ঢাকার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মুঘল স্থাপত্য লালবাগ দুর্গের নির্মাণ শুরু হয়েছিলো মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রিয় ছেলে শাহজাদা মোহাম্মদ আজম শাহের হাত ধরে। অসমাপ্ত থাকলেও এই লালবাগ দুর্গ এখনো পর্যন্ত ঢাকা শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃত।
মোহাম্মদ আজম খান বাহাদুর ছিলেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় ছেলে। তার মা ছিলেন পারস্যের অভিজাত শাহনেওয়াজ সাফভীর কন্যা। শাহজাদার বন্ধুবৎসল, দুঃসাহসিক ও সম্মোহনী ক্ষমতা দ্রুতই তাকে সম্রাটের প্রিয় পাত্র করে তুলেছিলো। আওরঙ্গজেব শাহজাদা আজমকে নিজের ছেলের চেয়ে একজন সঙ্গী ভাবতেই বেশি পছন্দ করতেন।
সম্রাট আওরঙ্গজেব অত্যন্ত খুঁতখুঁতে স্বভাবের হলেও শাহজাদা আজম তার কাজ দিয়ে বাবাকে সন্তুষ্ট রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। সম্রাট তাকে রাজপুতানার দুর্গ এবং গুজরাট ও দাক্ষিণাত্য অভিযানের দায়িত্ব দেন। ১৬৭৭ সালে পূর্বসূরি সুবাদারের মৃত্যু হলে বেরার, মালব ও বাংলা অঞ্চলের সুবাদার নিযুক্ত হন আজম শাহ।
তার সুবাদারি জীবনের সময়কালে, অর্থাৎ ১৬৭৯ সাল পর্যন্ত বাংলা সুবার রাজধানী ঢাকাতেই তিনি অবস্থান করেন। তার হাত ধরেই ঢাকা শহরের অবকাঠামো ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। তার ক্ষমতা গ্রহণের আগে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মানুষের যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হতো শহরের খালগুলোকে। ছোট শহরগুলোতে মানুষের চলাচলের জন্য ছিলো সংকীর্ণ সড়ক। যাতায়াতের জন্য প্রশস্ত সড়ক ছিলো খুবই বিরল। ক্ষমতায় আসার পর আজম শাহ এই অবস্থার পরিবর্তন আনেন। তিনি কংক্রিটের প্রশস্ত সড়ক নির্মাণে হাত দেন। ফলে নতুন নির্মিত সড়কগুলোতে মানুষের পাশাপাশি ঘোড়া, এমনকি হাতিও অনায়াসে চলাচল করতে পারছিলো। আর সেই থেকেই ঢাকায় প্রাণী দিয়ে যাতায়াত করার রীতি জনপ্রিয় হয়ে পড়লো।
সুবাদার আজম ঢাকা শহরকে নিজের বাড়ি মনে করে নিয়েছিলেন। জঙ্গল পরিষ্কার করে তিনি শহরটির শ্রীবৃদ্ধি করেন। ঢাকায় সুবাদারের দায়িত্ব পালনকালেই তিনি লালবাগ দুর্গের নির্মাণ কাজে হাত দেন। এই স্থাপনাটিকে শুধু দুর্গ ভাবলে ভুল হবে। শাহজাদা আজম এটিকে প্রাসাদের রূপ দান করেছিলেন। তিনি এখানে বসবাসও করতেন।
তৎকালীন সময়ে সম্পদের বিচারে বাংলা সুবা ছিলো মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম সমৃদ্ধ এক অঞ্চল। আওরঙ্গজেব চেয়েছিলেন উদীয়মান অর্থনীতির এই অঞ্চলে শাহজাদা আজম যেনো ভাইসরয় হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। কথিত আছে, আজম খান ঢাকা থাকাকালীন সময় সেখানকার গভর্নর শায়েস্তা খানের মেয়ে ইরান দুখত ওরফে পরী বিবিকে বিয়ে করেছিলেন। ইরান দুখতের প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্ট হয় লালবাগ দুর্গে তার সমাধি দেখে। দুর্গটির অন্যতম আকর্ষণ এই ইরান দুখতের সমাধি।
