স্পেনে ইসলামি সাম্রাজ্য উমাইয়া আমিরাত মুসলমানদের ইতিহাসে একটি স্বর্ণখচিত অধ্যায়। আব্বাসীদের তাড়া খেয়ে যাযাবরের মত এদেশ ওদেশ ঘুরে স্পেনে গিয়ে উমাইয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কুরাইশদের বাজপাখি আবদুর রহমান। যেই সাম্রাজ্য টিকেছিল প্রায় ৭০০ বছর। উমাইয়া আমিরাত প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে ইউরোপে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করে মৃত্যু হয় আবদুর রহমানের। তার পুত্র দ্বিতীয় আব্দুর রহমান আসেন এবার স্পেনের মসনদে। তবে তিনি এসে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন। স্পেনের খ্রিস্টানদের একটা অংশ ইসলামি শাসন অবসানের উদ্দেশ্যে একটি আন্দোলনের সূচনা করে। যদিও রাষ্ট্রে খ্রিস্টানরা সবধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা পাচ্ছিল তারপরও খ্রিস্টান জাতীয়তাবোধ থেকে তারা মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনে উদারমনা খ্রিস্টানরা অংশ না নিলেও গোঁড়া খ্রিস্টানরা আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। ইতিহাসে এই অস্থিরতা পরিচিত ধর্মান্ধ আন্দোলন নামে।

স্পেনে খলিফা হিশাম একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসেন। তার শাসনে ধর্মকে কেন্দ্র করে কোন সাম্প্রদায়িকতার উত্থান ঘটেনি। বরং খ্রিস্টানরা রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে বেশ সুযোগ সুবিধা ভোগ করতো। তার অন্যান্য উদার নীতি স্পেনের অনেক খ্রিস্টানকে প্রভাবিত করে। তাদের মধ্যে অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং অনেকেই নতুন এই ধর্মটির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে একটা অংশ সরাসরি আরব জীবনাচরণ অনুসরণ করতে থাকে। এদেরকে বলা হতো মোজারব। স্পেনের বড় শহরগুলোতে এই মোজারবের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই পরিবর্তন ভালভাবে নেয়নি দেশটির গোঁড়া খ্রিস্টানরা। মুসলিম শাসন অবসানকল্পে তারা এবার যুগপৎ আন্দোলনের সূচনা করে।

রাজা ফারদিনান্দ ও রানী ইসবালার স্পেনে

গ্রানাডার পতন, Image source: Wikimedia

কেন সংঘটিত হয়েছিল ধর্মান্ধ আন্দোলন?

আগেই বলা হয়েছে স্পেনের খ্রিস্টানদের একটা অংশের ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনা ও ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার এই ব্যাপারটির কারণেই মূলত ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানদের মধ্যে শংকা দেখা দেয়। তারা মনে করতে লাগল অচিরেই স্পেন থেকে খ্রিস্ট ধর্মের প্রাধান্য বিলুপ্ত হবে৷ এছাড়া উমাইয়া আমিরাতি শাসনে প্রত্যক্ষ্য প্রভাবে স্পেনে আরবীকরণ অব্যাহত ছিল। এটিও সেখানকার খ্রিস্টানদের চিন্তায় ফেলে দেয়। এই আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে খ্রিস্টান নেতারা ঘোষণা দেয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে যদি কোন খ্রিস্টান মৃত্যুবরণ করে তবে সে সরাসরি স্বর্গে চলে যাবে। ফলে আন্দোলনে অনেক সাধারণ ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানরা যোগ দেয়। এছাড়া আরব শাসনে সেখানকার খ্রিস্ট ধর্মযাজকদের স্বার্থেও বড় আঘাত হানে। তাই তারা খ্রিস্টানদের আরব শাসনের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলে।

খ্রিস্টানরা এত সহজে একটি আন্দোলন পরিচালনা করার পেছনে আরব শাসকদের নমনীয়তাও ছিল আরেকটি কারণ। ভিন্ন একটি দেশে উপনিবেশ কায়েম স্বাভাবিকভাবেই ঐ দেশটির জনগণ মেনে নিতে চাইবে না। ঔপনিবেশিক রীতি অনুসারে তাই শাসকগণ সেই উপনিবেশে জনগণ ও তাদের স্বাধীনতাকে সাধারণত রূদ্ধ করে থাকে। কিন্তু আরবদের মধ্যে এমন প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়নি। তাদের এই শাসনতান্ত্রিক দুর্বলতার সুযোগ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।

