যুগে যুগে যে কোন অন্যায়, অনর্থ, যুদ্ধ, বিদ্রোহের জন্য নারীদেরকেই দায়ী করা হয়। হেলেন কে দায়ী করা হয় ট্রয় ধ্বংসের কারণ হিসেবে, ক্লিওপেট্রাকে দায়ী করা হয় মার্ক এন্টোনির মৃত্যুর কারণ হিসেবে। ঠিক সেভাবেই হাজার হাজার বছর ধরে রাম সীতার বনবাস আর রাজা দশরথের মৃত্যুর কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় কৈকেয়িকে। আজ আমার মুখ থেকেই শুনুন আমার জীবনের কাহিনী।

দশরথের কাছে কৈকেয়ীর বরপ্রার্থনা

হ্যাঁ, আমি কৈকেয়ি। রাজা দশরথের স্ত্রী। রামায়ণ পরে সকলেই আমার এই নামকে করেছেন ভীষণ ঘৃণা। দেখিয়েছেন আক্রোশ। রামের বনবাস, সীতার অপহরণ রাজা দশরথের মৃত্যুর সবকিছুতেই দায়ী করা হয়েছে আমাকে। আর এটা তো স্পষ্টতই দেখা যায়, আপনারা আপনাদের মেয়ে, বোন, পরিজনদের নাম কৌশল্যা বা সুমিত্রা তো রেখেছেন। কিন্তু কৈকেয়ি? না, মনে হয় না কখনো শুনেছেন। কারণ, কৈকেয়ি শুনলেই আপনাদের মনে এমন একজন নারীর ছবি ভেসে ওঠে যে নিজের সংসারে যুদ্ধ লাগিয়েছিল। যার ফলে রাজা দশরথের মৃত্যু হয়, রাম সীতার বনবাস, সীতার অপহরণ, সীতাকে ফিরিয়ে আনার জন্য যে যুদ্ধের আয়োজন করা হয়েছিল সেই যুদ্ধের শত শত মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। আর এসব কিছুর জন্য শুধুমাত্র কৈকেয়িকেই,হ্যা, শুধুমাত্র কৈকেয়িকেই দোষারোপ করা হয়।

দশরথ তার স্ত্রীদের পয়সা দেয়

আপনাদের আর কি দোষ বলুন? পাঁচ হাজার বছর ধরে হাজারো ধর্মগ্রন্থ, হাজারো পুরান তো তাই বলে আসছে। ঋষি বাহ্মীকি কিন্তু আমার সম্পর্কে সত্যি কথাটাই লিখেছিলেন। তার রচিত রামায়ণ মূলত: একটি আদর্শের প্রতিচ্ছবি। একজন রাজা, তার স্ত্রী, তার আদর্শ ভাই কে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু তুলসীদাস এসে সেই রচনাকে করলেন পরিবর্তন। সেখানে আমার সম্পর্কে কথাগুলো ভুল ভাবে দেয়া হয়েছে। আজ আমি তুলসীদাস না, ঋষি বাহ্মীকি সত্যতার বর্ণনা করব।

পুত্র ভরতের জন্য সিংহাসন

রামের ১৪ বছরের বনবাস ।

কৈকেয়ী দশরথকে তার ইচ্ছা পূরণ করতে বললো

হ্যাঁ। আমি এটাই চেয়েছিলাম। এটাই আমার প্রাপ্য বর। কিন্তু লোকে কি জানে কেন আমি এই বর চেয়েছিলাম? আপনারা এটাই মনে করেন মন্থরা এসে আমায় কুমন্ত্রণা দিয়েছিলো বলেই আমি এমনটা করেছি। কিন্তু না, এমনটা নয়। আপনারা এটা কেন ভুলে যান মন্থরা তো একজন দাসী মাত্র। আর আমি, একজন ক্ষত্রিয় রাজকুমারী। নরেশ রাজা অশ্বপতির মেয়ে, মহারাজা দশরথের স্ত্রী। আর রাম? সে তো আমার কাছে পুত্র ভরতের মতোই প্রিয় ছিল। রামের রাজ্যভিষেকের খবর শুনে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে মন্থরাকে নিজের গলার হার উপহার দিয়েছিলাম। এর সত্যতা তো আর আপনারা অস্বীকার করতে পারেন না।

দশরথের চার পুত্রের জন্ম

ঋষি বাল্মীকির লেখা রামায়ণে বলা হয়েছে, মহারাজের সাথে আমার বিয়ের সময় রাজা ছিলেন বৃদ্ধ আর আমি ছিলাম যুবতী। কিন্তু তাই বলে তিনি আমার প্রিয় ছিলেন না, এমন বলা যায় না। দেবাসুর সংগ্রামে আমি ছিলাম মহারাজের সাথী। যুদ্ধ ময়দানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম। ইতিহাসে আমি এমনই একজন নারী, যে যুদ্ধ ময়দানে নিজের স্বামীর প্রাণ রক্ষা করেছিলাম। আর তাই মহারাজ  ভীষণ খুশি হয়ে আমার দুটি বর দিয়েছিলেন।