আজম শাহ যখন লালবাগ দুর্গ নির্মাণে হাত দেন, তখনও তিনি জানতেন না যে, দুর্গটির কাজ শেষ হওয়ার আগেই তাকে ঢাকা ছাড়তে হবে। যুবরাজ যদি তখন ঢাকা ত্যাগ না করতেন, তবে হয়তো তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে লালবাগ দুর্গ হয়ে উঠতো বাংলা প্রদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক স্থাপনা।
ঢাকায় আসার ১৫ মাস যেতে না যেতেই শাহজাদা আযমের ডাক পড়ে যায়। দ্রুতই তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। যাওয়ার আগে লালবাগ দুর্গের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব দিয়ে যান শায়েস্তা খানকে। শাহজাদার ঢাকা ত্যাগের পরই তার স্ত্রী ইরান দুখতের অকালমৃত্যু হয়। মেয়ের শোকে কাতর বাবা শায়েস্তা খান দুর্গের ভেতরেই নির্মাণ করেন তার সমাধি। অবশ্য লালবাগ দুর্গে বিবি পরীর সমাধি থাকা নিয়ে বিতর্ক আছে। এমনকি আজম খান যে শায়েস্তা খানের মেয়ে ইরান দুখতকেই বিয়ে করেছেন, তারও কোনো প্রমাণ নেই। সে হিসেবে তাদের বিয়ের ধারণাটি অনেকাংশে প্রশ্নবিদ্ধ। কেউ কেউ এ-ও মনে করেন, ইরান দুখত আসলে সম্পর্কে শাহজাদা আযমের ফুপু ছিলেন। আজম খানের ইতিমধ্যেই চারজন স্ত্রী ছিলেন। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন তার চাচাতো বোন, দারাশিকোহর মেয়ে জাহানজেব বানু বেগম।
বিবি পরীর সমাধিতে আবার ফেরা যাক। আগেই বলা হয়েছে বিবি পরীর সমাধি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেকে মনে করেন, এই সমাধিতে বিবি পরী নয়, বরং সমাহিত আছেন আজম খানের দ্বিতীয় স্ত্রী অহমের রাজকন্যা রামানী গাভারু। রামানী গাভারু ছিলেন অহমের ভূস্বামী স্বরগাদেউ জয়ধ্বজ সিংহের কন্যা। মীর জুমলা গৌহাটি জয় করে ফেরার পথে রামানীকে নিয়ে আসেন। নয় বছর বয়সী রামানীর স্থান হয় মুঘল রাজপ্রাসাদে। আওরঙ্গজেব ব্যক্তিগতভাবে তার দেখভালের দায়িত্ব নেন। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রামানী এক সময় ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তার নতুন নাম হয় রহমত বানু বেগম।
নিজের প্রিয় ছেলের সাথে রহমত বানুর বিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত আওরঙ্গজেবই নিয়েছিলেন। কথিত আছে যে, অপরূপ সুন্দরী রহমত বানুকেই আজম খান ভালবেসে ডাকতেন বিবি পরী। তবে মুঘল ইতিহাস থেকে হঠাৎ করেই হারিয়ে যান রহমত বানু। যুবরাজের সাথে ঢাকায় আসার তথ্য ছাড়া তার জীবন সম্পর্কে আর তেমন কিছু জানা যায় না। কোনো কোনো পণ্ডিত দাবি করেন, ঢাকায় এসে তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এবং লালবাগ কেল্লায় বিবি পরীর যে সমাধি রয়েছে, তা আসলে এই রহমত বানুরই সমাধি। এই সমাধিতে শায়িত ব্যক্তি রহমত বানু কিংবা ইরান দুখত যে-ই হন না কেনো, এই বিতর্ক সব সময়ই অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের আগ্রহের খোরাক যোগাবে।
শাহজাদা আজম ভাইসরয় থাকাকালীন আসামে গোলযোগ দেখা দেয়। তখন শাহজাদা তার সেনাবাহিনী নিয়ে দক্ষতার সাথে গৌহাটি দখল করে এর নাম দেন ‘আজমগড়’। ছেলের এমন সফলতায় মুগ্ধ হন আওরঙ্গজেব, যা আজম খানকে আরাকান আক্রমণ করতে উদ্বুদ্ধ করে তোলে।