গ্রানাডার ম্যাপ

গ্রানাডা আমিরাত Image source : Wikipedia

ধর্মান্ধ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন সেন্ট জুলিয়াস গির্জার যাজক ইউলোজিয়াস ও এলভারো। তারা কোন ধরনের দ্বিধা ছাড়াই ইসলাম ও মহানবীকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ কথা বলতো। অনেকে আবার মসজিদে ঢুকে ইসলাম সম্পর্কে গালাগালি করতো। কর্ডোভা, সেভিল, টলেডো শহর ধর্মান্ধ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র ছিল। ধর্মান্ধ আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উগ্র ছিল ইউলোজিয়াস ও ফ্লোরা। ফ্লোরার বাবা ছিলেন মুসলমান ও মা খ্রিস্টান। ফ্লোরাকে ইসলামের পথে নিয়ে আসতে তার ভাই ও বাবা অনেক চেষ্টা চালান। শেষপর্যন্ত কাজী ফ্লোরাকে চাবুক মারার শাস্তি দিলে এ ঘটনা ধর্মান্ধ আন্দোলনকে আরো উস্কে দেয়। এছাড়া রমজান মাসে পারফেক্টাস নামের এক খ্রিস্টান ইসলামের নবী মোহাম্মদ (স) নিয়ে কটুক্তি করলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এই ঘটনায় আন্দোলন দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। খ্রিস্টান নেতারা ঘোষণা দেয় মুসলমানরা তাদের শত্রু। তাই তাদের শাসন খ্রিস্টানদের মানা উচিত হবে না। এর মধ্যে আইজ্যাক নামের এক ধর্মযাজক স্বেচ্ছায় আত্মাহুতি দিলে অবস্থা আরো গুরুতর হয়ে পড়ে। কর্ডোভা ও টলেডোতে স্বেচ্ছায় আত্মাহুতির সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। সাম্রাজ্য জুড়ে দেখা দেয় চরম অস্থিরতা। যদিও উদার খ্রিস্টানরা এই অস্থির‍তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিল তা সত্ত্বেও আন্দোলন পুরোদমে চলতে থাকে। দ্বিতীয় আব্দুর রহমান এই অবস্থার নিরসনকল্পে একটি সভা আহ্বান করেন। খ্রিস্ট ধর্মের বিশেষজ্ঞদের সাথে তিনি আলোচনা করে তাদের মতামত শুনেন। বিশপগণ এই বলে মত দেন যে, অন্য আরেকটি ধর্মের বিরুদ্ধে উত্তেজনা তৈরি করা খোদ বাইবেলের আদর্শ বিরোধী এবং শান্তি পালন করা পূণ্যের কাজ৷ খ্রিস্ট ধর্মের পণ্ডিতদের কাছ থেকে এমন অবোধ পেয়ে দ্বিতীয় আব্দুর রহমান এবার কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ৮৫১ সালে তিনি ধর্মান্ধ নেতা ফ্লোরা ও মেরীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ফলে সাময়িক সময়ের জন্য এই আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রথম মোহাম্মদের সময়ে নতুন করে আবার এই আন্দোলন তার প্রাণ ফিরে পায়। ৮৫৯ সালে মোহাম্মদ ইউলোজিয়াস, অলভারো ও লিওসহ প্রায় ৪৪ জন ধর্মান্ধ নেতাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। এর ফলে এই আন্দোলন চূড়ান্তভাবে সমাপ্ত হয়।

আন্দোলনের পরিসমাপ্তি হলেও এই ঘটনা স্পেনের মুসলিম শাসনের পতন ঘটায়। এই আন্দোলনেই স্পেন থেকে মুসলমানদের বিতাড়নের প্রথম বীজ প্রোথিত করা হয়েছিল। মুসলমানদের প্রতি খ্রিস্টানদের ঘৃণার মনোভাব জিইয়ে থাকে। তারা শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে স্পেনের মুসলিম আমিরাতের পতনের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের এই সোনালি অধ্যায় শেষ হয়। আপাতদৃষ্টিতে ধর্মান্ধ আন্দোলন সফল না হলেও মুসলমানদের স্পেন হারানোর ট্র‍্যাজেডিতে খ্রিস্টান ধর্মান্ধরা সফলই বলা চলে।