ঘড়িঘরটা বার্ন শহরের ঠিক মাঝখানে, সামনে পাথরে বাঁধানো খোলা জায়গায় প্রতি বিকেলেই অনেক মানুষের অলস আলাপ জমে উঠে। বসন্তের দিনগুলোতে এই শহরটাকে অ্যালবার্টের বেশ লাগে। তিন বছর আগে প্রথম যখন এ শহরে এসেছিলেন তখন তার না ছিল চাকরি, না ছিল কোনো বন্ধু। ঘণ্টায় তিন ফ্রাঙ্ক পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ছাত্র পড়ানোর এক বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন স্থানীয় পত্রিকায়।
জাইগ্লগ ঘড়িঘরের ঘণ্টার শব্দ শোনা যাচ্ছে। পাঁচটা বেজে গেছে। সরকারী পেটেন্ট অফিসের কর্মীরা কাজ গুছাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন; আজকের মতন অফিস শেষ। অ্যালবার্টের ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালেন বন্ধু মিশেল বেসো। দুই বন্ধু এই সময়টার জন্যেই যেনো সারাদিন অপেক্ষা করে। এখনি জমে উঠবে সারাদিনের জমানো সব গল্প। বেসো অ্যালবার্টের পুরাতন বন্ধু। সেই কবে, জুরিখে, এক শনিবার সন্ধ্যায় কাপ্রোতি পরিবারের গানের আসরে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। তখন অ্যালবার্টের বয়স মাত্র ১৬ বছর। ফেডেরাল পলিটেকনিকে ভর্তির স্বপ্ন তার চোখে। বয়সে ৬ বছরের বড় বেসো ততদিনে সেই প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে বেরিয়ে গেছেন। কিশোর অ্যালবার্টের বেহালা বাদনে মুগ্ধ বেসো; সেদিন থেকেই তাদের সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। তাদের দীর্ঘ আলাপ শুধু সঙ্গীতে সীমিত থাকেনি, দুই বন্ধু মিলে ডুব দিয়েছেন বিজ্ঞানের সব শাখায়। তাদের সে আলাপে নিউটন থেকে হাইগেন্স কেউ বাদ যাননি। জুরিখ ছেড়ে চলে আসার পর অবশ্য যোগাযোগে সাময়িক ভাটা পড়েছিল। তবে বছরখানেক আগে নিজ অফিসে পেটেন্ট অফিসারের একটা পদ ফাঁকা হতেই অ্যালবার্ট খবর দেন বেসোকে। বেসো আসায় বার্ন শহরে অ্যালবার্টের জীবন যেনো পূর্ণতা পায়।
এক পা দুই পা করে দুই বন্ধু যখন জাইগ্লগের সামনে পৌঁছুলেন তখন দিনের শেষ আলোটুকু বড় ঘড়ির সোনালী কাঁটার উপর এসে পড়েছে। এই ঘড়িঘরটা বার্ন শহরের ঠিক মাঝখানে, সামনে পাথরে বাঁধানো খোলা জায়গায় প্রতি বিকেলেই অনেক মানুষের অলস আলাপ জমে উঠে। বসন্তের দিনগুলোতে এই শহরটাকে অ্যালবার্টের বেশ লাগে। তিন বছর আগে প্রথম যখন এ শহরে এসেছিলেন তখন তার না ছিল চাকরি, না ছিল কোনো বন্ধু। ঘণ্টায় তিন ফ্রাঙ্ক পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ছাত্র পড়ানোর এক বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন স্থানীয় পত্রিকায়। কিছুদিনের মধ্যেই মরিস সলোভিন নামে রুমানিয়ার এক ছাত্র পেয়েছিলেন, তার আগ্রহ পদার্থবিদ্যায়। এরপর পেলেন কনরাড হাবিস্ট নামে এক ছাত্র, তার ইচ্ছা উচ্চতর গণিত শেখার। কিন্তু এই তিনজনের ভেতরে অচিরেই এতো বন্ধুত্ব জমে গেলো যে কে শিক্ষক আর কে ছাত্র তা-ই বোঝা ভার। তিনজনের দেখা হতো কোনো ক্যাফেতে কিংবা অ্যালবার্টের বাড়িতে