(1st part)

আম্রপালী – আমের নামের সাথে জড়িয়ে আছে এক অপরুপা সুন্দরীর নাম। ২৫০০ বছর আগে জন্ম নেয়া ভারতের সেই শ্রেষ্ঠ নর্তকীর নাম ছিল আম্র পালী। তার রূপ ছিল আগুনের মতো আর সবাই সে আগুনে পুড়তে চাইতো, সবাই তাকে পেতে চাইতো।

এবারে আসি সেই অসামান্যা রুপবতী আম্রপালির কথায়-

বৈশালীর রাজ্যে শ্রাবস্তী নামের শহরে মহানামা নামে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের একজন বসবাস করতেন । একদিন আমগাছের গাছের নিচে একটি কন্যাশিশুকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন মহানামা নামের এই নিঃসন্তান দম্পতি। তারা তার নাম রাখেন আম্রপালী।আমগাছের নিচে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন বলে এই নামই রাখা হয়েছিল | সংস্কৃতে আম্র মানে আম এবং পল্লব হল পাতা, মানে আমগাছের নবীন পাতা | এদিকে সেই বালিকা ধীরে ধীরে কৈশোরে পা দিল, তার বিয়ের ব্যাবস্থা করা দরকার কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো তার রূপ,সবাই তাকে পেতে চায়। তাকে পাবার জন্য সবার মধ্যে মারামারি লেগে গেল। এখন একজন মেয়ে তো আর সবাইকে বরমালা পরাতে পারেনা।তো সমাজপতিরা বিধান দিল আম্রপালী কোনওদিন বিয়ে করতে পারবে না | কারণ এত রূপ যৌবন নিয়ে সে কোনও একটি পুরুষের ভোগ্যা হতে পারবে না।

সভায় এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে আম্রপালীর বাবা খুব ব্যথিত হলেন কিন্ত এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো রকম প্রতিবাদ করতেও সাহস পেলেন না। সে যুগে রূপবতীর সতীত্বের মূল্য সমাজপতিদের কাছে ছিল না । আম্রপালী আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু তার পালক পিতা-মাতার মুখের দিকে তাকিয়ে আত্মহননের চেষ্টা থেকে নিজেকে বিরত রাখল। তাকে ‘নগরবধূ’ ঘোষনা করা হলো। নগরের সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় তার জন্য প্রাসাদ তৈরি করে দেয়া হল। প্রাসাদের নাম দেয়া হল আম্রকুঞ্জ’ । গল্পটি ভারতবর্ষের বৈশালী রাজ্যের (বর্তমান বিহার রাজ্য) এবং খ্রিস্টের জন্মের ৫০০-৬০০ বছর আগের। আম্রপালী বাস করতেন বৈশালী শহরে। এটি ছিল প্রাচীন ভারতের একটি শহর, বর্তমানে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের বিহার রাজ্যের অন্তর্গত একটি প্রত্নক্ষেত্র। গৌতম বুদ্ধ বেশ কয়েকবার বৈশালীতে এসেছিলেন। তাঁর সমসাময়িক কালে বৈশালী ছিল একটি সমৃদ্ধ ও বর্ধিষ্ণু শহর। চীনা পর্যটক ফাহিয়েন (খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতাব্দী) ও হিউয়েন সাংয়ের ভ্রমণবিবরণীতে বৈশালী শহরের কথা পাওয়া যায়।

বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থে আম্রপালীকে জনপদকল্যাণী বলেও উল্লেখ করা হয়েছে | এই জনপদকল্যাণী বা নগরবধূ কিন্তু সামান্য গণিকা বা দেহপসারিণী নয়| সে হবে নৃত্যগীতে পারদর্শী, অভিজাত আদবকায়দায় রপ্ত এক সুন্দরী। শুধুমাত্র উচ্চবংশের পুরুষই তাকে পাবে।জনপদকল্যাণী নিজেই নিজের সঙ্গী নির্বাচন করতে পারবে, কিন্তু বিয়ে করতে পারবেনা| তাকে লক্ষ্য করে সে আমলে বৈশালীতে নতুন আইন তৈরি হয়ে গেল, অনিন্দ্য সুন্দরী নারী কখনও পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হতে পারবে না। জনসাধরণের আনন্দের জন্য তার নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। বিচারকেরা রায় দিলেন, ‘আম্র-পালীকে নিয়ে লড়াইয়ের দরকার নাই। ও সবার হবে, রাস্ট্রের নির্দেশে দেহ ব্যবসার ঘটনা পৃথিবীতে হয়তো এই একটিই।

