Choto Shona Masjid

মধ্যযুগের স্বাধীন সুলতানী আমলের (১৩৩৮-১৫৩৮) মধ্যে এই বাংলার স্বর্নযুগ ছিলো “ইলিয়াস শাহী” ও “হোসেন শাহী” বংশের সময়।ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ। দুই পর্যায়ে ইলিয়াস শাহী বংশের যোগ্য শাসকেরা প্রতাপের সাথে এ বাংলা শাসন করেন।এর পরবর্তীতে বাংলায় স্বল্প স্থায়ী, কুখ্যাত “হাবশী বংশের” অরাজক শাসনকে উচ্ছেদ করে বাংলার মসনদে বসেন ”হোসেন শাহী” বংশের স্থপতি সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ। তিনি একজন বহুপ্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। একজন দক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের সমস্ত গুনাবলীই তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিলো। প্রখ্যাত ইতিহাসবীদ ড: আবদুল করিম প্রাক-মোগল যুগে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ও তাঁর বংশের শাসনামলকে স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করেছেন।এ সময়ে বাংলা রাজনৈতিকভাবে আরোও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। হোসেন শাহের শাসনামলের অনেক, মূদ্রাসহ বহু ঐতিহাসিক কীর্তি পরবর্তী সময়ে আবিস্কৃত হয়েছে।

Coins of the Middle Ages

হোসেন শাহ আদতে একজন বহিরাগত ছিলেন, যিনি জীবিকার খোঁজে বাংলায় এসেছিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিলো সৈয়দ হোসেন।রিয়াজ-উস-সালাতীন এর বর্ননা অনুসারে, তিনি তুর্কিস্তানের তিরমিজ (বর্তমানে উজবেকিস্তানে) প্রবাসী সৈয়দ আশরাফ আল মক্কীর সন্তান ছিলেন।যদিও তাঁর নামের সাথে “সৈয়দ” দেখে ফিরিশতা, সালিমের মত ঐতিহাসিকগণ তাঁকে আরব বংশদ্ভূত বলে মনে করেন।তবে তিনি ঠিক কিভাবে, কোথা হতে বাংলায় এসে একজন গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তিত্বে পরিণত হন সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায় না।ধারণা করা হয় তিনি ইলিয়াস শাহী বংশের অন্যতম বিখ্যাত সুলতান রোকনুদ্দিন বারবক শাহের আমলে তাঁর পিতা ও ভাইকে নিয়ে বাংলায় আসেন এবং সুলতানের অধীনে চাকুরী গ্রহন করেন।এরপর বারবক শাহের ভাই ফতেহ শাহ্ ক্ষমতা লাভের জন্য গোপনে যখন প্রস্তুতি নিতে থাকেন, তখন সম্ভবত হোসেন শাহ তাঁর পক্ষ অবলম্বন করেন। তখন থেকেই তিনি বাংলার ক্ষমতার পালাবদলের রাজনীতি সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ইলিয়াস শাহী বংশকে উৎখাত করে বাংলার মসনদে আসীন হয় হাবশীরা। এই হাবশীরা আসলে আবিসিনিয়ার অধিবাসী। তারা ছিলো দাস।সুলতান রোকনুদ্দিন প্রায় আট হাজার আবিসিনিয়ান দাসকে তাঁর সেনাবাহিনী সহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে নিযুক্ত করেন।পরবর্তীতে এরা রাজনীতিতে অংশ নেয়া শুরু করে এবং একসময় এতটাই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে তাঁরা সুলতানকে হত্যা করে মসনদ দখল করে।অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মত হচ্ছে যে, এই হাবশী সুলতানদের শাসানামল খুব গোলযোগপূর্ণ ছিলো। তাঁরা স্বেচ্ছাচারী ও উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন। মোট চারজন হাবশী সুলতান মোট ছয় বছর রাজত্ব করেছেন।এঁনাদের মধ্যে একজনের ন্যায়পরায়ণতার কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়, তিনি মালিক আন্দিল সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহ। এছাড়া বাকিরা অযোগ্য ছিলেন।চতুর্থ এবং শেষ হাবশী সুলতান মোজাফ্ফর শাহের একজন উজির হয়েছিলেন হোসেন শাহ, তাঁর নিজ প্রতিভাবলে। এসময়ে তিনি রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করেন এবং একসময়ে মোজাফ্ফর শাহকে হত্যা করে বাংলায় হাবশী বংশের দু:শাসনের ইতি ঘটান। এভাবে ১৪৯৩ সালের দিকে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বাংলার মসনদ অধিকার করেন।

Chaitanya Mahaprabhu: Shri Krishna Chaitanya Mahaprabhu was a 15th century Indian saint and founder of Achintya Bheda Abheda.

মসনদে আসীন হয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করেন হোসেন শাহ।অসাম্প্রদায়িক সুলতান তাঁর প্রশাসনে যোগ্যতর হিন্দু ব্যাক্তিদেরও স্থান দেন। তাঁর সময়ে রূপ ও সনাতন নামের সহোদর দুইজন মন্ত্রীর নাম পাওয়া যায় যাঁদের উপাধী ছিলো যথাক্রমে দবীর খাস ও সাকের মালিক। এছাড়া সুবুদ্ধি রায়, কেশব বসু প্রমুখ ব্যাক্তিবর্গও উচ্চপদে ছিলেন। তাঁর সময়েই বাংলায় শ্রীচৈতন্যদেব বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। হেসেন শাহ নিজে ধর্মপ্রাণ মুসলিম হয়েও শ্রীচৈতন্যদেবকে বাধা দেন নি,বরং তিনি তাঁর জন্য শ্রদ্ধা পোষণ করতেন।এসময়ে সমগ্র বাংলায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বজায় ছিলো।এছাড়া তিনি কবি সাহিত্যিকদেরও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাঁর আমির-ওমরাহরাও তাঁর দেখাদেখি শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।তাঁর সেনাপতি পরাগল খাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর “মহাভারত” অনুবাদ শুরু করেন। তিনি বহু মাদ্রাসা,মসজিদ নির্মাণ করিয়েছেন।এছাড়া সূফী-সাধকদের খানকায় দানও করতেন অনেক। কথিত আছে, তিনি প্রতি বছর একবার পায়ে হেটে রাজধানী হতে প্রসিদ্ধ সূফী নূর কুতুবে আলমের খানকায় যেতেন তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে। তিনি ইয়াজদান বক্শ নামক ব্যাক্তিকে দিয়ে বুখারী শরীফ নকল করিয়েছিলেন।রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগন্জের ছোটো সোনা মসজিদ আজও তাঁর কীর্তির নিদর্শন হয়ে আছে।

Coins of the Middle Ages

তাঁর শাসনামলে দিল্লীর পাঠান সুলতান সিকান্দার লোদী বাংলা অধিকার করতে অগ্রসর হন ।হোসেন শাহ্ তাঁকে প্রতিরোধ করে দিল্লী ফেরত যেতে বাধ্য করে। তিনি কামরূপ জয় করেন।এছাড়া উড়িষ্যাসহ, বিহার ও ত্রিপুরার কিছু অংশ জয় করেন। সুবিশাল, প্রাচূর্যময়, স্থিতিশীল ও শক্তিশালী এক সালতানাত তিনি রেখে যান তাঁর বংশধরদের জন্য।প্রায় ২৬ বছর রাজত্ব করার পর ১৫১৯ সালে মহান এই সুলতান ইহলোক ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে তাঁর ১৮ পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নসরত শাহ মসনদে বসেন।তখন আবার উপমহাদেশে মোগল শক্তির উথ্থান ঘটে। রাজনীতির বাঁক আবার ভিন্ন ধারায় বইতে শুরু করে।

Coins of the Middle Ages

বলা হয়ে থাকে, প্রাক মোগল যুগে বাংলার শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ। মোগল আমলের মহামতী আকবরের শাসনের সাথে তুলনা করা হয় তাঁর শাসনকালকে। একজন মহান শাসকের ন্যায় বহু প্রতিভার উপস্থিতি ছিলো তাঁর মধ্যে। বাংলা সালতানাতকে এক শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাড় করিয়ে যান তিনি।পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিকদিক থেকে বাংলা আরোও সমৃদ্ধ হয়। তাই তাঁকে আখ্যায়িত করা হয় “ বাংলার আকবর” হিসেবে।