শুধুমাত্র প্রাকৃতিক বৈশিষ্টই নয়, সৌন্দর্য্যেও চট্রগ্রাম বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেকটাই ভিন্ন। সারি সারি ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড়রাজি, সুদীর্ঘ সৈকতজুড়ে বিস্তৃত সাগরের নীল জলের বিরামহীন কোমল ফেনিল স্রোত এবং পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দৃষ্টিনন্দন বর্ণিল উপত্যকার সম্মিলনে এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের এক অপরূপ অঞ্চল। এই তিনটি উপভোগ্য প্রাকৃতিক উপাদানের সংমিশ্রণ বাংলাদেশের অন্য কোন অঞ্চলে নেই। নৈসর্গিক উপকরণের এ এক অনন্য মিশ্রণ। সপ্তম শতাব্দীতে চীন পর্যটক জুয়ানচাং (Xuanzang ) চট্রগ্রামকে বর্ণনা করেন এভাবে, “চট্রগ্রাম একটি সুপ্ত সৌন্দর্য্য, যা’র উত্থান হয় প্রতিদিন কুয়াশা, শিশির এবং জলের গহীন থেকে।”
শুধুই কি সৌন্দর্য্য? চট্রগ্রামের রয়েছে সুদীর্ঘ রঙিন ইতিহাস। প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন নিদর্শন থেকে জানা যায়, চট্রগ্রামে মানুষের বসবাস ছিল সেই প্রস্তরযুগের শেষ দিক থেকেই -যাকে বলা হয় নিওলিথিক (neolithic) যুগ। ঐ জনগোষ্ঠী ছিল মূলতঃ অস্ট্রো-এশীয়াটিক।
প্রাচীন ইতিহাস বলে, আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকেই চট্রগ্রাম ছিল এক বন্দর নগরী। জলপথের বিভিন্ন ভ্রমণসূচি, নৌপথ এবং বন্দরের নাম লিপিবদ্ধ করে রাখা গ্রীক ভৌগোলিক গ্রন্থ পেরিপ্লাসে (Periplus) “ক্রিস” নামের স্থানটি বর্তমানের সন্দীপ এবং চট্রগ্রামের কোন এক বন্দরকেই বোঝায়। খ্রীষ্টাব্দ দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত টলেমির (Ptolemy) প্রন্থ “জিওগ্রাফি” থেকে জানা যায়, চট্রগ্রাম বন্দরটি প্রাচ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হিসেবে পরিচিত ছিল সেই প্রাচীন কাল থেকেই।
অতীতে চট্রগ্রাম ছিল বর্তমানের মায়ানমার এবং বাংলাদেশ নিয়ে প্রাচীন প্রদেশ সমতটের (Samatala) অংশ। এই অঞ্চলটি তখন ছিল বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক প্রধান কেন্দ্রস্থল এবং মৌর্য্য সাম্রাজ্যের এক প্রদেশ। চন্দ্র রাজবংশ চট্রগ্রাম এবং এর আশেপাশের এলাকা শাসন করে আনুমানিক তৃতীয় শতাব্দী থেকেই। চন্দ্রবংশের শাসনামলে চট্রগ্রাম ছিল তাদের রাজধানী। পরবর্তীতে ভার্মান, পাল, গুপ্ত, সেন, দেব এবং অন্যান্য রাজবংশ এ অঞ্চল পর্যায়ক্রমে শাসন করে যায়। নবম শতাব্দী থেকে আরব বণিকেরা আসতে শুরু করে চট্রগ্রামে বাণিজ্য করার জন্য।
১১৫৪ সালে বিশিষ্ট ভূগোলবিদ আল-ইদ্রিস চট্রগ্রামকে বর্ণনা করেন একটি অত্যন্ত ব্যস্ত বন্দর হিসেবে। তার বর্ণনায়, চট্রগ্রামের সাথে ইরাকের বসরা এবং বাগদাদের ছিল জনপ্রিয় একটি বাণিজ্যিক নৌপথ। অনেক সুফি এবং ইসলাম ধর্ম প্রচারক এই নৌপথ ধরেই চট্রগ্রামে এসে বসবাস করেন স্থায়ীভাবে।
সোনারগাঁওয়ের সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ ১৩৪০ সালে চট্রগ্রাম দখল করে শহরটিকে বাংলার সুলতানি শাসনের অংশ করে ফেললে বাংলা এবং চট্রগ্রামের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বেড়ে যায় অনেক। ঐ সময়ে চট্রগ্রামের সাথে নৌ পথের বাণিজ্য ছিল প্রধানতঃ চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব আফ্রিকার সাথে। চট্রগ্রাম থেকে ঐ সব অঞ্চলে মূলতঃ রফতানী হতো বাংলার মুক্তা, সিল্ক, মসলিন, বারুদ, এবং সোনা-রুপার মূল্যবান অলংকার সামগ্রী। প্রাচীনকাল থেকেই চট্রগ্রাম ছিল জাহাজ নির্মাণের জন্য বিশ্বের অন্যতম। চট্রগ্রাম বাংলার সাথে সম্পৃক্ত হওয়াতে জাহাজশিল্পের হয় আরও প্রসার।
১৩৪৫ সালে বিশিষ্ট পর্যটক ইবনে বতুতা এবং ইতালির পর্যটক নিক্কোলো ডি কোন্টি চট্রগ্রাম ভ্রমণে আসেন। চট্রগ্রামের সৌন্দর্য্য এবং অর্থনীতির সাফল্য দেখে চট্রগ্রামের প্রচুর ইতিবাচক বর্ণনা করেন যান দু’জনই। ধারণা করা হয়, পনেরো শতকে, সম্ভবত ১৪৩২-১৪৩৩ সালের কোন সময়ে চীনের বিখ্যাত ট্রেজার ফ্লিটের (Treasure Fleet) একটি স্কোয়াড্রন তাদের সপ্তম সমুদ্রযাত্রায় কমান্ডার হং বাউর (Hong Bau) নেতৃত্বে চট্রগ্রাম, সোনারগাঁও, এবং বাংলার রাজধানী গৌড় নগর পরিদর্শন করে। সামরিক ইতিহাসে বাংলার সালতানাতের আরাকান জয়ে (১৫১২-১৫১৬) চট্রগ্রামের ভূমিকার বর্ণনা করা হয়েছে বিস্তারিতভাবে এবং প্রশংসার সাথে।
তেরো থেকে ষোলো শতকের মধ্যে প্রচুর আরব এবং পার্শিয়ান বাণিজ্য করার উদ্দেশে চট্রগামে আসে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইরান থেকে। এদের অনেকেই পরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে চট্রগ্রামেই। বাণিজ্যের সাথে সাথে আরব এবং পার্শিয়ান বণিকদের আরেকটি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বাংলায় ইসলাম প্রচার করা। পার্শিয়ানদের প্রভাব চট্রগ্রামের ভাষা এবং সংস্কৃতিতে পড়েছিল অনেকভাবে। ধীরে ধীরে ফার্সী হয়ে উঠে চট্রগ্রামের, এমনকি বাংলার প্রধান ভাষা। চট্রগ্রামের নিজস্ব ভাষার বর্ণমালায়ও ফার্সীর পড়েছিল অনেক প্রভাব। ধারণা করা হয়, চট্রগ্রামের মুসলমান জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ আরব এবং পার্সিয়ান জনগোষ্ঠীর সাথে বংশাক্রমানুসারে সম্পৃক্ত।
পরবর্তীতে পর্তুগীজরা আসতে আরম্ভ করে চট্রগ্রামে। ১৫২৮ সালে বাংলার সালতানাত পর্তুগীজদেরও চট্রগ্রামে বসবাস করার অনুমতি দেয়। এটিই ছিল বাংলায় প্রথম ইউরোপিয়ান ছিটমহল বা কলোনী। ১৫৩১ সালে আরাকান স্বাধীন মরাউক উ (Mrauk U Kingdom) রাজ্যের ঘোষণা দিলে, বাংলার সালতানাত চট্রগ্রামের উপর তাদের কর্তৃত্ব হারায়। ঐ রাজনৈতিক পট পরিবর্তন আগামী একশো বছরের জন্য পর্তুগীজদের এনে দেয় চট্রগ্রামের উপর বাধাহীন নিয়ন্ত্রিত। তারপর থেকে ষোড়শ শতকে চট্রগ্রাম বন্দরের সাথে গোয়া এবং মালাক্কার চলে পর্তুগীজ নৌযানের অনিয়ন্ত্রিত যাতায়াত। চালু করা হয় কার্টাজ (cartaz) নৌ বাণিজ্যের লাইসেন্স, যা’ সব জাহাজকে কিনতে হতো চট্রগ্রামের পর্তুগীজদের কাছ থেকে। চট্রগ্রামের জল সীমানায় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলো ক্রীতদাস বাণিজ্য এবং জলদস্যুতা। চট্রগ্রাম বন্দর হয়ে পড়লো অস্থিতিশীল। ১৬০২ সালে পর্তুগীজরা দখল করে নিলো সন্দীপ।