স্নেহময় বাবার মানসিক অবস্থা দেখে আম্রপালী তখন কয়েকটি শর্তে এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার কথা জানালো ।

শর্তগুলি ছিল এরকম——

(ক) তার বাড়ি হবে নগরের সবচেয়ে মনোরম জায়গায়।

(খ) একবারে মাত্র একজন তার ঘরে ঢুকতে পারবে।

(গ) তার দর্শণী হবে প্রতি রাতের জন্য পাঁচশো স্বর্ণমুদ্রা

(ঘ ) শক্র বা কোনো অপরাধীর খোঁজে সপ্তাহ শেষে মাত্র এক দিন তার বাড়িতে অনুসন্ধান করা যাবে।

(ঙ) তার বাড়িতে আসা ব্যক্তিদের সম্বন্ধে কোনো অনুসন্ধান করা চলবে না। আম্রপালীর দেয়া পাঁচটি শর্তই সেদিন বিচারক সভা মেনে নিয়েছিল।

শুরু হলো আম্রপালীর নতুন জীবন, ক্রমে ক্রমে সে প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হল । রাজাদের থেকে কোন অংশে কম ছিল না আম্র-পালীর সম্পদ | জনপদকল্যাণী হওয়ার সুবাদে সে ছিল বৈশালীর রাজনর্তকী | তার সেবার জন্য ছিল বিশাল উদ্যান আর মার্বেলের প্রাসাদ। এরপর আম্রপালী বিভিন্ন জায়গা থেকে দক্ষ চিত্রশিল্পীদের আমন্ত্রণ করে তখনকার রাজা, মন্ত্রী, সম্ভ্রান্ত নাগরিক এবং ধনাঢ্য মানুষজনের প্রতিকৃতি নিজ বাড়ির দেয়ালে আঁকিয়েছিল।এইসব প্রতিকৃতির মধ্যে মগধরাজ (বর্তমানে ভারতের বিহার) বিম্বিসারের(৫৫৮ খ্রিঃপূঃ – ৪৯১ খ্রিঃপূঃ) প্রতিকৃতি দেখে আম্রপালী মোহিত হয় এবং মগধরাজের সাথে মিলনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। এবারে আসি মগধরাজ বিম্বিসারের কথায়——-

প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের শুরু খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। এর আগেও যে প্রাচীন ভারতে রাজনৈতিক ইতিহাস ছিল না তা নয়, তবে সেই ইতিহাস আজও তেমন স্পষ্ট নয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের দিকে প্রাচীন ভারতে ষোলোটি স্থানীয় রাজ্য গড়ে উঠেছিল । প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থসমূহ ও প্রাচীন জৈন গ্রন্থ সমূহে এ ১৬ টি রাজ্যের উল্লেখ আছে। এই ১৬ টি রাজ্যের মধ্যে মগধ ছিল অন্যতম। এই মগধের (বর্তমানে ভারতের বিহার) রাজা ছিলেন বিম্বিসার । বিম্বিসার মাত্র পনেরো বছর বয়সে মগধের রাজা হন। তিনি রাজ্য বিস্তার করে সাম্রাজ্য গঠনের উদ্দেশ্যে বহু বিবাহ করেছিলেন । তার স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ৫০০ ! কবি জীবনানন্দ দাসের ”বনলতা সেন ” -কবিতাটিতে কিন্তু এই বিম্বিসার –কথা আছে।