আর এরপর জমে উঠতো আলাপ। সেই আলাপ আর শেষ হতে চাইতো না। এই বার্ন শহরের পথে হেঁটেই কত রাত পেরিয়ে গেছে, কিন্তু তাদের গল্প শেষ হয়নি। বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, কত কী নিয়ে সেসব গল্প; সফোক্লিসের ‘আন্তিগোনে’ থেকে চার্লস ডিকেন্সের ‘ক্রিস্টমাস ক্যারল’ কিছুই বাদ যেতো না। নিজেদের নাম দিয়েছিলেন ‘একাডেমি অলিম্পিয়া’। বিয়ের আগে পর্যন্ত তিন বন্ধু ডিনারটাও একসাথেই করতেন- সসেজ, পনির, ফল আর চা। এসব করে পকেটে শেষতক তেমন কিছুই থাকতো না, এর চেয়ে রাস্তায় বেহালা বাজালেও কিছু টাকাকড়ি আসতো। তবে এসময়টা নিয়ে কোনো আফসোস নেই তার। এটা তার বড় প্রিয় সময়।
পেটেন্ট অফিসে যখন নিয়োগ পেলেন তখন বিদ্যুতের প্রাথমিক যুগ। বিদ্যুতের নানা উদ্ভাবনের দাবী নিয়ে একের পর এক নকশা জমা হচ্ছে পেটেন্ট অফিসে। কিন্তু বিদ্যুৎ নিয়ে পড়াশোনা জানা মানুষ অ্যালবার্ট একা। তাই অ্যালবার্টের কাজের চাপ ছিল অন্য অনেকের চেয়ে বেশী। পরিচালক হ্যালারের পরামর্শ ছিল যেকোনো দাবীকেই প্রথমে অসার ধরে নিতে হবে। এরপর বিজ্ঞান আর গণিতের নানা যুক্তিতত্ত্ব দিয়ে জমা দেয়া নকশার সত্যতা যাচাই করতে হবে। কাজটা অ্যালবার্টের জন্য খুব কঠিন কিছু ছিল না। দিনের প্রথম তিন ঘণ্টায় সে কাজ গুছিয়ে নিয়ে বাকি সময়টুকুতে দিব্যি নিজের পড়ালেখা আর গবেষণার কাজ সারা যেতো। তার দক্ষতায় হ্যালারও খুব খুশি। গত বছরটাও তার খুব ভালো কেটেছে। মে মাসে ছেলের বাবা হয়েছেন। চাকরিতে পদোন্নতি না মিললেও মিলেছে স্থায়ী পদ। বেতনও বেড়েছে চারশ ফ্রাঙ্ক। এসময় বন্ধু বেসোর উপস্থিতি জীবনকে করেছে আরো আনন্দময়। গত সপ্তাহে ক্রামগাস থেকে বদলে বাসা নিলেন বেসোর বাসার কাছে। নতুন সে বাসা শহর থেকে খানিকটা দূরে, যেতে হয় ট্রামে। তবে তাতে কোনো খেদ নেই তার। বেসোর সাথে জমিয়ে আলাপের সুযোগটা যে আরো দীর্ঘ হলো, এতেই অ্যালবার্ট খুশি।
অ্যালবার্ট পকেট থেকে ঘড়ি বের করলেন। গোলাপি ফ্রেমে রূপালি ডায়ালের এই ছোট্ট সুইস ঘড়িটা তার বড় শখের। চাকরিতে ঢুকেই কিছু টাকা জমিয়ে কিনেছিলেন জীবনের এই প্রথম ঘড়ি। প্রতিদিন তিনি এসময় জাইগ্লগের বড় ঘড়ির সাথে নিজের পকেট ঘড়ির সময় মিলিয়ে নেন। সময় ব্যাপারটাতেও তার ভীষণ আগ্রহ। কি অদ্ভুত এক বিষয় এই সময়। মুহূর্তেই বর্তমান হারিয়ে যাচ্ছে অতীতে, আর ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে বর্তমান। অতীত থেকে ভবিষ্যতের এই যাত্রায় সময় কি সবসময় একই বেগে চলেছে? কই, তা তো মনে হয় না! এই তো ক’বছর আগের কথা- মিলেভার সাথে জুরিখের দিনগুলিতে সময় কি দ্রুত বয়ে যেতো! ক্লাসের একমাত্র ছাত্রী মিলেভা, কথা বলে খুব কম কিন্তু মেধায় তুখোড়। তার সাথেই অ্যালবার্টের প্রেম জমে উঠলো। লেমেৎ নদীতে নৌকা নিয়ে বেড়াবার কালে কখন যে ঝপ করে সন্ধ্যা নেমে আসতো টেরই পেতেন না তারা। আবার এই সময়ই যেনো থেমে গিয়েছিল পলিটেকনিকের নোটিশ বোর্ডের সামনে। সেদিন পরীক্ষার