একই সময়ে আবার ভারতবর্ষের হিন্দু যুবরাজরা জিজিয়া করের বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। মূলত এই গোলযোগের পুরো ভাগে ছিলেন রাজপুতানার হিন্দু যুবরাজেরা। জিজিয়া কর ছিলো মুসলিম শাসিত সমাজে অমুসলিমদের নিরাপত্তার জন্য প্রদেয় একটি কর। রাজপুতানায় জিজিয়া করের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা বিদ্রোহের নেতা ছিলেন মেবারের রাজা রাজসিংহ। বিদ্রোহ শুরু হলে সম্রাট আওরঙ্গজেব তার বিশ্বস্ত ছেলে শাহজাদা আজমকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সেখানে পাঠান। আজম খানের ঢাকা থেকে রাজপুতানার উদ্দেশ্যে যাত্রা ছিলো ইতিহাসের অন্যতম এক রোমাঞ্চকর যাত্রা। এর আগে এমন একটি ঐতিহাসিক যাত্রা করেছিলেন সম্রাট আকবর। আগ্রা থেকে গুজরাটের উদ্দেশ্যে তার এই যাত্রা চলেছিলো টানা নয় দিন।
আজম শাহ যাত্রাপথে একটি ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। রাত্রিকালীন যাত্রায় পালাক্রমে পালকিতে চড়ে এবং ভোরে ফজরের নামাজের পর ঘোড়া দিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করতেন। এই ত্বরিত গতির যাত্রায় সবাই কূলাতে পারতেন না। শাহজাদার স্ত্রী জাহানজেব বানুর কথাই ধরা যাক। আজম শাহ দিল্লি পৌঁছানোর পঁচিশ দিন পর পৌঁছান তিনি।
এই যাত্রা চলাকালীন একটি আকর্ষণীয় ঘটনা ঘটে। শাহজাদা আজম তার দীর্ঘ যাত্রার পথে হঠাৎ তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন। এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন, একটি কুয়া থেকে কিছু লোক পানি তুলছে। তাদের একজনের কাছে তিনি পানি চাইলেন। লোকটি তাকে পানি দিলো এবং শাহজাদা খুশি হয়ে তাকে পুরষ্কার হিসেবে একটি স্বর্ণমুদ্রা ছুঁড়ে দিলেন। এরপর কাফেলা আবারো যাত্রা শুরু করলো। কিন্তু হঠাৎ করেই একজন লোক শাহজাদার বহরের গতিরোধ করে আরো কিছু মুদ্রা দাবি করে বসলো। ক্ষিপ্ত শাহজাদা তার তীর দিয়ে তৎক্ষণাৎ লোকটিকে আঘাত করে বসেন। লোকটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং বুকে তীরবিদ্ধ অবস্থাতেই তার মৃত্যু হয়। শাহজাদার লোকজন মৃত লোকটির শিরঃচ্ছেদ করে সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে নিয়ে যায়। ঘটনার আদ্যোপান্ত শুনে সম্রাট এক মুহূর্ত দেরী না করে ঘোষণা দেন যে, এখন থেকে রাজকীয় যাত্রাপথে রৌপ্য মুদ্রা ছাড়া অন্য কোনো মুদ্রা সাথে নেয়া যাবে না।
আঠারো দিন বিরামহীন যাত্রার পর অবশেষে আজম শাহ আজমীরের কাছে রয়্যাল ক্যাম্পটিতে পৌঁছান। এরপর তিনি তার দুই ভাইকে নিয়ে উদয়পুর আক্রমণ করেন এবং বিজয়ী হন। ঐতিহাসিক চিতোর দুর্গ ঐ সময়ই মুঘলদের অধিকারে আসে এবং উদয়পুরকে মুঘল সাম্রাজ্যে যুক্ত করা হয়। রাজসিংহ পাহাড়ে পালিয়ে যান এবং বিদ্রোহ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন।
