১৫৬১-৬২ উন্মার্গগামী আমলাকে ক্ষমা
[বৈরাম খানের সহায়ক মুজফফর আলি তুরবাতি সম্রাটের ক্ষমা পেয়েছেন। সম্রাট আকবরের রাজত্বে তিনি উচ্চপদে আসীন হবেন, তার উপাধি হবে মুজফফর খান। বায়াজিদ এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। নিয়েছি তাজকিরাতইহুমায়ুনওআকবর থেকে।]
পরেরদিন খানইখানান[মুনিম খান] মাহাম বেগের[সম্রাট আকবরের সৎমা] প্রাসাদের দিকে রওনা হচ্ছিলেন, আমি বায়াজিদ, তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলাম[বৈরাম খানের প্রশাসনের আমলা খাজা মুজফফর আলি তুরবাতিকে ক্ষমা করার বিষয়টি]। মাহাম বেগ তাঁকে অভ্যর্থনা করে জানালেন, ‘অপরাধীকে ক্ষমা করার থেকে সম্মানের আর কিছুই হতে পারে না। আমি কাউকে দরবেশ উজবেগের বাড়ি পাঠিয়ে মুজফফর আলিকে কারাগারের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করছি’। খানইখানান জানালেন, ‘এটা যদি আপনার মত হয় তাহলে এই আবেদনটি মহামহিমের সামনে পেশ করা দরকার’। বেগ বললেন, ‘তাই করব’।
তাঁদের আলোচনার মধ্যেই মহামহিম তাঁর সৎমায়ের প্রাসাদে আলোচনার মধ্যে একটা কাজে উপস্থিত হলেন। তিনি দস্তান খানের মায়ের সেলাই বাক্স থেকে একটি সূচ বের করে নিয়ে হিসারে শিকারের সময় পায়ে গেঁথে থাকা একটা কাঁটা বার করছিলেন। কাঁটা তোলার সময়ে তাঁর মা সম্রাটের কাছে এসে খানইখানানের আবেদনক্রমে খাজা মুজফফর আলিকে ক্ষমা করার বিষয়টি আরও একবার তুললেন। মহামহিম সম্রাট তাঁর আবেদন স্বীকার করে বললেন, ‘লোকে বলে লোকটি দক্ষ লেখক। তোমার[খানইখানান] যদি তাঁকে পছন্দ হয়, তাহলে তুমি তাকে চাকরি দিতে পার’।
১৫৬০-৬৪ লৌকিকতাবর্জিত যুবা সম্রাট
[ব্যবসায়ী রফিউদ্দিন সিরাজি, পারস্য, ইরান থেকে মুঘল হিন্দুস্তানে আসেন ১৫৫৯-৬০এ। ১৫৬০-৬৪ অবদি তিনি আগরায় কাটান। আগরা ছিল সে সময় দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠতম পাইকারি বাজার। এরপরে তিনি দক্ষিণে যান। তাজকিরাতুলমুলুক বইতে তিনি দক্ষিণের রাজ্যগুলোর সঙ্গে সম্রাট আকবরের স্মৃতিচারণও করেছেন।]
তখন মহামহিম জালালুদ্দিন মহম্মদ আকবর স্বাভাবিক অটল সাহস এবং মহত্ব নিয়ে খিলাফত আর সার্বভৌমত্ব অবলম্বন করে সিংহাসনে আরোহন করেছেন। সিংহাসনে বসেও শিকারক্রীড়ার প্রতি তাঁর অনবদ্য আকর্ষণ ছিল এবং বন্য জন্তুকে তিনি দীর্ঘ রাস্তা তাড়া করতেন। শিকারী কুকুর, শ্যেন, বাজ, চিতা, শাহী সদা শ্যেন শিকারী পশুকে তিনি খুব পছন্দ করতেন। শাহী শিকারখানায় এধরণের বহু পশু লালিতপালিত হত। তাছাড়া শিকারের জন্যে মহামহিম হলুদ আর সবুজে মেশানো আলাদা পরিধেয়ও বানিয়েছিলেন যাতে জঙ্গলে ক্যামোফ্লেজ করে থাকা যায়। শিকার দলের সব সহকারী এবং ভৃত্যকেও একই পরিধেয় পরতে