বললেন,

‘চলো তোমার জন্য একটা এনগেজমেন্ট রিং কিনে আনি’।

দুজনে মিলে এমন একটা দোকানে গেলেন, যেখানে কমদামি থেকে বেশি দামের গয়না পাওয়া যায়।

মঙ্কু একটি সোনার জল করা রূপার আংটি পছন্দ করলে তিনি অবাক হয়ে বলেন, ‘ সেকি হিরে রুবি ছেড়ে কিনা শেষ কালে সোনার জল করা রূপার আংটি?

মঙ্কু বললেন, আমার এটাই পছন্দ হয়েছে’।এরপর তিনি সেটা বিজয়ার আঙ্গুলে পরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ এবার যদি টাকা পাঠাই নিতে আপত্তি করবেনা তো’ ?

এই খবর জেনে মঙ্কুর বাড়ির সবাই খুব খুশি হলো শুধু তার মা ছাড়া। কারনটা হচ্ছে মানিকের মা যে এতে কষ্ট পাবেন তাতে তার কোন সন্দেহ ছিলোনা।

উনিশশো আটচল্লিশ সালের বিশে অক্টোবর বম্বেতে তাদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশন হলো। সেদিন পৃথ্বিরাজ কাপুর তাদের আশির্বাদ করতে এসেছিলেন।

তারা কখনো চিন্তাই করেননি যে,তারা বিয়ে করতে পারবেন! তবে বিয়েটা গোপন রাখতে হবে কারন মানিকের সাহস ছিলোনা কথাটা মায়ের কাছে বলার।

নসুবাবু মানিকের মায়ের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন, কাজেই তাদের বিয়ের ব্যাপারে তাকে কাজে লাগানোর কথাটা মানিকের মাথায় এলো। তিনিই শেষ পর্যন্ত বিয়ের ব্যাপারে মানিকের মাকে রাজি করালেন।

ছেলে যখন আর কাউকে বিয়ে করবেনা তখন তিনি অনেক ভেবেচিন্তে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিয়েতে মত দিলেন।

মানিক মঙ্কুকে বম্বেতে চিঠি দিয়ে মায়ের রাজি হওয়ার কথা জানিয়ে আরও জানালেন যে, ওরা বেশ বড় একটা নতুন ফ্ল্যাট পেয়েছেন। মঙ্কু ভাবলো, চুলোয় যাক ফ্ল্যাট মা রাজি হয়েছেন এটাই বড় প্রাপ্তি।

যেখানে বিয়ে হবার কোন সম্ভাবনাই ছিলোনা, সেখানে তাদের দুবার বিয়ে হলো।১৯৪৯ সালের তেসরা মার্চ ব্রাহ্মমতে আবার ঘটা করে বিয়ে হলো।

মানিকের মা তার ছেলের বউকে দিলেন অজস্র শাড়ি-ব্লাউজ, তার গয়নার বাক্স—- যার মধ্যে আছে, সীতাহার, মফচেন, রুবি- মুক্তার নেকলেস, তার সাথে ম্যাচিং রুবি- মুক্তার চুড়ি ও ব্রেসলেট, একজোড়া হিরের কানের দুল, বালা আরও অনেক কিছু।

প্রত্যেকটি আত্মীয় স্বজন বিয়েটাকে খুব ভালোভাবে মেনে নিলো। তাদের ভালোবাসা পরিনতি যে এতো সুন্দর হবে সেটা তারা ভাবতেও পারেনি।

 

#তথ্য_# আমাদের_কথা

#লেখক_#বিজয়া_রায়।