‘’হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি’’……. বনলতা সেন, কবিতাতে যে বিম্বিসার –এর নাম লেখা আছে সেই হচ্ছে রাজা বিম্বিসার।মগধরাজ বিম্বিসার ছিলেন মগধের (বিহারের) প্রথম ঐতিহাসিক রাজা। আম্রপালীর রূপের কথা শুনে তাকে দেখার জন্য তিনি অত্যন্ত আগ্রহী হন। অন্যদিকে এই ১৬টি রাজ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল বজ্জি রাজ্য। এই রাজ্যের রাজধানী ছিল বৈশালি, আম্র-পালির রাজ্যের রাজার সাথে বিম্বিসারের ছিল ভীষন শত্রুতা। কাজেই আম্রপালীর সাথে মিলিত হওয়াটা তাঁর জন্য ছিল খুব কঠিন একটা কাজ। পরে অবশ্য তার সাথে আম্র পালীর প্রেম হয়েছিল, তবে বিম্বিসার-এর বিয়ের -প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল আম্রপালী।

পরদিন রাজা বিম্বিসার তার মন্ত্রী গোপালের কথামতো বণিকের ছদ্মবেশে বৈশালী রাজ্যের আম্রপালীর প্রাসাদের সামনে এসে থামলো।নিখুঁত ছদ্মবেশের কারণে কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় এরা কে! সেখানে হয়েছে সারি সারি তাঁবুর সারি, এরা সবাই আম্রপালীর সাক্ষাৎ প্রার্থী। এমন কি আম্রপালীকে শুধু এক ঝলক দেখার জন্য বিভিন্ন দেশের রাজ-রাজারা আম্রকুঞ্জের উঠানে তাবু টাঙিয়ে অপেক্ষায আছেন ! অবশেষে অনেক চেষ্টা-তদবীর করে রাজা বিম্বিসার আশ্বাস পেলেন যে দুদিন পর আম্রপালীর সাথে দেখা হবে । নিজের চোখে এসব কান্ড-কারখানা না দেখলে বিম্বিসার তার মন্ত্রী গোপালের আম্রপালী সম্পর্কে বলা কথা বিশ্বাসই করতেন না ।তারপর শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। মন্ত্রী জানালো আম্রপালী অনেক সময় নির্ধারিত সিডিউল রক্ষা করতে পারে না। দুদিন কেটে গেল অপেক্ষায় অপেক্ষায় ।কেউ তাদের সাথে যোগাযোগাও করছে না।

অবশেষে প্রতীক্ষার পালা শেষ হলো । দুদিনের অপেক্ষায় ক্লান্ত-শ্রান্ত মহারাজ ধীরে ধীরে আম্রপালীর প্রাসাদে প্রবেশ করলেন । আম্রকুঞ্জ প্রাসাদ সম্পর্কে এতদিন তিনি যা শুনেছেন তা খুব কম মনে হলো, তার স্ত্রীদের মহলও আম্রকুঞ্জের তুলনায় খুব ছোট ! ভিতরে ঢুকতেই দেখা গেলো অপূর্ব সব চিত্রশিল্প, সেগুলির নীচে নাম লেখা রয়েছে। এদের বেশিরভাগকেই রাজা বিম্বিসার চিনতে পারলেন, সবাই হয় নামকরা সম্রাট, নয়তো প্রসিদ্ধ কবি অথবা বিখ্যাত শিল্পী । হয়তো এই চিত্রশিল্পেরের সবাই আম্রকুঞ্জে কোন না কোন সময় এসেছেন। চিত্রকরের সামনে স্বয়ং বসে না থাকলে এমন নিঁখুত ছবি তৈরী করা কোন চিত্রকরের পক্ষেই সম্ভব নয় ।