হত। মহামহিমের বন্দুকের আওতায় থাকা কোনও পশুর নিস্তার ছিল না। কখনও তিনি তীর ধনুক, কখনও তিনি মাস্কেট, কখনওবা তরোয়াল নিয়ে শিকার করতেন। কোনও কোনও সময় তিনি একাই শিকার করতে পশুর পিছনে তিন-চার ফারসাখ[ফারসাখ = ৪ মাইল] দূরত্ব অবদি চলে যেতেন। এই সময়ে তাঁর নির্দেশ ছিল কেউ যেন তার পিছন না নেয়। এক দিন তিন চার ফারসাখ দূরত্বে হরিনের পিছন ধাওয়া করে চলে তাকে হত্যা করেন। শিকারে মৃত হরিণ ছেড়ে আসাকে অশুভ ইঙ্গিত মনে করে তার নাড়িভুঁড়ি পরিষ্কার করে হরিনটিকে কাঁধে চাপিয়ে আর অন্য হাতে শেকলে বাঁধা চিতাকে হাঁটিয়ে নিয়ে ফিরলেন।
একদিন একটি শিকারকে রাড়া করতে করতে বিদ্রোহীদের গ্রামে উপস্থিত হলেন। ক্রুর তারা তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন ‘খানইখানানের[বৈরাম খাঁ] আমলা’। দুষ্টুমি করে তারা মহামহিমকে গরুর খুঁটিতে বেঁধে রাখল। মহামহিমের ঠিক সময় না ফেরায় শিকার শিবিরে মানুষজন উদ্বিগ্ন হয়ে সেনা বাহিনী নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে তাকে সেইভাবে আবিষ্কার করে উদ্ধার করল, গ্রামের মানুষকে গ্রেফতার করল। মহামহিমের সঙ্গে এই রকম ঘটনা দুতিনবার ঘটেছে।
আরেকদিন শিকারের পিছনে ছুটতে ছুটতে তিনি ক্ষুধায় জলতেষ্টায় এক ভাটিয়ারির, মহিলা সরাইমালিকের বাড়ি আশ্রয় নিয়ে ক্ষুধানিবৃত্তি করলেন এবং বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সম্রাট আকবরের সময় প্রত্যেক এক বা অর্ধেক ফারসাখে [ফারসাখ = ৪ মাইল] অবস্থিত সরাইখানার মাঝে মহিলা ভাটিয়ারি থাকতেন। সরাইখানা ছেড়ে আসা বণিক/মুসাফিরদের যদি তেষ্টা বা ক্ষুধানিবৃত্তি করতে হত, তারা ভাটিয়ারির বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে তাঁকে রসদ দিতেন, ভাটিয়ারি তাদের আস্বাদমতই রেঁধে দিতেন; এর বদলে ভাটিয়ারি তার শ্রমের মূল্য নিতেন। বিশ্রামের জন্যেও অতিরিক্ত মূল্য দিতে হত। কপর্দকহীন মহামহিম সম্রাট যখন ভাটিয়ারির বাড়িতে ক্ষুধানিবৃত্তি করে শ্রম অপনোদন করছেন সেই সময় একদল বণিক সেখান এল। তারা উস্কোখুস্কো কপর্দকহীন সম্রাটকে দেখে তাদের সম্মান সালাম জানাতে নির্দেশ দেয়। মহামহিম তাদের পাত্তা না দেওয়ায় তারা তাকে কয়েক ঘা চাবুক মারে এবং তাকে সেখান থেকে চলে যেতে নির্দেশ দেয়। একা পড়ে যাওয়ায় মহামহিম অবস্থা অনুকূল নয় বুঝে ভাটিয়ারি থেকে চলে যান। ইতিমধ্যে গণ্ডগোল শুনে ভাটিয়ারি এসে বণিকদের মহামহিমের পরিচয় দিয়ে বললেন, কেন তিনি ভাটিয়ারিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বণিকেরা নিজেদের ঘৃণ্য কাজের জন্যে অনুতপ্ত হয়ে মুহূর্তের মধ্যে পালিয়ে গেল।
