|| প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ ||

আফগানিস্তানে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ শুরু ১৮৩০-এর দশকে। জারের সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া মধ্য এশিয়ার কাজাকাস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান অবধি তার প্রাধান্য বিস্তার করেছে আর ব্রিটিশ অধিকার করে বসে আছে অবিভক্ত ভারতের সিংহভাগ, মাঝে আফগানিস্তান।
 
ওদিকে শিখদের ক্ষমতা ক্রমবর্ধমান; শিখদের কাছে আফগান অধিপতি দোস্ত মুহম্মদ হারিয়েছে সাধের পেশোয়ার শহর। এই পেশোয়ার নিয়েই ভয় ব্রিটিশের। রুশরা ঢুকে পড়তে পারে ভারতে। চেষ্টা করেও সন্ধি হয় না দোস্ত মহম্মদের সাথে ব্রিটিশের। ব্রিটিশ চায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে দোস্তের সাথে দোস্তি, আর দোস্ত চায় পেশোয়ার পুনরুদ্ধার। আকাঙ্ক্ষা মেলে না। পেশোয়ার পুনরুদ্ধার নিয়ে দোস্তের সাথে নতুন বন্ধুত্ব হয় রাশিয়ার। ১৮৩৮ সালে তাও ভেস্তে যায়।
ব্রিটিশ কাবুল দখলের পরিকল্পনা নিয়ে ১৮৩৮-এর ডিসেম্বর মাসে পাঞ্জাব থেকে রওনা দেয়। সঙ্গে ২১০০০ সেনা। তাদের বেশিরভাগই জন্মসূত্রে ভারতীয়। বালুচ অতিক্রম করে তারা পরের বছর এপ্রিল মাসে কান্দাহারে পৌঁছোয়। জুলাই মাসে গজনী দখল করে ব্রিটিশ বাহিনী, আগস্টে কাবুল। দোস্ত মহম্মদ কাবুল ছেড়ে বামিয়ানে আশ্রয় নেয়। পরের বছর দোস্ত মহম্মদ ব্রিটিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলে তাঁকে ভারতে নির্বাসিত করা হয়। ওদিকে ব্রিটিশের হাতের পুতুল হিসেবে শুজা শাহ দুররানি সিংহাসনে বসেন। গোটা আফগানিস্তান জুড়ে বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠীগুলোর সাথে দেওয়া নেওয়ার এক পুরোনো বোঝাপড়ায় টিকে ছিল দোস্ত মহম্মদের রাজত্ব। শুজার সাথে সে বোঝাপড়া হল না। বোঝা গেল ব্রিটিশের বাহিনী না থাকলে শুজার রাজত্ব টিকে থাকবে না। ব্রিটিশ আর শুজার ওপর সাধারণ আফগান জনতা এবং গোষ্ঠীপতিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
 
১৮৪১ সালে বছর ঘুরতে না ঘুরতে শুজার বিরুদ্ধে অসন্তোষ তীব্র হয়। দোস্ত মহম্মদের ছেলে আকবর খানের সাহায্যপুষ্ট হয়ে বামিয়ান, হিন্দুকুশের উত্তরের গোষ্ঠীগুলো জোট বাঁধে। আফগানিস্তানের প্রধান ব্রিটিশ প্রতিনিধি ম্যাকনাগাটেন আকবর খানের সাথে গোপনে আলোচনা শুরুর চেষ্টা করেন। এই গোপন বৈঠকের পেছনে যে আকবর খানকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল; তা আকবর খান জানতে পেরে যান। ২৩শে ডিসেম্বর ১৮৪১, গোপন বৈঠক শুরু হলে ম্যাকনাগাটেনকে হত্যা করে আকবর খান। রাস্তা দিতে মৃতদেহ টানতে টানতে এনে বাজারে প্রকাশ্যে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়।
 
এক সপ্তার মধ্যে সেনা প্রত্যাহার শুরু করে ব্রিটিশ বাহিনী। ফেরার সময় গন্ধমাক গিরিপথে ঘিলজাই গোষ্ঠীর যোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে ১৮০০০ সেনার সব্বাই নিহত হয়; মাত্র একজন, উইলিয়াম ব্রাইডেন (ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহকারী শল্যচিকিৎসক) একা ফেরেন জালালাবাদে। পরে শুজা শাহ দুররানিকে হত্যা করে দোস্ত মহম্মদকে আবার ক্ষমতায় বসায় আফগান গোষ্ঠীপতিরা।
 
লেখা – অরিজিৎ
ডিজাইন – বাপ্পাদিত্য
|| দ্বিতীয় ইঙ্গ আফগান যুদ্ধ ||
 

দোস্ত মহম্মদ তো আবার সিংহাসনে বসলো। ১৮৬৩ সালে মৃত্যু অবধি নির্ঝঞ্ঝাটে রাজত্বও চালালো। মৃত্যুর পর তাঁর আর এক ছেলে শের আলি খান (১৮৬৩-১৮৭৯) পেলো রাজত্ব চালানোর ভার। সিনহাসনের অধিকার নিয়ে শুরু হল পরিবারের মধ্যে গোলযোগ। শের আলির দুই ছেলের কথা পরে আসবে তাই তাদের নাম দুটো এই সুযোগে বলে রাখি। মহম্মদ ইয়াকুব খান আর আয়ুব খান। আরও দুটো নাম শুনিয়ে রাখি- শের আলির আর এক ভাই আফজল খান আর তাঁর ছেলে আব্দুর রহমান খান। আব্দুর রহমান উত্তরাঞ্চল শাসন করাকালীন বিদ্রোহী হয়ে উঠলে শের আলি তাঁকে বন্দী করতে উদ্যত হয়, আব্দুর রহমান আমু দরিয়া টপকে বুখারা চলে যায়; আফজল খান বন্দী হয় গজনীর কারাগারে। আব্দুর রহমান দু বছর পর ফিরে কাবুল দখল করে এবং পিতা আফজল খানকে সিংহাসনে বসায়। আফজল খান ১৮৬৬ থেকে ১৮৬৮ অবধি দুবছরের জন্যে ভাই শের আলির হাত থেকে ক্ষমতা দখল করেছিল। আফজলের মৃত্যুর পর শের আলি আবার আব্দুর রহমানকে যুদ্ধে পরাজিত করে আবার ক্ষমতায় ফিরলে আব্দুর রহমান মধ্য এশিয়ায় রুশ অধিকৃত সমরখন্দে পালিয়ে যায়। এরা সবাই, এই দোস্ত মহম্মদের নাতি পুতিরা (বারাকজাই রাজবংশ) রাজত্ব চালাবে ১৯১৯ সাল অবধি।

১৮৭৮ সাল। আফগানিস্তান নিয়ে জারের রাশিয়া আর ব্রিটেনের কামড়াকামড়ির ‘গ্রেট গেম’ শুরু হয়ে গিয়েছে চল্লিশ বছর আগেই, শুরুর ঝলক দেখা গিয়েছিল প্রথম ইঙ্গো আফগান যুদ্ধের মারফৎ। এখন একটা নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। বার্লিন কংগ্রেসে রাশিয়া আর ব্রিটেনের চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপের নানা জায়গার অধিকার নিয়ে টানা পোড়েনের অবসান হল। ফলে দুজনেরই চোখ পড়লো এশিয়ায়, বিশেষত মধ্য এশিয়ায়। ব্রিটেন আবার প্রমাদ গুনলো জারের রাশিয়া ভারত দখল করতে পারে। ইতিমধ্যে রাশিয়া জুলাই মাসে একটা মিশন পাঠিয়েছে কাবুলে, আর শের আলি অস্বীকার করেছে ব্রিটিশদের কাবুলে স্থায়ী দূত রাখার প্রস্তাব। ব্রিটিশের সন্দেহ হল ইঙ্গো-রুশ টানাপোড়েনে এতদিন পক্ষপাতহীন শের আলি বোধহয় রাশিয়ার ডিকে ঝুঁকছে। এই পরিস্থিতিতেই শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় ইঙ্গো আফগান যুদ্ধ।

সেপ্টেম্বর, ১৮৭৮ ব্রিটিশ প্রায় ৫০ হাজার সৈন্য প্রেরন করে কাবুলের দিকে। বৃদ্ধ শের আলি পালিয়ে যায় কাবুলের অদূরে মাজার-ই-শরিফে। রাশিয়ার কাছে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। সেখানেই ১৮৭৯ এর ফেব্রুয়ারী মাসে তাঁর মৃত্যু ঘটে। বিখ্যাত নীল মসজিদে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। এটা বর্তমানে আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় মসজিদ। রাজত্বের ভার পান পুত্র ইয়াকুব খান। এই সুযোগে রাশিয়া আব্দুর রহমানের ওপর চাপ তৈরি করে আফগানিস্তানে ফিরে রাশিয়ার পক্ষ নিয়ে ক্ষমতাদখল করার জন্য।

ইতিমধ্যে ব্রিটিশ বাহিনী কাবুল সহ অধিকাংশ জায়গা নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে। ইয়াকুব খান ব্রিটিশের সাথে সন্ধি করতে রাজী হয়, ১৮৭৯ এর মে মাসে গন্দমাক নামে জায়গায় চুক্তি সই হয়। তাতে দেশের অভ্যন্তরীণ শাসনভার ইয়াকুবের হাতেই থাকে, শুধু উত্তরের সীমান্তবর্তী কয়েকটা প্রদেশ পায় ব্রিটেন; আর আফগানিস্তানের বৈদেশিক নীতির নিয়ন্ত্রণ থাকে ব্রিটিশের হাতে, বিভিন্ন শহরে ব্রিটিশ দূত রাখার নীতিও মেনে নেয় গন্দমাক চুক্তি। ব্রিটিশের আসলে আফাগ্নিস্তানে থেকে গিয়ে আফগানিস্তানের শাসন পরিচালনা করার পরিকল্পনা ছিল না, ছিল শুধু রাশিয়ার অগ্রগমন আটকানো। ওহো, বলতে ভুলে গেছি- খাইবার গিরিপথের নিয়ন্ত্রণও পায় ব্রিটিশ।

মে মাসে চুক্তি হল। আর, ব্রিটিশ বাহিনী ফিরে আসার পরপরই, সেপ্টেম্বর মাসে কাবুলে থাকা প্রধান ব্রিটিশ পতিনিধি কাভাগনারী সপারিষদ খুন হয়ে গেলেন। শুরু হয়ে গেলো দ্বিতীয় ইঙ্গো আফগান যুদ্ধের দ্বিতীয় দফা। বহু জায়গায় যুদ্ধ হল। প্রায় সব জায়গায় আফগান বাহিনী পরাজিত হল। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী কাবুল শহর দখল করে নিল অক্টোবর মাসেই। ইয়াকুব খান ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বন্দী হল অক্টোবরে, তাঁর ভাই আয়ুব খান ক্ষমতা দখল করলেও বেশিদিন ধরে রাখতে পারলো না, স্রেফ হীরাটের গভর্নর হয়ে রইলো। ১৮৮০ এর মে মাসে ক্ষমতা হস্তান্তর হল রাশিয়া ফেরত আব্দুর রহমানের হাতে। গন্দমাক চুক্তি বহাল রইলো।

অনতিবিলম্বে আয়ুব খান বিদ্রোহ শুরু করে। আব্দুরের বাহিনীকে পরাস্ত করে হীরাট দখল করে জুলাই মাসে। মাইওয়ান্দে যুদ্ধ হয়, ব্রিটিশ বাহিনী পিছু হটে; কান্দাহার দখল করে নেয় আয়ুব খান। আব্দুর রহমানের বাহিনী কাবুল থেকে হীরাটের দিকে এগোতে থাকলে কান্দাহারে সম্মুখ সমর হয়। সেই আক্রমনে সেপ্টেম্বরেই আয়ুব খানের পরাজয় ঘটে। আয়ুব পালিয়ে যায় ইরানে। বেশ কয়েক বছর পরে আয়ুব ব্রিটিশের পেনশনভোগীতে পরিণত হয়, এবং পাকাপাকিভাবে আমৃত্যু(১৯১৪) ব্রিটিশ-ভারতে এসে বসবাস শুরু করে। প্রসঙ্গত বলে রাখতে হয় বন্দী ইয়াকুব খানও নির্বাসিত হয় ভারতে। ১৮৭৯ এর অক্টোবরে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ডিসেম্বরেই তাঁকে প্রেরন করা হয় ভারতে। তিনিও আমৃত্যু(১৯২৩) ভারতে ব্রিটিশের পেনশনভোগী হিসেবে ছিলেন।

শেষ হল দ্বিতীয় ইঙ্গ আফগান যুদ্ধ।

লেখা – অরিজিৎ
ডিজাইন – বাপ্পাদিত্য

প্রথম প্রকাশঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (অমর কথাশিল্পী)