৬৩৮ সালের কোন এক সকাল। হয়তো বৃষ্টি ভেজা ছিল দিনটি। কে জানে, আকাশও বোধহয় ছিল মেঘাচ্ছন্ন। সম্ভবত, আবারো বৃষ্টি হবে হবে করছিলো মুখ ভার করা ধরণী। ইতিহাস এসব লিখে রাখে নি। কিন্তু লিখে রেখেছে, ১৪ বছরের এক কিশোরী এমনই এক সকালে চীন দেশের চ্যাং’আন (Chang’an) শহরের ট্যাং রাজবংশের (Tang Dynasty) বিশাল রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়েছিল। তাঁর নাম উ. জেটিয়ান (Wu Zetian)। উ’কে আনা হয়েছে সম্রাট তাইজংয়ের (Taizong) এক কনিষ্ঠ রক্ষিতা হিসেবে। ইতিহাস সেদিন জানতো না, একদিন এই রক্ষিতা উ. জেটিয়ানই হয়ে উঠবেন চীনের দুই হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম এবং একমাত্র নারী রাষ্ট্রপ্রধান। আমাদের দেখতেই হবে, একজন নারী হয়ে এই অপরাজিতার চীন রাজ্যের ক্ষমতার শিখরে আহরণের সেই নাটকীয় এডভেঞ্চার।

প্রাসাদে আসার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই একশোর মতো রক্ষিতাকে অতিক্রম করে কিশোরী উ. জেটিয়ান হয়ে উঠে বৃদ্ধ সম্রাট তাইজংয়ের সবচেয়ে প্রিয় রক্ষিতা। ৬৪৯ সনে সম্রাট তাইজংয়ের মৃত্যুর পর তার নবম সন্তান গাওজং (Gaozhong) হয় ট্যাং সাম্রাজ্যের নতুন অধিপতি। তাইজংয়ের মৃত্যুর পর রীতি অনুযায়ী তার সকল রক্ষিতাকে নির্বাসনে পাঠানো হয় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারে। উ’কেও নির্বাসনে যেতে হয় এক বৌদ্ধ মন্দিরে।

 

কিন্তু উ’কে খুব বেশীদিন থাকতে হয়নি এই নির্বাসনে। ধারণা করা হয়, সম্রাট তাইজংয়ের জীবদ্দশায়ই গাওজংয়ের সাথে উ’র প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। অচিরেই নতুন সম্রাট গাওজং উ’কে নিয়ে আসে রাজপ্রাসাদে। উ খুব দ্রুত হয়ে উঠেন গাওজংয়ের সবচেয়ে প্রিয় রমনী। ধীরে ধীরে উ পরিণত হন রাজপ্রাসাদের একজন ক্ষমতাধর নারীতে।

ক্ষমতাকে ধরে রাখতে উ এক এক করে তার সম্ভাব্য সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিতাড়িত করেন রাজপ্রাসাদ থেকে। ক্ষমতার জন্য উ ছিলেন বেপরোয়া এবং নির্মম। রাজপ্রাসাদে উ’র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সম্রাট গাওজংয়ের আরেক স্ত্রী, নাম তার ওয়াং। ৬৫৪ সালে, উ জন্ম দেয় এক কন্যা সন্তানের। অনেকের ধারণা, উ নিজেই গলা টিপে তাঁর সন্তানকে হত্যা করে দোষ চাপিয়ে দেন ওয়াংয়ের উপর। সম্রাট গাওজংয়ের বিশ্বাস, ওয়াংই হত্যা করেছে উ’র সন্তানকে। প্রাসাদ থেকে বের করে দেওয়া হয় উ’র শেষ প্রতিদ্বন্দ্বীকেও। কিছুদিনের মধ্যেই উ’র ভাগ্য হয় আরো সুপ্রসন্ন। ৬৫৫ সালে সম্রাট গাওজং বিয়ে করে উ’কে। বিয়ের পরপর উ নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন, উ ঝউ (Wu Zhou)।

উ’র জন্ম ৬২৪ সালে চীনের এক ধনী পরিবারে। পিতার উৎসাহে উ’র আগ্রহ বাড়ে পড়াশুনায়। অল্প সময়ের মধ্যে উ পড়ে ফেলেন অনেক মূল্যবান গ্রন্থ। তখনকার সময়ে পরিবার থেকে কখনও পড়ালেখার জন্য নারীদের উৎসাহিত করা হতো না। যখন রাজপ্রাসাদ থেকে উ’র ডাক এলো, তার মা ইয়াং ভেঙে পড়লো কান্নায়। উ তাঁর মাকে সান্তনা দিলো এ বলে, “রাজপ্রাসাদে যাবার এই ডাক আমার জন্য স্বর্গের দেখা পাবার এক সুবর্ণ সুযোগ”। উ’র মা নিমেষেই বুঝে ফেললো উ’র উচ্চাশা। কান্না থামিয়ে মা ইয়াং বিদায় দিলেন উ’কে সেই বৃষ্টি ভেজা মেঘাচ্ছন্ন সকালে।