[রফিউদ্দিন শিরাজি, তাজকিরাতুলমুলুক বই থেকে আরেকটি ঘটনা। ১৫৬২-৬৩তে শাহ তামস্পের দূত সৈয়দ বেগ আগরায় আসেন। সে সময় রফিউদ্দিন শিরাজি আগরায় এই ঘটনার প্রত্যক্ষ্যদর্শী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এই ঘটনাটি নিয়েছি ইকতিদার আলম খানের স্টাডিজ ইন হিস্টোরি, খণ্ড ২, নম্বর ১ থেকে]
বইটির লেখক ব্যবসার উদ্দেশ্যে গুজরাট থেকে আগরা আসেন। এখানে তিনি ব্যবসা করছিলেন। আশা ছিল আমার কোনও দিন নিশ্চই এই অঞ্চলের সম্রাটের সঙ্গে দেখা হবে। শুনলাম পারস্যের শাহ তসামস্পের ডান হাত, মাসুম বেগের সন্তান সৈয়দ বেগ তখন আগরায় আশ্রয় নিয়েছেন সুলতানের দূত হিসেবে। তাঁকে অভ্যর্থনার জন্যে শাহী বাগানে একটি বিশাল শাহী তাঁবু এবং বড় শিবির ফেলা হয়েছে। সেই ক্ষেত্রটি মনমোহনভাবে সাজানো হয়েছে। অভিজাতরাও সেখানে তাদের মত করে নিয়ম মেনে তাঁবু খাটিয়েছেন। শহরের মানুষেরা সেই সব সাজানোগোজানোর পরিবেশ দেখতে মাঝেমধ্যেই বাগানে ঘুরতে যেতেন। আমারও মনে হল আমারও একদিন সেখানে যাওয়া দরকার, আমিও সেই সাজসজ্জা ঔজ্জ্বল্য দেখব। একদিন আমিও ভিড়ে দাঁড়িয়ে সেই সব সাজসজ্জা দেখছি, হঠাত শুনলাম সমবেত উচ্ছ্বাস ‘বাদশা সালামত, সর্বশক্তিমান বাদশাকে রক্ষা করুন’। বুঝলাম, আমাএ সৌভাগ্যবশত সেখানে বাদশা উপস্থিত হয়েছেন। আমি আমার ডানে বাঁয়ে দেখলাম, মনে হল না একজনও শাহী পরিবারের/সংযোগের মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন, কারোরই চেহারায় শাহী চিহ্ন বা ছাপ নেই। হঠাত পিছনে ফিরে দেখলাম অদূরেই বিশ বছরের এক যুবা কোনও একজন সাথীর কাঁধে হাত রেখে লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আন্দাজ করলাম, তিনিই শাহ আকবর হবেন। কিন্তু আমার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ দিয়ে যে সব প্রজা দাঁড়িয়ে আছেন, তারা কেউই তাঁকে সম্মানজনক সালাম দিচ্ছেন না। আমি একটু দূর সরে গিয়ে কী ধরণের ঘটনাবলী ঘটে বুঝতে চাইছিলাম। ঘটনাক্রমে অবাক হয়ে পাশের মানুষদের প্রশ্ন করলাম, দরবারেও কী সম্রাটকে সম্মান জানানোর কোনও প্রথা নেই যার মাধ্যমে উপস্থিত প্রজারা সম্রাটকে সালাম জানাতে পারেন। তারা বলল, ‘অন্যান্য শাসকের তুলনায় এই সম্রাটের দরবারে খুবই বিশদে এবং কঠোরভাবে সম্মান জানানোর প্রথা পালন করানো হয়; কিন্তু সম্রাট মাঝেমধ্যেই দরবারের বাইরে অনেক প্রথা ভাঙতে ভালবাসেন, এবং অনানুষ্ঠানিকও হতে চান। অনেক সময় তিনি সাধারণ মানুষের পোষাকে সাথীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে অপরিচিত আর পরিচিতের বেড়া ভেঙে দেন। এইরকম অবস্থায় তাঁকে কীভাবে তসলিম জানানো হবে?’ একবার আমি তাকে তাঁর প্রাসাদের ছাদ থেকে খালিগায়ে, খালি মাথায় লুঙ্গি জড়িয়ে ঘুড়ি ওড়াতে দেখেছিলাম। সেদিন থেকে আমার মনে হয় মহামহিম অনেক বেশি খোলামেলা মনের এবং অপ্রাতিষ্ঠানিকও বটে।