চিত্রকর্ম দেখতে দেখতে একটু অন্যমনস্কভাবে বিম্বিসার এক সময় অন্দর মহলে পৌঁছে গেলেন। সামনে তাকাতেই তার চোখ যেন ঝলছে গেল। দেখলেন একটি মেয়ে তাকে অভিবাদন জানালো, সে যেন মাটির পৃথিবীর কোন নারী নয়,স্বর্গের কোন অপ্সরী । সম্রাট এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন, আম্রপালী মুগ্ধ মহারাজাকে হাত ধরে তাকিয়াতে বসিয়ে ক্লাসিকাল সঙ্গীত ও অপূর্ব নৃত্যকলায় সম্রাটকে মুগ্ধ করে রাখলেন । আম্রপালীর সঙ্গীত ও নৃত্যকলায় অসাধারণ দক্ষতায় তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। একসময় তিনিও সেতারের তারে যেন ঝড় বইয়ে দিলেন, সেই ঝড়ের সঙ্গে সম্রাটের সুমধুর কন্ঠ এবার আম্রপালীকে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলল।

আম্রপালী যখন জানতে পারলো ইনিই রাজা বিম্বিসার, তখন সে বিম্বিসারকে তার প্রতিকৃতির সামনে নিয়ে গিয়ে বললো, আমি আপনাকে না দেখেই আপনার ভক্ত হয়ে ভালবেসে ফেলেছি। আজ আপনার সঙ্গীত-সুরেও আমাকে মুগ্ধ করলেন।আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না, সম্রাট বিম্বিসার আজ স্বয়ং আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ।আম্রপালীর রাজ্য বৈশালীতে জানাজানি হয়ে গেল শত্রু রাজ্যের মগধ রাজ তিন দিন ধরে আম্রকুঞ্জে আছেন । খবরটি বৈশালীর রাজাদের কানেও পৌঁছে যায়, গুপ্তচরের মাধ্যমে। তাঁরা বিম্বিসারকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নেয় । বিম্বিসারকে গ্রেফতার করতে এসে রাজার সেনাপতি বিপাকে পড়ে যায়। আম্রপালীর দ্বার রক্ষক আম্রপালী “নগর বধূ”হবার সময় রাজ্যের সাথে সম্পাদিত চুক্তির শর্ত দেখায়।(ঙ) তার বাড়িতে আসা ব্যক্তিদের সম্বন্ধে কোনো অনুসন্ধান করা চলবে না। ৭ দিন আগে তাদের আর আম্রপালীর বাড়িতে ঢোকার সুযোগ নাই। নিজেদের শর্তে নিজেরাই আটকা পরে তারা আম্রকুঞ্জে ঢুকতে ব্যর্থ হয় । তারা আম্রকুঞ্জে ঢোকার ব্যাপারে ৭ দিন আগে কোনই অনুমতি নেয় নি । শর্ত অনুসারে তাদের অনুসন্ধানের কোনও সুযোগ নাই। সেনাপতি তখন আম্রকুঞ্জের বাইরে সিপাহী মজুদের নির্দেশ দেন । আম্রকুঞ্জের বাইরে সৈন্য মোতায়নের বিষয়টি ভিতরে অবস্থানরত বিম্বিসারও জানতে পারে ও তার মন্ত্রী কে ডেকে মগধে যাওয়ার নির্দেশ দেয় । বৈশালী আক্রমণ করে তা দখল করা ছাড়া রাজার আর গত্যন্তর নাই। মগধ থেকে সেনা নিয়ে এসে বৈশালী আক্রমণ করাই তার মূল উদ্দেশ্য। বৈশালী থেকে পালিয়ে চলে যাওয়ার জন্য আম্রপালি সম্রাটকে অনুরোধ করলো । বৈশালী আক্রমন মানেই সাধারণ মানুষের প্রাণ ক্ষয় । চারদিকে ধংস লীলা। আম্রপালী তা চায় না । কিন্তু বিম্বিসার কাপুরুষের মত পালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। অনেক যুক্তি-তর্কের পর শেষ পর্যন্ত তিনি তার মন্ত্রী ও আম্রপালীর কথা মেনে নেন, এবং সেখান থেকে পালিয়ে যান। (চলবে)

(2nd part)

