১৯৫৯ সালে তোলা ছবিতে আজিমপুর কলোনি নিবাসী একদল হাস্যোজ্জ্বল শিশু-কিশোর, ছবি সংগ্রহে কৃতজ্ঞতাঃ শ্রদ্ধেয় ডাঃ তৌফিকুর রহমান।

পূর্বকথাঃ ১৯৪৭ সালে মাত্র ১২ বর্গমাইলের এই ঢাকা শহর সহসা হয়ে উঠল প্রাদেশিক রাজধানী। ছোট্ট নিরিবিলি ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা তখন মাত্র আড়াই লাখ। রমনার পর জনমানুষের দেখা মেলাই ভার। শহরের পায়ে চলা আঁকাবাঁকা পথগুলো ছেয়ে থাকে কৃষ্ণচূড়ায়। তিন-চার তলার উপরে দালানকোঠার সংখ্যা হাতেগোনা। বঙ্গভঙ্গর পরে তৈরি কিছু বৃহদাকার স্থাপনা ছিল, তবে তার বেশির ভাগই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকারে। এরকম সময় প্রশাসনিক প্রয়োজনে হঠাৎ করেই শহরের লোকসংখ্যা অনেক বেড়ে গেলো। এই নতুন নাগরিকদের তালিকায় যেমন ছিলেন দাপ্তরিক কর্মকর্তা, কর্মচারি, আর তাদের পরিবার, তেমনই ছিলেন পল্লীগ্রাম থেকে শহরমুখী বেকার জনগোষ্ঠী। এককালে কাজের খোঁজে সবাই ছিলেন কলকাতামুখী। দেশভাগের ফলে সেই স্রোত এসে পৌঁছুল ঢাকায়।

তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পড়ল ভারী বেকায়দায়। আবাসন তো পরের কথা, ন্যুনতম অফিস আদালত বসাবার জন্য ভবনের ব্যবস্থা করতেও তারা হিমসিম খাচ্ছিল। সাময়িক সমাধান হিসেবে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন দখল করে প্রশাসনিক কাজকর্ম শুরু করতে হল, উদাহরন হিসেবে বলা যায়- জগন্নাথ হলে বসল প্রাদেশিক এসেম্বলি, ইডেন স্কুলে বসল সচিবালয়, ইত্যাদি। কিন্তু সরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লোকজন আর তাদের পরিবারকে কোথায় রাখা যায়? ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষে সৈন্যদের পরিত্যাক্ত কিছু অর্ধপাকা ঘরবাড়ি ছিল পলাশি এলাকায়; লোকে বলত পলাশি ব্যারাক। সেই ব্যারাকেই সাময়িক বন্দোবস্ত হল ২০০ এর বেশি কর্মকর্তা আর কর্মচারির। আর এদিকে নতন প্রাদেশিক রাজধানি নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনার দায়িত্ব পড়ল ইংরেজ স্থপতি কোলম্যান হিক্স এর উপর। বিশেষতঃ বন্যার পানি থেকে বাঁচিয়ে এ শহরের কোথায় দাপ্তরিক আর আবাসিক স্থাপনা তৈরি করা যায় তা নিয়ে নিরন্তর কাজ করে চললেন হিক্স ও তাঁর দল। এসময়েই ঠিক হল পলাশির পশ্চিমে লালবাগের আগে পর্যন্ত বিস্তীর্ণ জলাজংগল পরিষ্কার করে সরকারি আবাসন গড়ে তোলা হবে।

এলাকাটি তখন চরক আর শাল গাছে আচ্ছাদিত ছিল। ভন নামে এক ইংরেজ প্রকৌশলীর নেতৃত্বে এলাকার জমি ভবন নির্মানের উপযোগী করা হল। দেশভাগের পরপর নির্মানসামগ্রী ছিল অপ্রতুল; বিশেষভাবে অভাব ছিল লোহার রডের। এই অভাব মেটানোর জন্য তৎকালীন প্রকৌশলীরা ব্যবহার করলেন ২য় বিশ্বযুদ্ধের সৈন্যদের ফেলে যাওয়া ছিদ্রযুক্ত ইস্পাতের পাত (Perforated Steel Plate)। ১৯৪১ সালের পর যুদ্ধবিমানের সহজ অবতরণের জন্য তেঁজগাও আর কুর্মিটোলায় সৈন্যরা এই পাতগুলো দিয়ে রানওয়ে তৈরি করেছিল। বাড়ি তৈরির সময় বেশকিছু নকশা করা হল স্থানীয় আবহাওয়া ও পরিবেশকে বিবেচনায় রেখে। ঘরে আলো ঢুকবার জন্য ছিল খড়খড়ির জানালা, রান্নায় লাকড়ির ধোঁয়া বের হওয়ার জন্য ছিল চিমনির ব্যবস্থা। প্রথম দফায় ৪২টি দালান উঠল, ৩ তলা প্রতিটি দালানে মোট ১২টি করে ফ্ল্যাট। নির্মান শেষে শুরু হল ফ্ল্যাট বরাদ্দ। নতুন তৈরি আজিমপুর কলোনির বাসিন্দাদের চাহিদা মেটানোর জন্য গড়ে উঠল গভঃ নিউমার্কেট। এক মার্কেটে সবকিছু! এটা সে সময় ভাবাই যায় না। আর মার্কেটটি তৈরিও হয়েছিল খুব আকর্ষণীয় কায়দায়, ত্রিকোণাকার ল্যান্ডস্কেপে মার্কেটের ঠিক মাঝখানটা জুড়ে ছিল সুদৃশ্য গোলাপ বাগান। কেনাকাটার থেকে লোকে ঘুরতেই বেশি পছন্দ করত। আজিমপুর কলোনি যখন গড়ে ওঠে প্রথম দিকে তখন কাছাকাছিরa মধ্যে ভাল বিদ্যালয় ছিল ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুল এবং নবকুমার ইন্সটিটিউশন। স্থানীয়দের সন্তানদের প্রয়োজনে গড়ে ওঠে আজিমপুর গার্লস স্কুল, আজিমপুর কিন্ডারগার্টেন (পরবর্তীতে অগ্রণী স্কুল), লিটল এঞ্জেলস স্কুল সহ আরো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

আধুনিক সব সুযোগসুবিধা নিয়ে তৈরি এই কলোনিতে ফ্ল্যাট পাওয়া তখন সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারিদের জন্য স্বপ্নপূরণের নামান্তর। সাংবাদিক মীজানূর রহমান শেলীর স্মৃতিচারন – “সেই আজিমপুর কলোনির ১নম্বর ‘জে’ ফ্ল্যাটে যেদিন আমরা প্রথম অধিবাসী হিসেবে দখল নিই, সেই দিনটার নাম-ঠিকানা মনে নেই। শুধু এটুকু মনে পড়ে যে, সেদিন মা’র মুখে হাসি ছিল, আর বাবার চোখে ছিল দিগবিজয়ের আভাস, দেয়ালে দেয়ালে ছিল নতুন বাসস্থানের মৃদু সৌরভ আর সেদিনের আলুভর্তা, ডিমের তরকারি আর সাদা ভাতের স্বাদ সারা জীবনের মত আমার জিভে লেগে আছে।“

সহায়ক গ্রন্থঃ ১। The Aftermath of Partition in South Asia by Gyanesh Kudaisya and Tan Tai Yong, 1999. ২। Building Safer Cities: The Future of Disaster Risk, 2003.