১৫৬৩ আকবরের সৎভাই আধম খান হত্যা
[আমরা এর আগে দেখেছি কীভাবে শামসুদ্দিন আতকা খান ১৫৬১তে মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ মন্ত্রীপদে বৃত হলেন। তার পদোন্নতিতে দরবারি অভিজাত এবং খানজাদাদের একাংশ অখুশি হয় এবং তাকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত চলতে থাকে এবং আতকার হত্যাকাণ্ড ঘটে। এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯৬৩তে আকবরের দাইমা, সৎমার পুত্র আধম খানকে আকবর অকুস্থলেই হত্যা করার নির্দেশ দেন। আতকা খানের বিরোধী শিবরের অন্যতম অভিজাত মুনিম খানের সহযোগী হিসেবে বায়াজিদ বয়াত আমাদের এই গল্পটি শুনিয়েছেন। এই অংশটি বায়াজিদের তাজকিরা তইহুমায়ুন ও আকবর বই থেকে নেওয়া।]
এই বছর আতকা খান[শামসুদ্দিন, আকবরের আতকা বা সতপিতা] এবং আধম খান কোকার[মাহাম আঙ্গা, আকবরের কোকা বা সৎভাই] মধ্যে নানান রকমের ভুলবোঝাবুঝি, স্বার্থদ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে ঝগড়ায় রূপান্তরিত হয়। ঝগড়া তুমুল আকার ধারণ করায় আধম খান কোকার ভৃত্য খসম এবং আলা বর্দি দেওয়ানি আমের বিশাল কক্ষে প্রকাশ্য দিবালোকে খোলা তরোয়াল নিয়ে বসে থাকা আতকাকে ১৬ মে ১৫৬২ হত্যা করে। মহামহিম তখন প্রাসাদে ছিলেন। খবরটা তার কানে পৌঁছলে তিনি তৎক্ষণাৎ তরোয়ালটা হাতে নিয়ে, কোমোরে লুঙ্গিটা জড়িয়ে বেরিয়ে [দেওয়ানি] এলেন। উপস্থিত বিহ্বল কর্মীদের তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘এটা কার দেহ?’ সম্রাট বাবরের বোন খানজাদা বেগমের বংশানুক্রমিক ভৃত্য চার-মনসবদার পদাধিকারী রফিক জানাল ‘সম্মানিত মহামহিম, আপনার আতকার দেহ’। সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন ‘কে খুন করল?’ সে উত্তর দিল, ‘আধম খান’। তখন আধম খান সিঁড়ির তলার ধাপে ছিল, সম্রাটকে তার প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে সেও সিঁড়ি বেয়ে সম্রাটের দিকে উঠে আসতে থাকে। হিন্দুস্তানি লব্জে মহামহিম চিৎকার করে উঠলেন, ‘গাণ্ডু! তুই কেন আমার আতকাকে খুন করলি?’ সে উত্তর দিল, ‘সে রাজদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক’। মহামহিম তার শালপ্রাংশু হাত বাড়িয়ে আধম খানের চুলের গোছা ধরে কপালে এত জোরে ঘুঁষি মারলেন যে সে আর কথা বলারমত অবস্থায় থাকল না। মহামহিম সম্রাট সিঁড়ির ওপর থেকে তাকে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। মেথর শুখাই, যাকে মহামহিম হুমায়ুন লাহোরে রাজধানী থাকাকালীন ফরহাদ খান উপাধিতে সম্মানিত করেছিলেন, তিনি কাছে ছিলেন। তিনি এবং আরও কিছু জন মিলে ওপর থেকে আধম খানের মাথা নিচু করে নিচে ফেলে দিলেন যাতে তার মাথা ফেটে যায়। কিন্তু আশ্চর্যের কথা তারপরেও সে মারা যায় নি, বেঁচেছিল। সম্রাট আবার নির্দেশ দিলেন তাকে তুলে এনে আবারও ফেলে দিতে। দ্বিতীয়বার তার নির্দেশ পালনের পরে দেখাগেল কোকার মৃত্যু ঘটেছে।