ফল বেরিয়েছিল। অ্যালবার্টের নাম ছিল সবার শেষে, আর মিলেভা অকৃতকার্য। ইতিমধ্যে নিজের জার্মান নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিলেন অ্যালবার্ট। সুইজারল্যান্ডের জন্য আবেদন করেছিলেন, তখনও উত্তর পাননি। তার কোনো দেশ নেই, এই ফলাফল নিয়ে চাকরিরও কোনো আশা নেই। শুধু সময় কেনো, জীবনই যে থমকে গিয়েছিল সেদিন! সে হিসাব কি কোনো ঘড়ি রেখেছে? মনে কত কত প্রশ্ন জাগে অ্যালবার্টের, উত্তর পান না।
কফিতে চুমুক দিতে দিতে বেসো জিজ্ঞেস করলেন- “কী ভাবছো অ্যালবার্ট? বাজ পড়ার যে সমস্যাটা নিয়ে কথা বলছিলাম সেদিন, সেটার কোনো সমাধান মিললো?” অ্যালবার্ট যেনো অন্যমনস্ক ছিলেন। বেসোর কথায় সম্বিৎ ফিরলো। তিনি ঠিক এই বিষয়টা নিয়েই ভাবছিলেন। অদ্ভুত এক প্রশ্ন মাথায় এসেছে বন্ধু বেসোর- একটি রেলস্টেশনের দু’প্রান্তে দু’টা বাজ পড়ল। স্টেশনের ঠিক মাঝখানে প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির কাছে বাজ দু’টা যুগপৎ মনে হলেও সেই সময়ে স্টেশন অতিক্রমকারী রেলগাড়ির যাত্রীর কাছে তা মনে হয় না। অর্থাৎ বাজের আলো স্থির আর গতিশীল ব্যক্তির কাছে দুই সময়ে পৌঁছুচ্ছে। কিন্তু কেন? এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে?
অ্যালবার্ট বেসোর প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না। ট্রাম চলে এসেছে। বেসো উঠবার তাড়া দিলেন, দু’বন্ধু ট্রামে উঠে বসলেন। জাইগ্লগের বড় ঘড়িটাকে পেছনে ফেলে ট্রাম চলেছে আপটাউনের দিকে। অ্যালবার্ট অপলক তাকিয়ে আছেন জাইগ্লগের দিকে। হাতে তার পকেটঘড়ি। হঠাৎ তার মনে হলো, এই ট্রামটার গতি যদি এখন আলোর গতিতে পৌঁছে যায় তবে কেমন হবে? বড় ঘড়ির বাহুগুলোকে কি এখনের মতই ঘুরতে দেখা যাবে? কিন্তু তার হিসাব তো তা বলছে না; আলোর বেগে ছুটে চলা অ্যালবার্টের কাছে জাইগ্লগের সেই ঘড়ি তো থেমে যাবে! আর এদিকে তার সাথে থাকা পকেট ঘড়িটা, সেটারা কাটা কিন্তু ঠিক টিক টিক করে ঘুরে চলবে। এসবের মানে কি? অ্যালবার্টের বেসোর হাত চেপে ধরলেন। চমকে উঠে বেসো দেখলেন অ্যালবার্টের বাদামী চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে, তিনি শিহরিত, উত্তেজিত। অস্ফুট স্বরে অ্যালবার্ট বলে উঠলেন- “বুঝলে মিশেল, পরম সময় বলে কিছু নেই। সময়ের পুরো ব্যাপারটাই আপেক্ষিক, একদম আপেক্ষিক।”
টানা পাঁচ সপ্তাহ ধরে লিখে চললেন অ্যালবার্ট; লেখা শেষে স্ত্রী মিলেভাকে সূত্রগুলো দেখে দিতে বললেন। ক’দিন আগেই Annalen Der Physik নামে এক বিখ্যাত সাময়িকীতে তার আরো দু’টো নিবন্ধ ছাপানো হয়েছে। নতুন লেখাটাও তিনি সেখানেই জমা দিবেন ঠিক করলেন। সম্পাদকের দপ্তরে লেখা জমা দিয়ে বের হতেই অ্যালবার্ট খুব শ্রান্তবোধ করলেন। কঠিন শ্রম তিনি দিয়েছিলেন এই লেখার পেছনে, খাওয়াদাওয়া, ঘুম কোনো কিছুর কোনো ঠিক ছিল না। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। পূর্ণ সুস্থ হয়ে কাজে ফিরতে লেগে গেলো আরো দুই সপ্তাহ। ১৯০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৬ তারিখ প্রকাশিত হলো ৩১ পাতার সেই নিবন্ধ ‘On the Electrodynamics of Moving Bodies’। স্থান আর কালের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে জন্ম নিল এক নতুন তত্ত্ব, গোটা বিশ্ব যাকে চিনে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব নামে। নিবন্ধের শেষে বন্ধু বেসোর কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলেন এভাবে-“পরিশেষে উল্লেখ করতে চাই, এখানে আলোচিত প্রশ্নের ব্যাখ্যায় বন্ধু ও সহকর্মী এম বেসোর বিশ্বস্ত সহযোগিতার কথা। অনেক মূল্যবান পরামর্শের জন্য আমি তার কাছে ঋণী।”
এর ধারাবাহিকতায় সে বছরেরই নভেম্বরে প্রকাশিত হলো সেই সূত্র E=mc2 । বদলে গেলো মহাশূন্য, সময়, ভর, শক্তি নিয়ে বহু তত্ত্ব। এতোকাল চলে আসা ইথারের ধারণা সম্পূর্ণ রূপে অসার প্রমাণ করলেন মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সের যুবক অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। জন্ম নিলো আধুনিক পদার্থবিদ্যা।
চিরচেনা সময়ের জগতটাকে উলোটপালট করে দেয়া তত্ত্বের জন্ম হয়েছিল যে বার্ন শহরে, তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে জাইগ্লগ আজও বেজে চলেছে। শহরবাসীর হৃদস্পন্দন যেনো গিয়ে মিশেছে তার ঘণ্টাধ্বনির মাঝে। এতো গেলো বড় ঘড়িটার কথা। অ্যালবার্টের হাতে চেপে ধরা সেই পকেট ঘড়িটার বর্তমান অবস্থা কি? অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তার জীবদ্দশায় তিনটি ঘড়ি ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৩১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলস ভ্রমণকালে এক ভোজসভায় তিনি উপহার হিসেবে পান লঙ্গিন্স এর তৈরি চৌদ্দ ক্যারেট সোনায় মোড়ানো এক হাতঘড়ি। সেখানকার ইহুদি সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে দেয়া এই ঘড়ির পিছনে খোদাই করে আইনস্টাইনের নাম লেখা ছিল। ১৯৪৩ সালে তৈরি আরেকটি ঘড়ির সন্ধান পাওয়া যায় যা আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর পুত্র হান্স অ্যালবার্টের হস্তগত হয়। এটিও ছিল লঙ্গিন্স এর তৈরি, তবে হাতঘড়ি নয়, পকেট ঘড়ি। এই ঘড়িটি এখন বার্নের অ্যালবার্ট আইনস্টাইন জাদুঘরে প্রদর্শনীর জন্য রাখা আছে। কিন্তু আইনস্টাইনের প্রথম জীবনের পকেট ঘড়িটার কোনো খোঁজ দীর্ঘকাল ছিল না। অবশেষে ২০১৬ সালে এর সন্ধান মিলে ক্রিস্টির নিলামঘরে। বিক্রেতার ভাষ্যমতে আইনস্টাইন নিজেই তাকে এই ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন। কোনো এক অজানা ক্রেতা রেকর্ড দুই লক্ষ ছেষট্টি হাজার পাঁচশ’ পাউন্ডের বিনিময়ে কিনে নেন ৪৯ মিমি আকারের ছোট্ট সেই ঘড়িটা।
সহায়ক সূত্র-
- Subtle Is the Lord: The Science and the Life of Albert Einstein, Abraham Pais, Oxford University Press, 200
এই লেখা প্রথম প্রকাশ হয়: The Business Standard পত্রিকাতে