রামায়ণ রচনা করছেন বাল্মীকি

আমার এ বর চাওয়ার পেছনে আরও কারণ আছে। মহারাজের সাথে যখন আমার বিয়ের কথা হয়, তখন তার অন্তঃপুরে কৌশল্যা ও সুমিত্রা ছাড়াও আরো সাড়ে তিনশ রানী ছিল। এই অবস্থায় আমার বাবা আমার ভবিষ্যৎ সন্তানদের নিয়ে চিন্তিত ছিলেন,  আর এটাই তো স্বাভাবিক। তাই আমার বাবা রাজা দশরথের কাছে বিয়ের আগেই একটি শর্ত রাখেন, যা হলো, আমার ছেলেই হবে অযোধ্যার রাজা। তখন রাজা দশরথও একবাক্যে, নিঃসঙ্কোচে আমার বাবার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।

তাহলে এই প্রতিজ্ঞার অর্থ কি দাঁড়ায়? রাজকুমার ভরতের জন্মের আগেই সে যে অযোধ্যার রাজা হবে,তা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু রাম? সেও তো আমার কাছে ভরতের মতোই প্রিয় ছিল। রাজা দশরথ যদি রামকে রাজা বানানোর জন্য এবং আমার বাবার কাছে করা প্রতিজ্ঞা থেকে মুক্তি চাইতেন, আমি অবশ্যই তাকে মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু না। তিনি তা করেননি। ভরত যখন নৈনিহালে ছিল, তখন তারই অনুপস্থিতে, আমাকে না জানিয়ে রামের রাজ্যভিষেকের আয়োজন তিনি করেছিলেন। রাজ্যের পথে পথে যখন রামের রাজ্যাভিষেকের উৎসব পালিত হচ্ছিল, আর তখন সর্বপ্রথম মন্থরার কাছ থেকে আমি এই সংবাদ পাই, আমার স্বামীর কাছ থেকে না।

কৈকেই ও মন্থারা

রাজা দশরথ ছিলেন আমার ধর্মপুরুষ, আমার স্বামী। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও এই ধরনের একটা সিদ্ধান্ত নেয়া কি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ নয়? অবশ্যই তা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ! আর ঠিক তখন আমার ছেলে ভারতের কথাই আমার মানসপটে ভেসে উঠছিলো। রাজা দশরথের মনে যদি কোন পাপ না ই থাকতো, তাহলে তিনি ভরতের অনুপস্থিতিতে, অথবা আমাকে না জানিয়ে চুপিসারে রামের রাজ্যভিষেকের আয়োজন কেন করেছিলেন? কেন? এর কি কোন উত্তর আছে?

আমার বাবা, যার কাছে মহারাজ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন, তিনি আজ বেঁচে নেই। আর সেই সুযোগটি মহারাজ গ্রহণ করেছিলেন l  নির্বিকার ভাবে তার প্রতিজ্ঞা ভুলে গিয়েছিলেন। তাই আমার সামনে আর কোন রাস্তাই খোলা ছিল না।

ভরত তাঁর পিতা দশরথের শ্মশানের সময় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন।

আমার মনে হলো, মহারাজ দশরথের কাছ থেকে পাওয়া দুটো বর কেন আমি ব্যবহার করব না? যখন বাবার কাছে করা প্রতিজ্ঞা অর্থহীন হয়ে গেল মহারাজের কাছে, তখন আমার বর গুলো আমি ব্যবহার করলে অসুবিধাটা কোথায়? আর তাই রামের প্রতি ভালোবাসা সম্পূর্ণভাবে থাকা সত্ত্বেও, মহারাজের উপর রাগ করে সেই দুটো রব চেয়ে বসলাম।

কৈকেয়ী বলেছিলেন যে দশরথ কর্তৃক প্রদত্ত দুটি বিধান অনুসারে রামের ১৪ বছরের জন্য বনবাসে যাওয়া উচিত এবং ভরতকে অবশ্যই রাজা হতে হবে।