আওরঙ্গজেবের নির্দেশনা অনুযায়ী আজম শাহ ৫০ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী নিয়ে বিজাপুর দুর্গ দখলে অগ্রসর হন। বিজাপুর আক্রমণে প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েন আজম শাহ। ঘটনার গুরুত্ব উপলব্ধি করে আওরঙ্গজেব নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে যান। আট দিন ব্যাপী চলমান যুদ্ধের পর বিজাপুর দুর্গ মুঘল অধিকারে আসে। তবে এই বিজয় আরো একটি নতুন যুদ্ধের অবতারণা করেছিলো। মারাঠী জাতীয়তাবাদীরা মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মারাঠী স্বাধীনতার ঐতিহাসিক মারাঠা-মুঘল যুদ্ধে মারাঠারা বিজয় অর্জন করেছিলো। তবে এটি সম্ভব হয়েছিলো আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর।
শাহজাদা আযমের সবচেয়ে বড় সামরিক বিজয় ছিলো কামরূপ অধিকার, যেটি মীর জুমলার মৃত্যুর পর মুঘলদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিলো। বাংলা অঞ্চলের ভাইসরয় হওয়ার পর পরই আজম শাহ কামরূপের বিরুদ্ধে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। বারো বছরের মধ্যে কামরূপ আবারো মুঘলদের হাতের মুঠোয় আসে।
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর আরো একটি সংকট তৈরী হয়। উত্তরাধিকার প্রশ্নে আজম শাহের সাথে তার ভাইদের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। অবশ্যম্ভাবী এই যুদ্ধ এড়ানোর জন্য আওরঙ্গজেব জীবিত থাকাকালীন আজম শাহ ও তার সৎ ভাই কাম বকশকে আলাদা করে দিয়েছিলেন। তারপরও বাবার মৃত্যুর পর আজম শাহ নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করলে তার ভাই এই দাবিকে সহজভাবে মেনে নেন নি। মুঘল বিধি অনুসারে, উত্তরাধিকার নিশ্চিত করার জন্য একটি যুদ্ধের অবতারণা হয়, যেমনটি হয়েছিলো আওরঙ্গজেবের ক্ষেত্রে। ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্ষণকালীন মুঘল সম্রাট আজম শাহ তার ভাইদের সাথে সংঘটিত যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন।
আজম শাহ সম্রাট হিসেবে খুব অল্প সময় রাজত্ব করলেও তার জীবদ্দশায় তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক সীমানা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের জন্য তার এই অবদান কেউ মনে না রাখলেও তার কাজ তাকে মনে রেখেছিলো। আমরা সবাই সম্রাট আকবরের ঐতিহাসিক যাত্রা নিয়ে কথা বলি, কিন্তু আজম শাহের ঢাকা থেকে রাজপুতানার উদ্দেশ্যে ১৮ দিন ব্যাপী সেই যাত্রার কথাও ঐতিহাসিকভাবে স্মরণ করা উচিৎ। তার সাহস, দক্ষতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা অনেক মুঘল সম্রাটকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। তিনি একজন সম্রাট হবার যোগ্য ছিলেন।
আজম শাহ ঢাকায় না আসলে আমরা ঢাকা শহরে লালবাগ দুর্গের মতো অসাধারণ স্থাপনাটি কখনোই দেখতে পেতাম না, এমনকি আমাদের সড়কব্যবস্থাও হয়তো এতো দ্রুত উন্নত হতো না। এছাড়া আজম শাহ ছিলেন আওরঙ্গজেবের প্রিয় ছেলে। ফলে এটা স্পষ্ট যে, তিনি যোগ্যতার দিক থেকে ছিলেন অনন্য। এ ধরনের জাতীয় নায়কদেরকে মাথায় তুলে না হয় না-ই রাখলাম, তবে কমপক্ষে তাদের অবদানগুলোকে অবশ্যই আমাদের স্বীকার করা উচিত এবং তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া আমাদের কর্তব্য।