রাজা বিম্বিসারের পর এবার আম্রপালীর জীবনে আসার চেস্টা করে অজাতশত্রু। অজাতশত্রু আবার রাজা বিম্বিসারের ছেলে। কিশোর বয়সেই অজাতশত্রু আম্রপালীর প্রতি তার বাবা বিম্বিসারের তীব্র আসক্তির কথা জানতে পারে। আম্রপালীর দৈহিক সৌন্দর্য্য নিয়ে তার মনে তীব্র কৌতুহলের সৃস্টি হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আম্রপালীকে বিয়ে করার বাসনা তার মধ্যে তীব্রতর হয়ে উঠে। অজাতশত্রু তার বাবা মহারাজ বিম্বিসার ও তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীকে গৃহবন্দী করে নিজেকে মগধের (বিহারের)শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। ৪৯১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গৃহবন্দী অবস্থায় বিম্বিসারের মৃত্যু ঘটে। এই সময় অজাতশত্রু গৌতম বুদ্ধকেও হত্যার চেষ্টা করেন। কথিত আছে, অজাতশত্রু তাঁর বাবা মহারাজ বিম্বিসারকে কারাগারে পাঠানোর পর তিনি পিতার হাত-পা কেটে তাতে নুন এবং অম্ল মাখিয়ে কষ্ট দিতেন। এরপর তাঁকে কয়লার আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন। বিম্বিসার ছিলেন গৌতম বুদ্ধের ভক্ত, তাই বিম্বিসার অন্তঃপুরে বুদ্ধের পায়ের নখ ও চুলের উপর একটি স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। অজাতশত্রু বিম্বিসার মৃত্যুর পর এই স্তূপ পূজা বন্ধ করে দেন। তিনি এই ঘোষণা দেন যে, বুদ্ধের প্রতি কেউ শ্রদ্ধা নিবেদন করলে তার শিরশ্ছেদ করা হবে। একদিন তার বাড়ির দাসী শ্রীমতী এই আদেশ অমান্য করে স্তূপ ধুয়ে সেখানে প্রদীপ জ্বালিয়ে দেন, একারনে রাজার আদেশে তার শিরশ্ছেদ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত “পূজারিণী” কবিতায় এ ঘটনাটির বর্ণনা আছে।

বুদ্ধকে পূজার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার এই কাহিনি নিয়েই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ‘নটীর পূজা’। বিম্বিসার এখানে স্বেচ্ছায় সিংহাসনত্যাগী এবং ছেলের কাছে রাজ্যভার অর্পণকারী। পিতৃহন্তারক অজাতশত্রু এই নাটকে কেবলই রাজা। “পূজারিণী”কবিতাটির মূল ভাব অবলম্বন করে নটীর পূজা নৃত্যনাট্য টি রচনা করা হয়। পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নটীর পূজার কাহিনি অবলম্বনে সিনেমাও বানান।এটি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিচালিত একমাত্র চলচ্চিত্র (১৯৩২)। পূজারিণী কবিতা নিয়ে ‘শেষ আরতি’ নামেযাত্রা পালাও রচিত হয়।

ইতিহাসকুখ্যাত অজাতশত্রু আক্রমণ করেছিলেন বৈশালী, তাঁর হাতে বন্দি হন আম্রপালী | বন্দিনী নগরবধূর রূপে মুগ্ধ অজাতশত্রু পুড়িয়ে দিয়েছিলেন গোটা বৈশালী | শুধু আম্রপালীর কারাগার বাদ দিয়ে | নগরবাসীর এই অবস্থা দেখে বিধ্বস্ত হয়েছিল বৈশালীর রাজ নর্তকী আম্রপালী | কিন্তু সে মগধ রাজাদের কুক্ষিগত হয়নি | অজাতশত্রু প্রজাদের গৌতম বুদ্ধের কাছে যাওয়া নিষেধ করে দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পিতাকে হত্যা করার জন্য দারুন মনোকষ্টে ভুগতেন। এই পরিতাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি বুদ্ধের সাথে দেখা করেন। তিনি গৌতম বুদ্ধের সাথে দেখা করে দীর্ঘ আলাপ করেছিলেন । তিনি বুদ্ধের কাছে পিতৃহত্যার কথা স্বীকার করে তার প্রতিকার প্রার্থনা করেছিলেন।