প্রাসাদের মানুষেরা ঘটনা প্রবাহের প্রাবল্যে এবং সম্রাটের রুদ্রমূর্তি দেখে বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। মহামহিম মাহম বেগের[মাহম আঙ্গা] ঘরে গেলেন এবং বললেন ‘মাম্মা, আধমকে মেরে ফেললাম’। আঙ্গা সম্রাটের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করে বললেন, ‘হে মহামহিম, আপনি ঠিক কাজই করেছেন। আমি এবং আমার অন্যান্য পুত্ররা আপনার হাওয়ালে/নিরাপত্তায় থাকলাম। সে দুষ্কর্ম করেছে। আপনি বিচার দিয়েছেন; সে তার শাস্তি পেয়েছে’।
১৫৬৩ কেন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণের দিকে
[আকবরের রাজত্বের ৭তম বছরের(১৫৬২-৬৩) ঘটনা। হামিদা বানুর সৎ ভাই খাজা মুয়াজ্জম আকবরের মামা। স্ত্রীকে হত্যা করার জন্যে[যদিও বহু বইতে অভিজাত মহিলা বলা হয়েছে, কিন্তু বায়াজিদের বয়ানে পরিষ্কার হয় সত্য] তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আবুলফজল পরের দিকের সময়ে মন্তব্য করেছেন, আতকার গুষ্টিকে নির্বংশ করে দেওয়া আকবরের অন্যতম প্রশাসনিক পরিকল্পনা ছিল। এই অংশটাও বায়াজিদ বায়াতের তাজকিরাইহুমায়ুনওআকবর বই থেকে নেওয়া।]
একদিন মহামহিম মুনিমখানইখানখানকে প্রশ্ন করলেন ‘আমার শাহী সরকার সম্বন্ধে জনগণের ধারণা কী?’ খানইখানান উত্তর দিলেন, ‘হে সম্রাট, আপনি ১২০ বছর আয়ুলাভ করুন। যে দিন আপনি আতকাকে হত্যার জন্যে আধম খানকে হত্যা করিয়েছেন, বিবি ফতিমার কন্যাকে হত্যার জন্যে মুয়াজ্জমকে হত্যা করান, জনগণ আপনার প্রশংসায় মুখর; আপনার এই কাজগুলি যথাযথ বিচার দেওয়ার নিদর্শন’। মহামহিম খানইখানানকে বললেন, ‘আমরা এর থেকে আরও ভাল ভাল কাজ করেছি; আশ্চর্যের হল জনগণ এসব নিয়ে রা কাড়ে না। তুমিও সে সবের কথা উল্লেখ করলে না, কারন সে সবে কেউ না কেউ মনঃক্ষুণ্ন হবে’। খানইখানান বললেন, ‘সে সব কোন ঘটনা, হে মহামহিম, আমার জানা সে সব কোন ঘটনা, যেগুলো বললে কারোর মনঃকষ্টের কারন হবে’? সম্রাট বললেন, ‘এগুলোর থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো ছিল, আমি আতকা খানের পরিবার/গুষ্টিকে লাহোর থেকে বার করে এনে হিন্দুস্তানের নানান প্রান্তে জায়গির দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতেপেরেছি’। এই বাক্য থেকে আমাদের মহান সম্রাটের বিচার দেওয়ার ধারণা এবং প্রশাসনিক যোগ্যতার একটা ঝাঁকি খুঁজে পাই।
১৫৬৪ একটি কেলেঙ্কারি এবং হত্যার চেষ্টা
[১৫৬৪ বছরটাতে সম্রাট আকবর দিল্লিতে কাটান। আবুলফজলের আকবরনামা সূত্রে জানতে পারছি, সেই বছরের শেষের দিকে তাঁর প্রাণ নেওয়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা হয়। পলাতক বিদ্রোহী শারাফুদ্দিন হুসেইনের এক কৃষ্ণ দাসের পক্ষ থেকে হত্যার উদ্দেশ্যে ছোঁড়া তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গভীরভাবে সম্রাটের বাহুতে গেঁথে যায়; যদিও আকবরের তীব্র সমালোচক আবদুল কাদির বাদাউনি এই আঘাতকে সামান্য উল্লেখ করে এই ঘটনার পিছনে দিল্লির এক কলঙ্কজনক ঘটনার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। কেউ কেউ বলেন শারাফুদ্দিনের সঙ্গে আরেক অভিযুক্ত শেখ ওয়াসি হত্যার চক্রান্তে ছিলেন। এই ঘটনার পরে শারাফুদ্দিনও গুজরাট হয়ে বিদরে পালিয়ে যান। ওয়েসি আগে থেকেই বিদরে ছিলেন। মাথায় রাখা দরকার, আমরা আগেই বলেছি ঐতিহাসিক বাদাউনি তার ইতিহাসে সম্রাট আকবরের সাম্রাজ্য পরিচালনার পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করেছেন। সমালোচনা এতই তীব্র ছিল যে সম্রাটের জীবিতাবস্থায় সেই ইতিহাসের অনেকগুলোই প্রকাশ করার সাহস পান নি; কিছু রচনা সম্রাট আকবর মারা যাওয়ার পরে প্রকাশিত হয়েছে। অভিযোগ ছিল আকবরের রাজত্বের প্রথম সময়ে রচিত বাদাউনি তার ইতিহাসে ঐতিহাসিক ঘটনার বদলে ব্যক্তিগত ভাললাগা না লাগার বিষয়কে জোর দিতেন। বাদাউনি লিখেছেন ইতিহাসের গল্প। তারিখইআলফিতে বাদাউনির লিখিত নির্দিষ্ট একটি অংশ পড়ে অসন্তুষ্ট আকবর তাঁকে নতুন করে তথ্য যাচাই করে লেখার নির্দেশ দিলেন)। ঘটনার এই অংশটার মূল বক্তব্য বাদাউনির মুন্তাখাবউলতাওয়ারিখ থেকে নেওয়া]
ততদিনে সম্রাট আকবরের দুই ক্ষমতাধর প্রতিদ্বন্দ্বী বৈরাম খান এবং মহাম আঙ্গা ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন। আকবর নিজের অবস্থান জোরদার করতে সে বছর দিল্লি থাকাকালীন বিভিন্ন অভিজাত পরিবারের মধ্যে বিবাহ দেওয়ার উদ্যম শুরু করেন। তিনি মুখমিষ্টি ঘটক আর খোজাদের অভিজাত পরিবারের অন্দরমহলে পাঠাতেন সুন্দরী আকর্ষণীয় কুমারী কন্যা খুঁজে বের করে তাদের বিষয়ে নানান তথ্য জোগাড় করতে। আগরার দুই ধর্মগুরু শেখ বুধ এবং শেখ লাড়ার পরামর্শেই ঘটনার সূত্রপাত। শেখ বুধের বিধবা বৌমা, কুচক্রী, লাস্যময়ী ফতিমা আধম খানের বড় ভাই বাকি খানের বাড়ির কাছাকাছি থাকতেন। দুজনের মধ্যে কিছু দিন অবৈধ সম্পর্ক চলার পর তাদের বিবাহ দেওয়া হয়। ফতিমা-বাকির প্রাসাদেই শেখ বুধের আরেক অতুলনীয়া পরমা সুন্দরী কন্যা তার স্বামী আবদুল ওয়াসি বাস করতেন। সম্রাটের লালসাভরা