বিয়ের পর সম্রাট গাওজং হয়ে পরে অসুস্থ। স্বাভাবিকভাবেই সাম্রাজ্যের প্রকৃত শাসন চলে উ’র নির্দেশনায়। রাজ দরবারের পুরোনো এবং বিশ্বস্ত উচ্চপর্যায়ের কর্মচারীরা উ’র মতো রক্ষিতাকে, যে কিনা ছিল বর্তমান সম্রাটের প্রয়াত পিতারও রক্ষিতা, কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না সম্রাজ্ঞীর আসনে। দেখা দেয় শীতল যুদ্ধ। উ কেউকে করেন নির্বাসন, কেউ হারায় রাজ দরবারের চাকুরী, আবার কারো ভাগ্যে জুটে গুপ্তহত্যা। এমনকি সম্রাটের আপন চাচাকেও রেহাই দেওয়া হয় নি তাঁর বিরোধিতা করায়। হত্যা করা হয় তাকে এবং উচ্ছেদ ও নিঃস্ব করা হয় তার পরিবারকে। ৬৬০ সালের মধ্যেই উ তাঁর বিরোধীদের দমন করে ফেলেন সম্পূর্ণভাবে। ক্ষমতা নিষ্কন্টক করতে, উ’কে হতে হয় নির্দয় এবং কঠোর।

উ’র শাসনকালে শুধুমাত্র কঠিন পরীক্ষায় পাশ করে রাজ কর্মচারী হওয়া যেত। মেধাবীরাই পেতো সরকারী চাকুরী। উ বেছে বেছে নিষ্ঠাবান এবং কর্মঠ মেধাবীদের নিযুক্ত করেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপুর্ণ পদে। সাথে সাথে কঠিনভাবে দমন করতে থাকেন বিরোধীদের। অচিরেই উ হয়ে উঠেন একজন অত্যন্ত দক্ষ ও পারদর্শী শাসক। উ তাঁর বুদ্ধিমত্তা, কৌশল এবং চতুরতায় ট্যাং সাম্রাজ্যর বিস্তার ঘটান অনেক। দখল করে ফেলেন অনেক দেশ।

উ এবং গাওজংয়ের ছিল চার পুত্র এবং এক কন্যা। ৬৮৩ সালে স্বামী গাওজংয়ের মৃত্যু হলে উ’র পুত্র লি শিয়ানকে সম্রাট ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় লি’র স্ত্রীকে নিয়ে। লি’র স্ত্রীর সাথে উ’র শুরু হয় ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব। এক মাসের মধ্যেই ক্ষমতা থেকে লি’কে নামিয়ে দেন উ। লি ও তার পরিবারকে পাঠানো হয় নির্বাসনে। উ’র ইচ্ছায়, নিজের পুত্র লি’কে বাধ্য করা হয় কারাগারে আত্মহত্যা করতে। ট্যাং সাম্রাজ্যের সম্রাট করা হয় উ’র আরেক পুত্র লি ডানকে (রুইজং নামেই বেশী পরিচিত)। লি ডানের হয়ে দেশ শাসন করতো আসলে উ। বিরোধীদের দমন করার জন্য উ ৬৮৬ সালে গঠন করেন এক গোপন পুলিশ বাহিনী ।

৬৯০ সালে, অবশেষে উ ঝউ নিজেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সাম্রাজ্যের অধিপতি ঘোষণা করেন। ট্যাং রাজবংশের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখা হয় ঝউ রাজবংশ (Zhou Dynasty)। উ পরবর্তী পনেরো বছর চীনের এক বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেন নির্বিগ্নে। উ’র শাসন আমলে নারীদের সম্মান এবং স্বাধীনতা ছিল চরমে। ঐ সময় নারীর অধিকার ছিল পুরুষদের মতো। নারীরা পছন্দ মতো কোনো পুরুষকে বিয়ে, এবং অনায়াসে স্বামীকে ত্যাগ করতে পারতো। তাঁর সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এক নারী, নাম সাংগুয়ান। উ প্রমান করে দেন যে, শাসন ব্যবস্থায় উচ্চপর্যায়ে পুরুষ ছাড়াও বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা করা যায় নারীদের দিয়ে।

উ’র সময় চীন হয়ে উঠে এক অত্যন্ত সম্পদশালী সাম্রাজ্যে। উ’র বিস্তৃত সাম্রাজ্যর সাথে তখন বাণিজ্য এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় দূর-দূরান্তের অনেক দেশের সাথে। উ’র প্রভাব বিস্তৃত হয় জাপান থেকে মধ্য প্রাচ্য পর্যন্ত। উ ছিলেন তখন আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত সম্মানিত রাষ্ট্র প্রধান। এই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কারণে মূল্যবান রত্ন আনা হতো তিন হাজার মাইল দূরের ভারত থেকে, আম্বর আমদানী করা হতো চার হাজার মাইল দূরের ইরান থেকে, হাতির দাঁত আনা হতো চার হাজার পাঁচশো মাইল দূরের শ্রীলংকা হতে। উ’র সময় চীনের সমাজ ছিল সবার জন্য উম্মুক্ত। রাজধানী চ্যাং’আনে (Chang’an), বর্তমানে Xi’an নাম পরিচিত, বসবাস করতো প্রায় পঁচিশ হাজার বিদেশী। চীনের সিল্ক তখন ছিল বিশ্বের কাছে আকর্ষণীয়। বিভিন্ন দেশে সিল্কের পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হতো সিল্ক রোড। এই সড়কগুলো প্রায়ই দস্যুরা হামলা করে সব লুট করে নিতো। সিল্ক সড়কগুলোকে নিরাপদ করার জন্য সড়কে সড়কে উ গড়ে তোলেন নিরাপত্তা ঘাঁটি।                             

উ জনগণকে সন্তুষ্ট করার জন্য স্থানে স্থানে গড়ে তোলেন অনেক বৌদ্ধ মন্দির এবং পেগোডা। উ’র সরাসরি তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করা হয় বিশ্বের এক বিস্ময়, লংম্যান গ্রোটোস (Longmen Grottoes)। পাহাড়ের পাদদেশ খনন করে সৃষ্টি করা এক হাজারেরও বেশী গুহা, যা’র প্রত্যেকটির মধ্যে ছিল একটি করে বুদ্ধার পাথরের মূর্তি। সবচেয়ে বড়ো মূর্তিটির মুখমন্ডল করা হয় উ’র চেহারার আদলে। উ চেয়েছিলেন নিজেকে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে, করেছিলেনও তাই। উ ছিলেন একজন সুদক্ষ কৌশলী শাসক। জনসাধারণের কাছে উ ছিলেন খুব দয়ালু, কিন্তু তাঁর শত্রুর কাছে ছিলেন নির্মম। উ ভালোভাবেই জানতেন কি করে সাধারণ মানুষের মন জয় করা যায়। সম্রাজ্ঞী উ চীনে দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে তাঁর সাম্রাজ্যে গড়ে তোলেন ২৮৭টি বিশাল শষ্যগার। তাঁর শাসনামলে দুর্ভিক্ষ হতে দেন নি উ। তিনি নির্মাণ করেন ড্যামিং প্রাসাদ (Daming Palace), বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাজপ্রাসাদ।

৭০৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে উ’র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে একদল সামরিক এবং বেসামরিক কর্মচারী, দখল করে নেয় রাজপ্রাসাদ। ৭০৫ সালের ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ, ৮০ বছর বয়সে উ মৃত্যু বরন করেন অসুস্থ অবস্থায়। ডিসেম্বরের বিকেলে চীনের বর্তমান Xi’an শহরের গোল্ডেন টেম্পলে সমাহিত করা হয় উ’কে। ইতিহাস হয়তো লিখে রাখে নি, সে সময় বৃষ্টি হয়েছিল কিনা, আকাশ মুখ ভার করে ছিল কিনা। কিন্তু ইতিহাস ঠিকই লিখে রেখেছে যে, চীনের বিশাল সাম্রাজ্যের প্রথম ও একমাত্র নারী অধিপতি উ, জেটিয়ান তাঁর কৃত কর্মের জন্য অনুতপ্ত ছিলেন সবসময়। তাঁর সব কর্মের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল সাধারণ মানুষের ভালো করা, দেশকে উন্নত করা।

অনুতপ্ত ছিলেন বলেই, উ ‘র ইচ্ছায় তাঁর সমাধিতে রাখা হয় একটি অক্ষরবিহীন ফলক যাতে লেখা ছিল না কিছুই। ইতিহাসবিদদের জন্য রাখা হয় এই অলিখিত ফলক। উ বিশ্বাস করতেন যে, তাঁকে এবং তাঁর শাসনকালকে মূল্যায়ন করবে বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদরা। তাই রেখে যান এই অক্ষরবিহীন ফলক ভবিষৎ প্রজন্মের কাছে।

সম্রাজ্ঞী উ’কে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে ভুলভাবে উপস্থাপিত এক রাষ্ট্র প্রধান। উ’র মৃত্যুর পর গত ১৩০০ বছর উ’কে উপস্হাপনা করা হয়েছে একজন নির্দয় ও অত্যাচারী শাসক হিসেবে। করা হয়েছে তাঁর জনহিতকর কাজগুলোকে পুরোপুরি উপেক্ষা। কিন্তু আমাদের অতি-নিকট বর্তমানে আবিষ্কৃত ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখায় অন্য চিত্র। ইতিহাস কথা বলবেই, সত্যকে তুলে আনবেই। এনেছেও তাই।

তথ্যসূত্র:

* “The Empress Who Ruled The World” (Chinese History Documentary), Timeline, produced by True North.

* D. Dien: Empress Wu Zetian in Fiction and in History: Female Defiance in Confucian China. Nova Science Publishers, 2003.

ছবি:

* ইন্টারনেট