আম্রপালীর কথাতেই ফিরে আসি—- আম্রপালীর কাছে সবাই প্রেম-ভিক্ষা করতো । কেউ পেত কেউ পেত না। এই আম্রপালী একবার এক সাধারণ মানুষের কাছে প্রেম-নিবেদন করে ব্যর্থ হয়। এ ঘটনা আম্রপালীর জীবনের মোড়ই ঘুরে দেয়। আম্রপালী এক বর্ষাভেজা দিনে তার ”আম্রকুন্জ “প্রাসাদের বরান্দা থেকে দেখল, এক বৌদ্ধ তরুণ সন্ন্যাসীকে | তাঁর রূপে মুগ্ধ হল বৈশালীর রাজনর্তকী| ভাবলো যেভাবেই হোক একে বশ করতেই হবে, দেশ বিদেশের মন্ত্রী বা রাজারা তার পায়ের কাছে পড়ে থাকে | আর এ তো সামান্য এক তরুণ সন্ন্যাসী | রাজা বিম্বিসারের রাজ্যে জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম উভয় ধর্মই বিকাশ লাভ করেছিল। মহাবীর জৈন, গৌতমবুদ্ধ এবং রাজা বিম্বিসার প্রায় সমকালীন ব্যক্তিত্ব। রাজা বিম্বিসার বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেও জৈনধর্মসহ সে সময়ে প্রচলিত অন্যান্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।

সম্রাট বিম্বিসার গৌতম বুদ্ধের চেয়ে পাঁচ বছর ছোট ছিলেন। বোধিলাভের ( পরম জ্ঞান) সাত বছর আগে গৌতমের সঙ্গে বিম্বিসারের দেখা হয়।সাক্ষাতের সময় গৌতম নিজেকে শাক্য বংশ এর রাজকুমার হিসেবে পরিচয় দিলে বিম্বিসার তাঁকে তার রাজধানীতে বসবাস করার জন্য অনুরোধ করেন। গৌতম তা প্রত্যাখ্যান করেন । তিনি রাজা বিম্বিসারকে বলেন, ‘মহারাজ! আমি সুখপ্রার্থী নই। আমি কপিলাবস্তুর রাজা শুদ্ধোদনের পুত্র। বুদ্ধত্ব লাভের আশায় আমি সবকিছু ত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছি। রাজা বলেন, ‘বৎস! আপনার পিতা আমার পরম মিত্র। আপনার উদ্দেশ্য জেনে আমি খুব খুশি হয়েছি। যদি আপনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন আমাকে একবার দর্শন দেবেন। আমি আপনার সেবা করব, আপনাকে বন্দনা করব।’ রাজা বিম্বিসারের কথায় সিদ্ধার্থ সম্মতি জানিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে যান। তবে তিনি বোধিলাভ (পরম জ্ঞান) করতে পারলে বিম্বিসারের কাছে ফিরে আসবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্য গৌতম বুদ্ধ বোধিলাভের দুই বছর পরে বিম্বিসারের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় রাজা বিম্বিসারের বয়স হয়েছিল ঊনত্রিশ বছর। সাক্ষাৎ এর দিনই বিম্বিসার বৌদ্ধ সংঘের এক হাজারেরও বেশি ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য বেণুবন নামের একটি উদ্যান গৌতম বুদ্ধকে উপহার দেন। বিম্বিসারের অনুরোধে বুদ্ধ অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে উপোসথ ( উপবাস) ব্রত পালনের বিধি প্রচলন করেন। আবার, বিম্বিসারের অনুরোধেই বুদ্ধ বর্ষাকালে পরিব্রাজন না করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে ”সাধনার বর্ষাবাস “নামে এক রীতি প্রচলন করেন।

