আব্বাসীদের রাজধানীকে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়ে মোঙ্গল নেতা হালাকু খান তখন হয়ে উঠছেন অপ্রতিরোধ্য। বাগদাদের মত একটা শহরকে নিষ্ঠুরতার সাথে দখল করে ভাই মেংগু খানের আস্থার প্রতিদান দিতে যেন কার্পণ্য করেননি চেংগিস খানের এই নাতি। পশ্চিমাঞ্চলে সামরিক অভিযানের অংশ হিসেবে গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়কে দমন করে যখন হালাকুর হাতে বাগদাদ অবনত হল তখন উত্তর আফ্রিকায় গুঞ্জন রটে গেল মোঙ্গল আক্রমণের। আর সেজন্য মিশরের মামলুক সাম্রাজ্যের দিকে স্বাভাবিকভাবেই দৃষ্টি পড়ে যায় বিশ্ব জয়ের স্বপ্নে বিভোর থাকা সমকালীন দুর্ধর্ষ এই তাতার জাতির। কেননা মিশর জয় করতে পারলেই উত্তর আফ্রিকা বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। উত্তর আফ্রিকার জিব্রাল্টার হয়ে স্পেনে প্রবেশ করতে পারলেই ইউরোপও চলে আসবে হাতের মুঠোয়। স্বপ্ন হবে সত্যি মোঙ্গলদের। বিশ্বজয়ের খেতাব পেতে তাই তড়িঘড়ি করে হালাকু খান মিশরের মামলুক দরবারে দূতসহ যে অপমান পত্র পাঠিয়েছিলেন তা আমরা পরে দেখব তার আগে মিশরের মামলুকদের অবস্থান দেখে নেয়া যাক।
মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করা আব্বাসী খিলাফতের সোনালি অতীত গত হয়েছে বেশ আগেই। ১২৫৮ সালে হালাকুর হাতে বাগদাদ পতনের পর নিভুনিভু মুসলিম অভিভাবকত্বের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় তখন মিশরের মামলুক সাম্রাজ্য। সিংহাসনে সাইফুদ্দিন কুতুজ। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত সমরবিদ। আমীর আইবেকের হত্যাকাণ্ডের পর তার নাবালক পুত্র আল মালিক আল মনসুর যখন মামলুক সিংহাসনে আরোহন করেন তখন কূটকৌশলের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসন নিশ্চিত করেন সাইফুদ্দিন কুতুজ। হালাকু খান সিরিয়া অভিযান শেষে যখন মিশরের দিকে দৃষ্টি দিলেন তখনই তার ফলাফল হিসেবে সাইফুদ্দিন কুতুজ এক অপমানজনক পত্র প্রাপ্ত হোন৷ একজন মোঙ্গল দূত যখন এই পত্র নিয়ে আসে সাইফুদ্দিন কুতুজের মাথায় তখন আগুনের ফুলকি খেলা করছে। মরো নয় আত্মসমর্পণ করো স্বভাবমোঙ্গল এমন দাবিতে পত্রে যা লেখা ছিল তার চুম্বক অংশ এখানে দেয়া হল,
পূর্ব ও পশ্চিমের অবিসংবাদি শাহেনশাহ মহান খানের পক্ষ হতে মামলুক রাজ কুতুজের উদ্দেশ্যে,
“যিনি আমাদের তলোয়ার এর ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। অন্যান্য রাজ্যসমূহের পরিণতি কী হয়েছে তা অনুধাবন করে আপনার উচিত আমাদের কাছে নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করা। আপনি নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন কিভাবে আমরা একটি বিশাল সাম্রাজ্য জয় করেছি এবং পৃথিবীকে দূষিত বিশৃঙ্খলা থেকে বিশুদ্ধ করেছি। আমরা বিশাল অঞ্চল জয় করেছি, সব মানুষকে হত্যা করেছি। আপনি আমাদের সেনাদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাঁচতে পারবেন না। আপনি কোথায় পালাবেন?পালানোর জন্য আপনি কোন পথ বেছে নিবেন? আমাদের ঘোড়াগুলি দ্রুতগামী, আমাদের তীরের ফণা ধারালো, আমাদের তলোয়ার বজ্রের মত, আমাদের হৃদয় পর্বতের মত , আমাদের সেনারা বালুকারাশির মত অগণিত। দুর্গ আমাদের রুখতে পারবে না, কোনো সেনাবাহিনী আমাদের থামাতে পারবে না। আপনাদের আল্লাহর কাছে দোয়া আমাদের বিরুদ্ধে কাজে আসবে না। অশ্রু আমাদের চালিত করে না এবং মাতম আমাদের ছোঁয় না। শুধুমাত্র যারা আমাদের সুরক্ষা চাইবে তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া হবে। যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠার আগে অতিদ্রুত আপনার জবাব দিন। প্রতিরোধ করলে আপনি সবচেয়ে ভয়ংকর বিপদের মুখোমুখি হবেন। আমরা আপনাদের মসজিদগুলি ভেঙে দিব এবং আপনাদের আল্লাহর অসহায়ত্ব দেখতে পাবেন এবং তারপর আপনাদের সন্তান ও বৃদ্ধদেরকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হবে। এই মুহূর্তে আপনি একমাত্র শত্রু যার বিরুদ্ধে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি”।