দৃষ্টি সুন্দরীর ওপর পড়ল। তিনি শেখের পরিবারে বিবাহ প্রস্তাব পাঠালেন। মুঘল সম্রাটদের নীতি ছিল, সাম্রাজ্যের কোনও মহিলাকে যদি সম্রাটের পছন্দ হয়, তাহলে তার স্বামীকে বাধ্যতামূলক বিবাহ বিচ্ছেদ করে স্ত্রীকে বন্ধনমুক্ত করতে হবে। এই বিষয়টা লেখা আছে সুলতান আবু সৈয়দ, আমীর চোবান সবং তার পুত্র দামাস্ক খোজার বইতে। ওয়াসি স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে দক্ষিণের শহরে বিদরে চলে যান এবং ক্রমশ দৃষ্টি শক্তি হারাতে থাকেন। ইতিমধ্যে আকবরের চতুর্থ স্ত্রী হিসেবে মহিলা শাহী হারেমে প্রবেশ করেছেন। শ্বশুরের প্ররোচনায় লাস্যময়ী ফতিমা সম্রাটকে আবেদন করে বলেন, তিনি আগরা আর দিল্লির অন্যান্য অভিজাত পরিবারের কন্যার সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক করুন, তাহলে পক্ষপাতিত্ব না করে সব পরিবারের সদস্যকে সাম্রাট একই দৃষ্টিতে দেখতে পারবেন।
একদিন শিকার করে ফেরার সময় সম্রাটের বাহিনী মাহাম আঙ্গা প্রতিষ্ঠিত মসজিদ মক্তব খৈরুল মসজিদ এলাকা পার হচ্ছেন, সম্রাটের সঙ্গে বিবাদে বিদ্রোহী পলাতক মির্জা শারাফুদ্দিন হুসেইনের পক্ষ থেকে মুক্তি দিয়ে যাওয়া এক পারিবারিক কৃষ্ণ দাস ফৌলাদ সম্রাটকে লক্ষ্য করে তীর ছোঁড়ে। সৌভাগ্যের কথা সেটি সম্রাটের হাতের চামড়াও ভেদ করতে পারে নি। অভিজাতরা এই ঘটনার তদন্ত করতে চাইলে সম্রাট অস্বীকার করে বালকটিকে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়ে দিল্লির কেল্লায় ঢুকে চিকিতসকেদের চিকিৎসা নিয়ে সিংহাসনে চেপে আগরার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
১৫৭২ চিতার পুরষ্কার
[১৫৭২এ গুজরাটে প্রথম অভিযানের সময় জুলাই মাসে রাজস্থানের অম্বরের দক্ষিণে সাঙ্গানেরে শিকারের জন্যে থামেন। এটা নেওয়া হয়েছে আকবরনামার দ্বিতীয় খণ্ড থেকে]
এই সময় তিনি শিকারে অধিকাংশ সময় চিতা ব্যবহার করতেন। চিতাকে বড় শিকার দলের সঙ্গে ছেড়ে দিয়ে তিনি বিশেষ কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে শিকারে বেরোলেন। ইতিমধ্যে চিৎকার উঠল একটি হরিণের পিছনে চিতরঞ্জন চিতাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ দেখা গেল তাদের সামনে ২৫ গজের একটি দীর্ঘ গিরিখাত। দৌড়তে দৌড়তে হরিণটি জ্যা মুক্ত তীরের মত লাফ দিয়ে গিরিখাত পেরিয়ে গেল। চিতাটাও একই দক্ষতায় হরিণের পিছু পিছু মাস্কেটমুক্ত গুলির মত লাফ দিয়ে ভীমবেগে গিরিখাত লাফিয়ে ওপারে পৌঁছে হরিণের ভবলীলা সাঙ্গ করল। এই অপার্থিব দৃশ্য দেখে সকলে মোহিত, অবাক এবং বিস্মিত। সম্রাট চিতার পদাধিকার বাড়ালেন। সে তখন হল মুঘল চিতা বাহিনীর প্রধান এবং চিতা তার সামনে নাকাড়া বাজানোর অধিকার পেল।