আয়না দিয়ে আমরা নিজে কে দেখতে পাই। আয়না আবিষ্কার না হলে জানাই যেত না নিজের চেহারা দেখতে কেমন। পানির মধ্যে নিজের ছায়া দেখে মানুষ প্রথম জানতে পারে সে কি রকম দেখতে। আয়না নিয়ে অনেক গল্প-গাথা ছড়িয়ে আছে l আছে অনেক রুপকথা, কুসংস্কার আর অভিশাপের কাহিনী দেশে দেশে l আজ আমরা জানব সেই সব চমকপ্রদ কিছু কাহিনী আর কি ভাবে আবিষ্কার হল আয়না তাও জানব।
জাপানি রুপকথায় আছে-একদিন ভোরবেলা সূর্য দেবতা কোন কারণে খুব রেগে যেয়ে নিজেকে গুহার মধ্যে লুকিয়ে ফেলেন আর তখন সারা পৃথিবীতে নেমে আসে অন্ধকার। পৃথিবীর সব গাছপালা, প্রাণী সূর্যের রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু কিছুতেই সূর্যের রাগ ভাঙছিল না। তখন গুহার সামনে একটা চকচকে রুপোর আয়না ধরা হয়, আয়নায় সূর্য তার রাগি চেহারা দেখে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিল না যে এটা সত্যিই তার চেহারা কি-না! নিজেকে ভাল ভাবে দেখবার জন্য গুহা থেকে সূর্য আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলে, গুহার মুখ পাথর দিয়ে বন্ধ করা হয়।
সূর্য দেব আর গুহায় প্রবেশ করতে পারে নি, আর সেই থেকে আজও জাপানের আকাশে সূর্য মামা রয়ে গিয়েছে। রেনার্ড দ্য ফক্স রুপকথা সিরিজে রেনাও নামের শেয়ালের কাছে ছিল এমন এক ধরণের আয়না যা দিয়ে এক মাইল দূরের জিনিস দেখা যেত। আইরিশ সাহিত্যিক গোল্ডস্মিথের গল্পে আশ্চর্য চীনা আয়নার সাহায্যে যে কোন মানুষের মন এবং সে কি ভাবছে তা বলে দেয়া যায়। ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের দ্য ক্যান্টাবেরি টেমস গল্পমালায় আছে একটি আয়নার কথা,সে আয়না দেখে টারটারির রাজা আগে থেকে বলতে পারেন ভবিষ্যতে কি ঘটবে।
হারানো বা গোপন স্থানে থাকা কোন ব্যাক্তি বা বস্তুর অবস্থান নিখুঁত ভাবে নকি বলে দিতে পারে জাদুর আয়না। আয়না দিয়ে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ দেখার কথাও অনেকে জানেন। প্রাচীন রোমে এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যদি কোন পুরনো আয়না কারো হাতে ভেঙ্গে যায় তাহলে তার পরবর্তি ৭ বছর তার জীবন দূর্ভাগ্যে কাটবে। জিউসের লোকজন বাড়িতে কারো মৃত্যু হলে বাড়িতে থাকা সব আয়না ঢেকে রাখত, তাদের বিশ্বাস ছিল মৃতদেহ থেকে আত্মা কে বন্দি করার ক্ষমতা রয়েছে আয়নার। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো যে আয়না সেটা পাওয়া গিয়েছিল আনাতোলিয়ার ধ্বংসাবেশ থেকে, এটি বর্তমানে তুরস্কে অবস্থিত। মিশর,মেসোপটিমিয়ার পরে চীন দেশেও আদি আয়নার উৎস খুঁজে পাওয়া যায়।
যে আয়নায় আমরা এখন নিজেদের কে দেখতে পাই তা উৎপত্তির শুরুতে এখনকার মতো ছিল না। আজকের আয়নার এই রুপে পৌছানোর পেছনে রয়েছে নানা চিন্তাভাবনা আর গবেষণা। স্বচ্ছ কাচের আয়নার ধারণা এসেছে অনেক পরে। কাচের বদলে তামা, সোনা, ব্রোঞ্জ, রুপার চকচকে পৃষ্ঠ কেই আয়না হিসেবে ব্যবহার করা হত। তখনকার সময়ে দামি আয়নাগুল মুখ দেখার চেয়ে লোক দেখাতেই বেশি জনপ্রিয় ছিল। আয়নাগুল সাধারণের নাগালের বাইরে ছিল এবং শুধুমাত্র অবস্থাপন্ন পরিবার গুলোতেই শোভা পেত। বাড়িতে আয়না আছে কি না তা দিয়ে আর্থিক অবস্থা অনুমান করা হতো।
জার্মান রসায়নবিদ জাস্টিন ডন লাইবিক ১৮৩৫ সালে স্বচ্ছ কাচের এক পাশে টিন ও পারদের প্রলেপ দেওয়ার কৌশলটি আবিষ্কার করেন এই কৌশলটিই ছিল আয়না আবিস্কারের মূল বিষয়। পরবর্তিকালে এ পদ্ধতির সাহায্যে বাণিজ্যিক ভাবে আয়না উৎপাদন শুরু হয়। ধীরে ধীরে সাধারণ জনগনের নাগালের ভেতর আসতে শুরু করে আয়না। গ্রিক গাণিতবিদ ইউক্লিড আয়নার ভেতর আলো প্রবেশ করালে আলোর কি কি ধরণের পরিবর্তন আসে তা সূত্রকারে লিখে রাখেন। এই সূত্রের ভিত্তিতে আর্কিমিডিস অবতল আয়না তৈরি করেন। স্যার আইজাক নিউটন ১৬৬৮ সালে টেলিস্কোপ তৈরি করেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও নিখুঁত আয়না লাগানো আছে ক্যালিফোর্নিয়ার পালমোর পাহাড়ের মাথায় ২০০ ইঞ্চি হেল টেলিস্কোপের মধ্যে। যার ওজন প্রায় সাড়ে চৌদ্দ টন আর সূক্ষ্মতা হলো দশ লাখ ভাগের এক ভাগ। এ টেলিস্কোপের মাধ্যমে অগনিত আলোকবর্ষ দুরে যে সব মহা জাগতিক বস্তু রয়েছে তা জ্যোতিবিদরা খুব সহজে দেখতে পান।
রোমান রণতরি যখন সিরাকাস আক্রমনে এগিয়ে আসছিল তখন আয়নার ওপর সূর্যের আলো কেন্দ্রিভূত করে অস্ত্রের সাহায্য ছাড়াই সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। টলেমি ফারাসে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে এমন এক বিশাল আয়না লাগান যার মাধ্যমে এক মাইল দূর থেকে শত্রু পক্ষের জাহাজ কে চেনা যায়।
জাপানিরা দুষ্কৃতকারীদের অপরাধের হদিশ পাবার জন্য যখন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করত তখন তাদের সামনে আয়না রাখা হত। সত্য বা মিথ্যা বলার সময় মুখের যে পরিবর্তন হতো তা তারা আয়নার মাধ্যমে বুঝতে চেষ্টা করত। এ যেনো এক লাই ডিটেকটর l আয়না শুধু অবয়ব কে প্রতিফলিত করে না শব্দও প্রতিফলিত করে,এই ধরনের আয়না কে বলা হয় ‘অ্যাকুইস্টিক মিরর’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনে শত্রু পক্ষের বিমানের শব্দ তরঙ্গ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত হত এই ধরণের আয়না।