একরকম আচমকাই মেসোপটেমিয়ার উর অঞ্চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন বিখ্যাত থ্রিলার ঔপন্যাসিক আঁগাথা ক্রিস্টি। যাওয়ার কথা ছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মূলত স্বামী আর্চিবল্ড ক্রিস্টির সঙ্গে বারো বছরের দীর্ঘ সম্পর্কের পরিসমাপ্তির শোক কাটিয়ে ওঠা সহজ হচ্ছিলো না বলেই একটু ভ্রমণে বেরুতে চাচ্ছিলেন তিনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঝড় যেনো আঁগাথার জীবনকেও কিছুটা এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। সব ঠিকঠাক। রওনা হবার দুই দিন আগেই বন্ধুর বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে এক দম্পতির কাছে মধ্যপ্রাচ্যের রোমাঞ্চকর গল্পগুলো শুনে হুট করেই পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনলেন তিনি। ভেবে ফেললেন, ইরাকের বাগদাদে যাবেন। বাগদাদে অল্প কিছু দিন থেকেই সুমেরীয় রাজাদের বিখ্যাত রাজধানী উরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন আঁগাথা ক্রিস্টি।
‘কুইন অফ ক্রাইম’-খ্যাত আঁগাথার মস্তিষ্কে উপন্যাসের প্লট তৈরী হতো যখন-তখন। একইভাবে তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘মার্ডার ইন মেসোপটেমিয়া’ এবং ‘ডেথ অন দ্য নাইল’ এর প্লটও হঠাৎ করেই তৈরী হয়ে গেলো উর অঞ্চলের ট্যুরের পর।
উরের ট্যুরটি আঁগাথার জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কারণ এখানেই তার পরিচয় হয় প্রত্নতত্ত্ববিদ ম্যাক্স ম্যালোওয়ানের সাথে, যাকে দ্বিতীয় বার জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন আঁগাথা। সেই সাথে উরের প্রত্নতাত্ত্বিক খননে মিলেছে চমৎকার সব রাজকীয় সমাধি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাণী পুয়াবীর সমাধি।
রাণী পুয়াবীর সমাধির কথা উঠলে লিওনার্ড উলি এবং তার স্ত্রী ক্যাথরিন উলির কথা তো বলতেই হয়। আসলে উলি দম্পতিরও ভূমিকা রয়েছে আঁগাথার জীবনে। প্রথম বার উরে যাবার পরই আঁগাথার দেখা হয় উলিদের সঙ্গে। রাণী পুয়াবীসহ বহু সুমেরীয় রাজকীয় সমাধিস্থল আবিষ্কার তাদেরই কৃতিত্ব। প্রিয় লেখিকাকে সামনে পেয়ে তারাও ছিলেন বেশ আনন্দিত। তখন থেকেই গড়ে ওঠে উলি দম্পতির সঙ্গে আঁগাথার ঘনিষ্ঠতা। আর সেই ঘনিষ্ঠতার সুবাদেই ১৯৩০ সালে দ্বিতীয় বার উর ভ্রমণে গিয়ে তার পরিচয় হয় ম্যাক্স ম্যালোওয়ানের সাথে। লিওনার্ড উলিরই সহকারী ছিলেন ম্যাক্স ম্যালোওয়ান। ধীরে ধীরে সেই পরিচয় গভীর বন্ধুত্বে রূপ নেয়। অবশেষে নিজের চেয়ে তেরো বছরের জুনিয়র ম্যাক্স ম্যালোওয়ানকে বিয়ে করেন আঁগাথা ক্রিস্টি।
ম্যাক্স ম্যালোওয়ান প্রথমে লিওনার্ড উলির সহকারী হিসেবে কাজ করলেও পরবর্তীতে নিজস্ব প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ শুরু করেন। এদিকে আঁগাথাও একের পর এক বিখ্যাত উপন্যাস লিখে এগিয়ে যাচ্ছিলেন পুরোদমে। উরের পরে স্বামী ম্যাক্স ম্যালোওয়ানের সাথে অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক খননে তিনি অংশ নিয়েছেন। আর প্রতিবারই তিনি পেয়েছেন নিজের উপন্যাসের অপ্রতিম প্লট।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য আরোপিত বিরতি বাদে বাকি সময় সিরিয়া ও ইরাকের বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘ সময় অভিযান চালিয়েছেন ম্যাক্স ম্যালোওয়ান এবং আঁগাথা ক্রিস্টি। আঁগাথা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ ও ফটোগ্রাফির মাধ্যমে সব সময় স্বামীর পাশে থেকেছেন। কিন্তু এতে তার লেখালেখিতে বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটে নি, বরং এক্সপেডিশন হাউজে বসেই তিনি লিখে ফেলেছেন বহু উপন্যাস। ডোরা কোলিংউডের একটি পেইন্টিং দেখেই বোঝা যায়, পুরাতত্ত্ব দিয়ে ভর্তি কক্ষের ভেতর কিভাবে লেখিকা এক মনে লিখে যাচ্ছেন মার্ডার মিস্ট্রিগুলো।
১৯৩২ সালের দিকে আঁগাথাকে ইরাকের অ্যাসিরীয় শহর নিমরূদে নিয়ে গিয়েছিলেন ম্যালোওয়ান। নিমরূদের অভিযান তাদের কাছে স্বপ্নের মতো ছিলো। ম্যালোওয়ান বিশ্বাস করতেন, নিমরূদ উরের মতোই গুরুত্বপূর্ণ এবং মিশররের তুতেনখামেনের মতোই সমৃদ্ধ একটি জায়গা। শেষ পর্যন্ত নিমরূদ ভ্রমণের আশা পূরণ হয়েছিলো আঁগাথা এবং ম্যালোওয়ানের। ম্যালোওয়ান তখন ব্রিটিশ স্কুল অফ আর্কিওলজির প্রথম পরিচালক নিযুক্ত হয়েছেন এবং নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্ট থেকে খননকাজের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
১৯৫০ এর দশকে দীর্ঘ দশ বছরের জন্য নিমরূদ হয়ে ওঠে আঁগাথা ও ম্যালোওয়ানের দ্বিতীয় বাড়ি। আঁগাথা ক্রিস্টি ততো দিনে ৪৫টি রহস্য উপন্যাসের একজন বিখ্যাত লেখিকা। লেখালেখির জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের সামগ্রী সম্বলিত বিশেষ ঘরটিতে বেশ সহজেই কলম চালিয়ে গেছেন তিনি।
নিমরূদের গুরুত্ব নিয়ে ম্যাক্স ম্যালোয়ানের ধারণাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়। নিমরূদের খননে পাওয়া পুরাতত্ত্বগুলো দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। এই নিমরূদেই মিলেছে অনন্তকালের প্রতীক হাতির দাঁতের কারুকাজ করা পদ্মফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবকের অবয়ব এবং একটি হাতির দাঁতের মুখোশ, যা ‘মোনালিসা অফ নিমরূদ’ নামে পরিচিত।
নিমরূদে মেলা প্রতিটি পুরাতত্ত্ব আঁগাথা নিজেই ভীষণ যত্নসহকারে পরিষ্কার করতেন এবং সাজিয়ে রাখতেন। বিখ্যাত এই রহস্য ঔপন্যাসিকের জীবনের গল্পগুলোও কোনো উপন্যাসের চেয়ে কম নয়। সর্বাধিক বই বিক্রির রেকর্ড গড়ে তোলা এই লেখিকা ১৯৭৬ সালের ১২ জানুয়ারি ইংল্যান্ডে নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন।
রেফারেন্স: