আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগের কথা। এতো প্রাচীন সময়েও কি কোনো সমাজ একটি সুষ্ঠু নগর সভ্যতা গড়ে তুলতে পেরেছিলো? হ্যাঁ, এ-ও সম্ভব এবং এটি সম্ভব হয়েছিলো সিন্ধু সভ্যতায়। প্রত্নতত্ত্ববিদ চার্লস ম্যাসন কর্তৃক আবিষ্কৃত ইরাবতী (রাভী) নদীর তীরে গড়ে ওঠা ‘হরপ্পা সভ্যতা’ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি অন্যতম নাম, যা মূলত সিন্ধু সভ্যতার একটি অংশবিশেষ।
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে অবস্থিত খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ সময়কালীন এই হরপ্পা নগরীর উত্থান, পতন, নগর পরিকল্পনার জ্ঞান ও অনন্য নির্মাণ কৌশল- প্রত্যেকটিই অত্যন্ত রহস্যময়। তেমনি রহস্যে ঘেরা হরপ্পার পুরাকীর্তিগুলোও, যার কিছুটা সংরক্ষিত হয়েছে, আর কিছুটা সংগ্রাহকদের মাধ্যমে চুরি হয়েছে। এমনই একটি চুরি হয়ে যাওয়া নিদর্শন হলো এই বিশেষ যানটি, যাকে ইতালীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ ম্যাসিমো ভিডালে ২০০৯ সালে
‘কাউবোট (cowboat)’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। এটিকে ‘কাউবোট’ বলার পিছনে যথেষ্ট যুক্তিও কিন্তু রয়েছে। কেননা, এই যানটি আপাতদৃষ্টিতে একটি হাঁটু মুড়ে বসে থাকা ষাঁড়মাত্র।
এটি যে আদতে হরপ্পা সভ্যতারই একটি নিদর্শন এবং মেহেরগড় বা তার কাছাকাছি এলাকার তা নিশ্চিত করেছেন খোদ ম্যাসিমো ভিডালে। তিনি একবার এই পুরাতত্ত্বটি পরীক্ষণের জন্য এর সংগ্রাহকের কাছ থেকে নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন এবং চোরাই মালের বিপক্ষে থাকা সত্ত্বেও কৌতুহলকে বশ করতে না পারায় ম্যাসিমো ভিডালে সেই দাওয়াত গ্রহণ করেন এবং এরই মাধ্যমে রচিত হয় “দ্য লেডি অব দ্য স্পাইকড থ্রোন”।
হরপ্পা সভ্যতার সমসাময়িক একটি সভ্যতা হচ্ছে মেসোপটেমিয়া (অধুনা ইরাক, সিরিয়ার উত্তরাংশ, তুরস্কের উত্তরাংশ ও ইরানের খুযিস্তান মূলত মেসোপটেমিয়ার অংশ) ও মিশরীয় সভ্যতা। ইরাক, ইরান, তুর্কমেনিস্তানে স্থল ও জলপথে হরপ্পার বাণিজ্যিক বিনিময় হতো। রহস্যময় কাউবোটের কিছু কিছু ধরন ও নকশা মেসোপটেমিয়া ও মিশরীয় সভ্যতার নির্মিত পুরাতত্ত্বগুলোর সাথে মিলে যায়। এ থেকে অনুমান করা যায়, হরপ্পা, মেসোপটেমিয়া ও মিশরীয় সভ্যতার মধ্যে একটি গভীর যোগসূত্র বিদ্যমান ছিলো।
যানটিতে যে ধরনের নকশা রয়েছে, এমন নকশা মেসোপটেমীয় উরুক আমলে এবং ইরানের খুযিস্তানের চোগা মিশ নামক প্রত্নস্থলে দেখা গেছে। এছাড়াও ষাঁড়ের শরীরের জলজ লতাপাতা ও ঢেউয়ের মতো নকশা সুমেরিয়ান আইকনোগ্রাফিতে দেখা গেছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ সহস্রাব্দের কিছু নকশা দেখে বোঝা যায়, মিশরীয়রা কিছুটা এই ধরনেরই বড় নৌকা ব্যবহার করতো। এটি মিশরীয়দের রাজনৈতিক আধিপত্য এবং যুদ্ধের সফলতার প্রতীক বহন করে। সেখানে রাজার মৃত্যু হলে এই ধরনের উল্লেখযোগ্য প্রত্নসম্পদগুলো রাজার মৃতদেহের সঙ্গে কবরে দাফন করা হতো।
হরপ্পা সভ্যতা ছিলো মাতৃকেন্দ্রিক। হরপ্পায় নারীদের কি পরিমাণ সম্মান দেয়া হতো, তা বোঝা যায় তাদের কিছু প্রাচীন কবর দেখলে। ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ASI (Archaeology Survey of India) হরিয়ানার হিসার অঞ্চলে খননকার্য চালায় এবং তার ফলে উদ্ধার হয় হরপ্পার কিছু প্রাচীন কবর। ASI সেসব কবর পরীক্ষা করে যে রিপোর্ট প্রকাশ করে, তাতে বলা হয়েছে- “হরপ্পা সমাজে নারীদের সম্মান ও জীবনযাপনের মান পুরুষদের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে ছিলো এবং নারী উন্নয়নে হরপ্পা সমাজ ছিলো যথেষ্ট প্রগতিশীল”। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, সে যুগে মৃত মানুষকে সম্মান জানানোর জন্য তার কবরে মৃতদেহের সঙ্গে মাটির পাত্র ও বিভিন্ন অলঙ্কার দেয়া হতো। ASI এর খননকার্যে যেসব কবর পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, নারীদেহগুলোর সঙ্গে পুরুষদের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি মাটির পাত্র ও মাটির তৈরী অলঙ্কার ছিলো। এছাড়াও বিভিন্ন গবেষণায় জানা যায়, সে যুগে সবচেয়ে বেশি সম্মান জানানো হতো কোনো বিধবা মহিলার শেষকৃত্যে। তাছাড়া হরপ্পার নারী মূর্তির সংখ্যা ও গঠনশৈলী থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে, হরপ্পায় তখন মাতৃপূজার প্রচলন ছিলো।
এই বিশেষ যানটির বিশেষত্ব হলো মূলত “নারী”। যানটির নারী চরিত্রগুলোর আচরণ ও বেশভূষা এটিই প্রমাণ করে যে, এটি একটি নারীপ্রধান সমাজে নির্মিত পুরাতত্ত্ব। অর্থাৎ, এই যানটি আমাদেরকে ৫০০০ বছর আগের একটি নারীশাসিত সভ্যতার দলিল দেয়।
কাউবোটটি দেখতে একটি ষাঁড়ের মাথাওয়ালা নৌকার মতো। এই ষাঁড়ের শরীরে জলজ লতাপাতা ও কোবরা সাপের নকশা আঁকা আছে। যানটির নিচের অংশটিতে ষাঁড়ের চারটি পা ভাঁজ করে রাখা। যানটির শেষ মাথায় একটি ছাউনিযুক্ত অংশ রয়েছে। ছাউনির ওপরেও নকশা করা আছে। এই ছাউনির নিচেই একটি সাত সূঁচালো অগ্রভাগবিশিষ্ট (২টি আনুভূমিক ও ৫টি উল্লম্ব) আসনে বসে আছে আকারে সবচেয়ে বড় নারী মূর্তিটি। তার পা দুটো একটি নিচু আসনের উপর রাখা এবং আসনটির দুই হাতলের জায়গায় রয়েছে দুটি ছোট ষাঁড়ের মূর্তি।
আসনের দুই পাশে ছাউনির দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে দুটি করে মোট চারটি পুরুষ মূর্তি যাদেরকে সিংহাসনে বসা নারীর সেবক বা দেহরক্ষী বলে ধারণা করা হয়। এই সেবক মূর্তিগুলো ছাঁচে বানানো, অর্থাৎ সেই যুগে এই সেবকের মূর্তিগুলো বেশ জনপ্রিয় ছিলো। পুরো যানটিতে এই সেবক মূর্তিগুলোই সবচেয়ে অযত্নে কিংবা তাড়াহুরো করে বানানো হয়েছে। ছাউনির সামনের খোলা অংশে টুলের মতো ত্রিভুজাকার আসনে দুই সারিতে চারজন নারী ও চারজন পুরুষ জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে সিংহাসনের নারী মূর্তিটিকে পেছনে রেখে। দুই সারির মাঝে একটি সরু পথ রয়েছে।
এই আটজন নারী-পুরুষের সামনে যেখানে ষাঁড়ের কুঁজ থাকার কথা, সেখানে তিন ধাপ সিঁড়ি রয়েছে এবং সিঁড়ির দুই পাশে দুটি পুরুষ মূর্তি সিংহাসনের নারীর দিকে মুখ করে দাঁড়ানো। সবগুলো পুরুষ মূর্তির মাথা এবং গলা একই রকম। যানটির একদম শেষ প্রান্তে একটি হাতল রয়েছে। ধারণা করা হয়, এই হাতল ধরেই এটিকে ব্যবহার কিংবা স্থানান্তর করা হতো। মোট ১৫ জন যাত্রী নিয়ে তৈরী এই যানটির সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, নারীরা পুরুষের চেয়ে আকারে বড়, এমনকি তাদের বসার আসনও পুরুষদের তুলনায় উঁচু এবং সিংহাসনের নারী মূর্তিটি আকারে সবচেয়ে বড়। এছাড়াও প্রত্যেকটি পুরুষ মূর্তির বস্ত্র পরিধেয়, কিন্তু প্রত্যেকটি নারী মূর্তি নগ্ন। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, যানটিতে পুরুষ যাত্রীগুলো যে ধরনের কাপড় পরে আছে, এমনটি কখনও কোনো জায়গায় দেখা যায় নি।
ম্যাসিমো ভিডালের পরীক্ষণ অনুযায়ী, এই যানটি ২৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৈরী এবং এতে নারী মূর্তিদের ধরন দেখে অনুমান করা যায় যে, ঐ সময় হরপ্পার সমাজ ব্যবস্থা নারীকেন্দ্রিক ছিলো। কিন্তু মূলত কি উদ্দেশ্যে এটি তৈরী হয়েছিলো এবং সিংহাসনের নারী মূর্তিটির কি পরিচয়, এই রহস্য আজও সমাধান হয়নি। হতে পারে, তখন সত্যিই এমন যানের অস্তিত্ব ছিলো, কিংবা পুরো বিষয়টিই কাল্পনিক চিন্তা থেকে সৃষ্ট। হতে পারে, সিংহাসনের নারীটি কোনো রাণী কিংবা ধর্মগুরু কিংবা কোনো দেবী। হতে পারে, এটি কোনো শোভাযাত্রা কিংবা কোনো ধর্মানুষ্ঠানের চিত্র। এই অমূল্য পুরাতত্ত্বটি নির্মাণের সত্যিকারের ধারণা আজও রয়ে গেছে অজানা।
এই যানটি আসলেই কোনো জলযান নাকি স্থলযান- এ নিয়েও রয়েছে বহু তর্ক-বিতর্ক। দুই পক্ষেই রয়েছে হরেক রকম যুক্তি। তবে এটির গঠন ও নকশার আঙ্গিক থেকে পুরাতত্ত্ববিদ ম্যাসিমো ভিডালে একে জলযান ভাবতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বিশেষ করে এর জলজ উদ্ভিদের নকশা এবং তরঙ্গের মতো সজ্জা তাকে বেশি প্রভাবিত করে পুরাতত্ত্বটিকে জলযান ভাবতে।
প্রাচীন সময়ের সবচেয়ে অদ্ভূত নিদর্শনের তালিকা বানাতে চাইলে এই অদ্ভূত পুরাতত্ত্বটিকে একটি বিশেষ জায়গা দিতেই হয়। কেউ কেউ তো এ-ও বলেছেন যে, এটি হয়তো কোনো এলিয়েনের (ভিনগ্রহের প্রাণী) উড়ন্ত জাহাজ। এর অদ্ভূত ও অনন্য নির্মাণশৈলী একটি ধোঁয়াশা ইতিহাস ও অজানা রহস্যের জানান দেয়, যে রহস্য আমাদের কল্পকাহিনীর জগতে পৌঁছে দেয়।
এই প্রত্নসম্পদটির মতোই বহু পুরাতত্ত্ব বিভিন্ন সময়ে চোরাই পথে বিলীন হয়ে গেছে। এ ধরনের অপরাধ অবিলম্বে বন্ধ না হলে অনেক বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নিদর্শনের অস্তিত্ব আমাদের জ্ঞানের পরিসীমার বাইরে রয়ে যাবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অতএব আমরা যেনো এমন বহুমূল্যবান সম্পদের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত না হই, সে জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।