পত্র পাঠ করে সাইফুদ্দিন কুতুজ মোঙ্গল সেই দূতকে হত্যা করে তার কাটা মাথা কায়রোর ফটকে ঝুলিয়ে রাখেন। পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার জন্য আর অপেক্ষা করতে হয়নি। দু পক্ষই প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার সব প্রস্তুতি যখন সমাপ্ত তখনই হালাকু খানের ভাই মেংগু খান মারা গেলে মোঙ্গল বাহিনী তার সংখ্যাগরিষ্ঠ সৈন্য নিয়ে রাজধানী কারাকোরামে মহান খানের শেষকৃত্যে যোগ দিতে চলে যায়। কেতবুঘাকে সেনাপতি বানিয়ে মামলুকদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিয়ে যান হালাকু খান। ওদিকে সিরিয়া থেকে মামলুকদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য রুকুনুদ্দিন বাইবার্স পাড়ি জমালে সাইফুদ্দিন কুতুজের মনোবল আরো বেড়ে যায়। কুতুজ বুঝতে পেরেছিলেন মোঙ্গলদের নিকট আত্মসমর্পণ করা মানেই নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। তারচেয়ে প্রতিরোধকেই তিনি বেছে নেন। আর এ কাজে কোনরূপ বিলম্ব না করে লক্ষাধিক সৈন্য যোগাড় করতে তিনি সমর্থ হোন। ফিলিস্তিনের তাবারিয়ার আইন জালুতের প্রান্তরে মামলুক সুলতান তার শিবির স্থাপন করেন। এই আইন জালুতেই সংঘটিত হয়েছিল ওল্ড টেস্টামেন্টের ডেভিড ও গোলিয়াথের যুদ্ধ।
মুখোমুখি মোঙ্গল-মামলুক শক্তি
১২৬০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আইন জালুতের ঐতিহাসিক প্রান্তরে সমকালীন পৃথিবীর দুর্ধর্ষ যোদ্ধার দল মোঙ্গল বাহিনীর সাথে চূড়ান্তভাবে মুখোমুখি হোন মিশরের গর্বিত মামলুক সাম্রাজ্যের সুলতান সাইফুদ্দিন কুতুজ। কুতুজ জানতেন খোলা প্রান্তরে মোঙ্গলরা কত ভয়াবহ হতে পারে। তাই তিনি কৌশলী হন। অল্পসংখ্যক সৈন্য মূল প্রান্তরে রেখে বাকি সৈন্য যাদের বেশিরভাগই ছিল মামলুক তীরন্দাজ তাদের পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে লুকিয়ে রাখা হয়। আর অবশিষ্ট সৈন্যদের বাইবার্সের নেতৃত্বে মূল যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়। সাইফুদ্দিন কুতুজ তখন নিরাপদ দূরত্বে থেকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। যথাসময়ে যুদ্ধ শুরু হলে প্রথমেই মামলুকদের তৈরি ফাঁদে পড়ে যায় মোঙ্গলরা। বাইবার্স যখন মোঙ্গলদের উপর আক্রমণ করেন তার অল্প কিছুক্ষণ পরেই তার সৈন্যদের নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ভান করেন। মোঙ্গল সেনাপতি কেতবুঘা মামলুকদের পালাতে দেখে ধাওয়া করেন। মুহূর্তের মধ্যেই পাহাড়ের আড়াল থেকে মামলুক তীরন্দাজ বাহিনী মোঙ্গলদের চতুর্দিক হতে অবরোধ করে ফেলে। চেংগিস খানের গড়া এই ভুবন কাঁপানো বাহিনী এই প্রথমবারের মত কোন যুদ্ধে দিশেহারা হয়ে পড়ে। কেতবুঘা বাম অংশ দিয়ে মামলুক ব্যূহ ভেদ করতে যাবেন এমন সময় সুলতান সাইফুদ্দিন কুতুজ তার মুখোশ খুলে তার বাহিনী নিয়ে মোঙ্গলদের উপর চড়াও হোন। নিজ সুলতানকে দেখে মামলুক সৈন্যরা দ্বিগুণ নিপুণতায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। কুতুজ ও বাইবার্সের অনবরত আক্রমণে মোঙ্গল বাহিনী পিছু হটে ফের আগায় আবার পিছু হটে এমন লুকোচুরি খেলতে থাকে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মোঙ্গল সেনাপতি কেতবুঘা নিহত হলে আরমেনিয়ান, চীনা, তাতার সৈন্যদের সমন্বয়ে গড়া প্রায় অপরাজেয় মোঙ্গল বাহিনী চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়।
সুলতান সাইফুদ্দিন কুতুজ এবং রুকুনুদ্দিন বাইবার্সের অসাধারণ রণনৈপুণ্যে মোঙ্গলদের বিশ্বজয়ের আকাঙ্ক্ষার সলিলে সমাধি দেয়া হয়। আইন জালুতের যুদ্ধে মোঙ্গলরা যদি বিজয়ী হত তবে পৃথিবীর ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতে পারত। উত্তর আফ্রিকা হয়ে ইউরোপের ভাগ্যে হয়তো চিরায়ত মোঙ্গল বর্বরতাই লেখা থাকত। নিজেদের অপরাজেয় ভাবতে থাকা এই তাতার গোষ্ঠীর জন্য এই যুদ্ধ ছিল একটা শিক্ষা, তাদের অহংকারের মর্মমূলে আঘাত করে মিশরীয় মামলুকরা ইতিহাসের গতিপথ পালটে দিয়েছিল।
তথ্যসূত্র
মধ্যযুগের মুসলিম ইতিহাস- আশরাফউদ্দিন আহমদ