১৬১৫ সালে পর্তুগীজ নৌবাহিনী চট্রগ্রামের জল সীমানা থেকে হটিয়ে দিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং আরাকান রাজ্যের সম্মিলিত সামরিক শক্তিকে। চট্রগ্রামের বন্দর এবং জল সীমানায় তাদের অরাজকতা চললো ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত। এদিকে মোগলরা পর্তুগীজদের উপর হয়ে পড়লো চরম অসন্তোষ। মোগল প্রদেশ, বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানকে দায়িত্ব দেয়া হলো পর্তুগীজ দমনে। ঐ বছর শায়েস্তা খান পর্তুগীজ এবং আরাকান শক্তির উপর করেন এক আকস্মিক সামরিক অভিযান। শায়েস্তা খান ৬৫০০ মোগল সৈন্য এবং ২৮৮টি সামরিক নৌযান নিয়ে তিনদিন যুদ্ধ করে বের করে দেন তাদেরকে চট্রগ্রাম থেকে। মুক্ত হয় চট্রগ্রাম বহিরাগতদের নিয়ন্ত্রণ থেকে।
চট্রগ্রামকে পর্তুগীজ এবং আরাকানদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করে মোগলরা মনোযোগ দেয় এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে। চট্রগ্রামকে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক সড়কের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয় উত্তর ভারত এবং মধ্য এশিয়ার সাথে। মোগলরা চট্রগ্রামকে সম্পৃক্ত করে উড়িষ্যা, বিহার এবং বাংলার মূলধারা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে। তুর্কির অটোম্যান সাম্রাজ্য থেকে আসতে থাকলো অগণিত সামরিক এবং বেসামরিক নৌযান নির্মাণের অনুরোধ। বন্দর এলাকায় জাহাজনির্মান শিল্প হয়ে পড়লো স্থানীয় শক্তিশালী অর্থনীতির এক বিশাল অবদান। অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে চট্রগ্রাম পরিনত হয় বিশ্বের এক সম্মৃদ্ধশালী অঞ্চলে।
এদিকে ইংরেজরাও বসে নেই। ১৬৮৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এডমিরাল নিকোলসনের অধীনে চট্রগ্রাম জয়ের উদ্দেশ্যে পাঠালো এক অভিযান। চট্রগ্রাম দখলে এডমিরাল নিকোলসন হলেন চরমভাবে ব্যর্থ। ১৬৮৯ সালে প্রায় এক ডজন শক্তিশালী নৌবাহিনীর সামরিক জলযান নিয়ে ইংরেজরা আবারো চট্রগ্রাম দখলের চেষ্টা করে। তাতেও হলো না সফল। পরবর্তী প্রায় একশো বছর চট্রগ্রাম ছিল বাংলার নবাবী শাসনের অধীনে। ১৭৯৩ সালে ইংরেজরা বাংলার শাসন থেকে ছিনিয়ে নেয় চট্রগ্রামকে। তারপর থেকে চট্রগ্রামের উপর ইংরেজ শাসন চললো ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। পরবর্তী ইতিহাস জানা সবারই।
সেই প্রস্তরযুগ থেকে চট্রগ্রামের পথ চলা। তখনো সাগরের গড়ানো স্রোত শ্রুতিময় গর্জনে আছড়ে পড়তো ঝিকিমিকি বালুকাময় সৈকতে। পাহাড়-উপত্যকায় স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়াতো নানা আকৃতির পাখিকুল। আজও থেমে নেই এসব। চট্রগ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য এবং এ অঞ্চলটির গতিশীল অর্থনীতি সবসময় বিশ্বের বিভিন্ন মানুষকে করেছে আকৃষ্ট। বারবার এ’র শাসন ব্যবস্থার হয়েছে হাত বদল। কিন্তু চট্রগ্রাম সবসময় রয়ে গিয়েছে সর্বসাধারনের জন্য এক মহা মিলনস্থল (melting pot)। চট্রগ্রামের বিস্তৃত সাগর-সৈকত, সারিসারি লতা-গুল্মে আবিষ্ঠ পাহাড়-টিলা, আর সুশান উপত্যকা বিরামহীন আকর্ষণ করে চলেছে সবাইকে। আজো।