রাজা বিম্বিসারের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন জীবক। তিনি খুবই বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। রাজার আদেশে তিনি বুদ্ধ ও ভিক্ষুসঙ্ঘের চিকিৎসা করতেন। তাঁদের স্বাস্থ্য পরিচর্যার বিষয়ে তিনি সব সময় সচেতন থাকতেন। ভিক্ষুরা আগে পুরাতন ও পরনের ছাডা কাপড় ধুয়ে শুকিয়ে সেলাই করে পরতেন । এতে ভিক্ষুদের অনেক রকম রোগ হতো। চিকিৎসক জীবক ভিক্ষুদের নীরোগ জীবন চিন্তা করেন এবং নতুন কাপড় পরার বিধান দিয়েছিলেন। এরপর থেকে রাজা বিম্বিসারও ভিক্ষুদের নানা অনুষ্ঠানে নতুন কাপড় দান করতেন। এভাবে রাজা বিম্বিসার বৌদ্ধধর্মের প্রচার-প্রসারে অবদান রাখেন। যাই হোক, রাজা বিম্বিসারের পরামর্শে গৌতম বুদ্ধ ও তার অনুসারীরা বর্ষাকালে কোথাও ভ্রমণ করতেন না।বর্ষায় তাঁরা পরিব্রাজন করতেন না।| আশ্রয় নিতেন কোনও নগরের উদ্যানে, নগরবাসীর বাড়িতে ।

সেবার বর্ষায় আম্রপালীর বাসস্থান বৈশালী নগরীতে এসেছেন বৃদ্ধ তথাগত (গৌতম বুদ্ধ)| সঙ্গে কয়েকশো শ্রমণ (অল্প বয়সী বৌদ্ধ ভিক্ষুকে শ্রমণ বলা হয়)। বর্ষার চারমাস এখানেই কাটাবেন তাঁরা। এক তরুণ সন্ন্যাসী আম্রপালীর দরজায় ভিক্ষা প্রার্থী । বৌদ্ধ তরুণ সন্ন্যাসীকে খুব মনে ধরলো আম্রপালীর, ভাবলেন—যেভাবেই হোক একে বশ করতেই হবে। দেশ বিদেশের মন্ত্রী বা রাজারা তার পায়ের কাছে পড়ে থাকেন | আর এ তো সামান্য এক তরুণ সন্ন্যাসী, আম্রপালী নিজে তাঁকে ভিক্ষা দিল। এত বছর আম্রপালী শুধু আহ্বান পেয়েই এসেছে। তার সামান্য দর্শন পেলেই সবাই ধন্য হয় সেই আম্রপালীই এ তরুণ বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আহ্বান জানাল তাঁর প্রাসাদে অবস্থান করে বর্ষা অতিবাহিত করার জন্য। কিন্তু সন্ন্যাসী বা বৌদ্ধ শ্রমণদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের কোন অনুমতি ছিল না। তথাগত (গৌতম বুদ্ধ) তাদের সে অনুমতি দেননি। বৈশালীতে যে বাড়িতে তিনি আতিথ্য নিয়েছিলেন, তরুণ ভিক্ষু সেখানে গিয়ে তাঁর কাছ আম্রপালীর প্রাসাদে ৪ মাস থাকার জন্য অনুমতি চাইলেন |

বুদ্ধের সামনে উপস্থিত সবাই তরুণ ভিক্ষুর বোকামী দেখে অবাক হয়ে গেলেন। কারন সবাই জানেন তথাগত (গৌতম বুদ্ধ) কোনও দিনও একজন পতিতার বাড়ীতে তাকে অবস্থানের অনুমতি দিবেন না। কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে তথাগত (গৌতম বুদ্ধ) অনুমতি দিলেন । এই নিয়ে বৌদ্ধ সঙ্ঘে রীতিমত আলোচনা-সমালোচনা শুরু হল | আম্রপালী নামের এক পতিতার বাড়িতে থাকবেন বৌদ্ধ ভিক্ষু ? বুদ্ধ তাঁদের বললেন, এই তরুনের চোখে তিনি কোনও কামনা -বাসনা দেখতে পাচ্ছেন না । তথাগত (গৌতম বুদ্ধ) সবাইকে বললেন বর্ষা শেষে সে নিষ্কলুষ হয়েই যে তাঁর কাছে ফিরবেন , এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। সবাই বললো এটা হবে তার জন্য অগ্নিপরীক্ষা । সবাই বললো আম্রপালীর কাছ থেকে নিষ্কলুষ অবস্থায় ফেরা অসম্ভব। বর্ষার চার মাস সময় পার হয়ে গেল। বৈশালীতে যাঁরা ছিলেন তারা সবাই একে একে সমবেত হলেন বুদ্ধর কাছে | বর্ষার ৪ মাস শেষ হবার পর তথাগতের সামনে এসে দাঁড়ালেন সে সেই তরুণ ভিক্ষু, তথাগত(গৌতম বুদ্ধ) এর সামনে ।নগরবধূর প্রাসাদে তিনি চার মাস কাটিয়েছেন, কিন্তু তিনি আগের মতোই নিষ্কলুষ | ।