নিজের ছেলে ভরতের জন্য সিংহাসন, রামের জন্য বনবাস………

নিজের ছেলে ভরতের জন্য না হয় সিংহাসন চেয়েছিলাম। কিন্তু রামের জন্য বনবাস? কেন? এর পিছনেও একটা কারণ আছে। আমার বাবা রাজা অশ্বপতিবেদ, উপনিষদ থেকে আমাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, মানুষের মন পরিবর্তনশীল। মানুষ খুব দ্রুতই সময়ের সাথে সাথে সব ভুলে যেতে পারে। রামের অনুপস্থিতি তাই একান্ত কাম্য l সুতরাং ভরতের সিংহাসন ও ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্যই আমি এই পথ বেঁছে নিয়েছিলাম। সবার কাছ থেকে রাম কিছুদিন দূরে থাকলেই ভরতের জন্য রাজ্য চালানো সহজ হবে। এটাই আমি ভেবেছিলাম। যদিও প্রথম প্রথম আমি কিছুটা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু, স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতার পর ভরতের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা ছাড়া আমার মনে আর কিছুই ছিল না।

রাম কৈকেয়ীর অনুরোধ শুনলো

এতকিছুর পরও কুলগুরু বশিষ্ট্য, মহারাজ দশরথ, রানি কৌশল্যা, এমনকি নিজের ছেলে ভরতও পুরো রাজ্যের সামনে আমাকে পাপী, বিশ্বাসঘাতক, স্বামীর হত্যাকারী বলে অপমান করে। সব অপমান আমি সহ্য করেছি। আমি জানি ,আমার ভুল হয়েছে। কিন্তু আজ, ৫০০০ বছর পরে আপনারা কি দেখতে পাচ্ছেন আমি কেন এমনটা করেছিলাম? স্বামীর প্রতি আমার সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল। আস্থাও ছিল।  কিন্তু আমি এটা কি করে ভুলে যাই কি করে, মহারাজা আমার সাথে বিস্বাসঘাতিকতা করেছিলেন। আমাকে দেয়া কথা,বাবাকে দেয়া কথা তিনিও তো রাখেননি।

এখানেই শেষ নয়। ভাগ্যে আরও বিপর্যয় আছে। সব কিছু ভুলে রামকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে আনার পথে চিত্রকুটে ভরদ্বাজ ঋষির আশ্রম এ আমার নিজের ছেলে ভরত আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়,  এই সেই  রাজ্যলোভী, স্বামী হত্যাকারী, দেখতে মানুষের মত হলেও আসলে একটা রাক্ষসী। এই মহিলা কৈকেয়ি আমার মা, রাক্ষসী!!! নিজের ছেলে কখনো তার মাকে এইরকম অপমান করেছে, তা কি শুনেছেন কখনো? না। আমাকে তাও সহ্য করতে হয়েছে। আমি মানছি, আমি ভুল করেছি। কিন্তু একজন মহারানীর যখন নতমস্তকে নিজের সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে যায়, সেটা কি প্রায়শ্চিও নয়? সে কি অনুতপ্ত নয়? তারপরেও এত অপমান ?

ভরদ্বাজ ঋষি

হ্যাঁ, পুরো ঘটনাতেই আমার হয়তো ভুল ছিলো। কিন্তু একবার ও কি ভেবেছেন, এই ধরণের পরিস্থিতিতে মানুষের ভুল হওয়া টাই স্বাভাবিক? এই ধরণের ভুল হওয়াটা অন্যায়ের কিছু নয়? কখনোই কি ভেবেছেন? আর এই ভুলের কারণ কি ছিলো? সত্য প্রতিষ্ঠা করা। আমার ছেলের প্রতি যে অন্যায় হয়েছিলো, তার পরিবর্তন আনা। ছেলের প্রতি ভালোবাসা থেকেই আমার এইটা করতে হয়েছে, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য। এইটা কি ন্যায্য নয়?

আপনাদের কাছে আমার কিছু চাওয়ার নেই। আপনারা যদি আমাকে ন্যায় বিচার না দিতে পারেন, তাতেও আমার কোন রাগ নেই। পাঁচ হাজার বছর ধরে সহ্য করে আসছি। কিন্তু বলুন তো কেন বারবার চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী পৌরষ ও আদর্শের কাছে বলি হয়েছে নারীরা। সব সময় প্রায়শ্চিও করতে হয়েছে নারীদেরই। যেমন দোষী হয়ে প্রায়শ্চিও করেছি, ঠিক তেমনি সীতাও কিন্তু অন্যায় প্রায়শ্চিও থেকে রেহাই পায়নি। আর কি বলবো! কোন একদিন হয়তো আপনারা বুঝবেন, হয়তো বুঝবেন নারীর সম্মান। আপনাদেরই একজন কবি বলেছেন, কাল অত্যন্ত, আর পৃথিবী অত্যন্ত বিপুল, অত্যন্ত বিশাল।

তথ্যসূত্রঃ একটি হিন্দি কবিতা অবল্বনে লেখা।