বর্ষা শেষে ভক্ষুরা সবাই সমবেত হয়েছে , তাদের নতুন গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু করতে হবে। এমন সময় দেখা গেল হলুদ কাপড় পরা আম্রপালীকে, তার চাঁপাফুলের মতো আঙুল জড়ো করে তিনি প্রণাম করলেন তথাগত বুদ্ধকে। জানালেন, তিনি তরুণ শ্রমণকে প্রলুব্ধ করতে কোনও চেষ্টা বাকি রাখেননি, কিন্তু এই প্রথম কোন পুরুষকে বশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বৈশালীর নগরবধূ আম্রপালী | উল্টো আম্রপালীকেই বশ করেছেন সর্বত্যাগী তরুণ ভিক্ষু। শেষপর্যন্ত, সবকিছু ছেড়ে তথাগত বুদ্ধের চরণে আশ্রয় চান আম্রপালী | একবার রক্ষণশীল সমালোচকদের মুখের উপর জবাব দিয়ে, নগরবধূ আম্রপালীর অতিথি হয়ে তাঁর হাতে অন্নগ্রহণ করেছিলেন তথাগত বুদ্ধ |আম্রপালি নিজের সব সম্পত্তি, প্রাসাদ, উদ্যান বৌদ্ধ সঙ্ঘে দান করে দিয়েছিল | মোহমুক্ত হয়ে বাকি জীবন উৎসর্গ করেছিল বৌদ্ধ সঙ্ঘারামে | সে তথাগতকে অনুরোধ করে ভিক্ষুণীদেরও সঙ্ঘে নিতে, বুদ্ধ প্রথমে এতে রাজি হননি কিন্তু আম্রপালীর কথায় তিনি পরে এটা মেনে নেন।জীবনের বাকি অর্ধেকটা বৌদ্ধ সঙ্ঘেই অর্পণ করেছিল আম্রপালী |

১৯৭৮ সালে ভারতের আম গবেষকরা দশোহরি ও নিলাম এই দুটি আমের মধ্যে সংকরায়নের মাধ্যমে একজাতের আম উদ্ভাবন করেন, নাম দেন আম্রপালী। বিস্তারিত জানতে রেফারেন্স হিসেবে জৈন ধর্মগ্রন্থ , তিব্বতীয়ান গ্রন্থাদি ,অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ , বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ,হিউইয়েন সাং এর বর্ণনা , The age of imperial unity, পালি ভাষায় লেখা আম্বপালিকাসূত্র , ইন্টারনেট দেখা যেতে পারে। এছাড়াও ১৯৬৬ সালে হিন্দী ভাষায় মুক্তিপ্রাপ্ত লেখ ট্যান্ডন পরিচালিত ‘আম্রপালী’ নামের সিনেমাও তৈরি হয়েছে। আচার্য চতুর্সেনের ‘বৈশালী কি নগরবধূ’ ও অনুরাগ আনন্দের ‘The legend of Amrapali’ তাঁকে নিয়ে রচিত দুটি বিখ্যাত উপন্যাস ।

#তথ্যসূত্র #বঙ্গনিউজ_ডট_কম