মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে ‘খানজাদা’ নামটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। খানজাদা বেগম একজন শেহজাদী। ত্যাগ আর নেতৃত্বের এক বিরল মিশ্রণে গড়া তার জীবনের ইতিহাস। মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য দাদী দৌলত বেগমের সাথে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন খানজাদা বেগমও। তিনি দ্বিতীয় ওমর শেখ মির্জার বড় মেয়ে এবং মুঘল সম্রাট বাবরের বড় বোন।
‘বাবরনামা’-তে নিজের এই বোনের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের কাহিনী গর্বের সাথে বর্ণনা করেছেন বাবর। মুঘল পরিবারের সম্মান ও সুরক্ষা বহাল রাখার ক্ষেত্রে অপরিসীম অবদানের জন্য খানজাদাকে বাবর ভীষণভাবে সম্মানিত করেছেন। বোনের এই অবদানকে বাবর এক বিশাল কৃতিত্ব বলে আখ্যা দেন l
১৫০৩ সাল। উজবেকস্তানের বোখারায় খানাতে প্রদেশের প্রতিষ্ঠাতা উজবেক নেতা মুহম্মদ শায়বানী খান সমরকন্দ অবরোধ করেছেন। বাবর ও তার দলকে সমরকন্দে ছয় মাস অবরোধ করে রাখেন তিনি। একটু একটু করে অবরোধের মাত্রা তীব্র হতে থাকে। এক সময় পরিস্থিতি এতোটাই খারাপ হয়ে যায় যে, ক্ষুধা দূর করবার জন্য সমরকন্দের মানুষ কুকুর ও গাধা খেতে শুরু করে। এক পর্যায়ে শায়বানী খান একটি শর্ত রাখেন বাবরের সামনে। শেহজাদী খানজাদাকে বিয়ে করতে চান তিনি। সম্রাট বাবর যদি তার বোন খানজাদা বেগমকে শায়বানীর সাথে বিয়ে দেন, তাহলেই স্থায়ী মৈত্রীর পথে তিনি আসবেন বলে আশ্বাস দেন বাবরকে। খানজাদা বেগম স্বেচ্ছায় এই বিয়েতে মত দেন। পরিবার বাঁচাতে নিজেকে তিনি শত্রুর হাতে সঁপে দেন। তেইশ বছর বয়সী বুদ্ধিমান রাজকুমারী ভাইয়ের কল্যাণের জন্য এতো বড় আত্মত্যাগ করতেও দ্বিধাবোধ করেন নি।
খানজাদার বিবাহিত জীবনও সুখের ছিলো না। তাকে প্রচন্ডভাবে অপমান করা হয়, এমনকি মারধোরও করা হয়। তিনি সমস্ত কিছু সহ্য করে যান। খানজাদা তার একমাত্র ছেলের জন্ম দেন, কিন্তু ভাগ্য এই ক্ষেত্রেও তার জন্য সুপ্রসন্ন ছিলো না। শিশুটি শৈশবেই মারা গিয়েছিলো। সন্তানসুখও তার কপালে জোটে নি। তার উপর খানজাদার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, তিনি তার ভাই বাবরের সাথে মিলে স্বামী শায়বানীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। এই অভিযোগ সত্যি হলেও, তা তৈমুর বংশের প্রতি তার অটল ভালোবাসারই প্রমাণ বহন করে।
স্বামীর সাথে প্রতারণার সন্দেহের কারণে শায়বানী তাকে তালাক দিয়েছিলেন। তবে শুধু তালাক দিয়েই ক্ষান্ত হন নি শায়বানী। খানজাদাকে অপমান করার জন্য তিনি তাকে সায়্যিদ হাদা নামের একজন নিম্ন পদস্থ ব্যক্তির সাথে বিয়ে দেন।
১৫১০ সালে পারস্যের সাফাবিদ সাম্রাজ্যের শাসক শাহ ইসমাইল এবং শায়বানী খানের মধ্যে সংঘটিত মার্ভের যুদ্ধে শায়বানী খান ও সায়্যিদ হাদা উভয়েই নিহত হন। যুদ্ধের পর শাহ ইসমাইল যখন আবিষ্কার করলেন যে, খানজাদা বেগম বাবরের বোন, তখন তিনি তাকে বাবরের কাছে ফিরিয়ে দেন। এর পর তেত্রিশ বছর বয়সী খানজাদা নিজ ভূমিতে দশ বছর অনুপস্থিত থাকার পর আবারও তার ভাইয়ের ভবিষ্যতকে রক্ষা করার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বোন খানজাদার উদ্দেশ্যে বাবর লিখে গিয়েছেন, “আপনি একজন বীরাঙ্গনা, আমার ত্রাণকর্তা, আমার দেবী, আমার সৌভাগ্যের বাহক। আপনার আত্মত্যাগ না থাকলে আমি আজ বেঁচে থাকতাম না। আপনি না থাকলে নিশ্চিতভাবেই কাবুল জয় কিংবা নিজের শাসন সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করে যাওয়া আজ আর আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। আপনি শুধু এই পরিবারের একটি অংশই হবেন না, আপনি এই পরিবারকে নেতৃত্ব দিবেন। আপনি এই সাম্রাজ্যের পাদশাহ বেগম, এই বংশের আলো। আপনার কারণেই আজ আমাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় নি।“
খানজাদার আবারও বিয়ে হয়েছিলো মুহাম্মদ মাহদী খাজার সাথে l তবে বিয়ের সঠিক তারিখ জানা যায় নি। অ্যানেট বেভারিজের মতে, বিয়েটি তার ফিরে আসার কিছু দিনের মাঝেই হয়েছিলো।
বাবরের মৃত্যুর পরও খানজাদা বেগম মুঘলদের মধ্যে সবচাইতে ক্ষমতাধর নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাকে ‘হিন্দুস্তানের পাদশাহ বেগম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এমন সম্মান কেবল অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন নারীদের জন্যই নির্ধারিত ছিলো।
খানজাদা বহু কষ্টের পর বাবরের পরিবারে ফিরে আসেন। পরিবারের নিরাপত্তার খাতিরে তার আত্মত্যাগের জন্য কেবল বাবরই নন, তার ছেলে হুমায়ুনসহ পরবর্তী প্রজন্মের সকলেই খানজাদাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতেন।
১৫৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিন দিন তীব্র জ্বরে ভুগে ক্বাবাল-চকে মারা যান এই আত্মত্যাগী নারী। তিনি তখন তার ভাতিজা হুমায়ূনের সাথে ছিলেন। তার দেহাবশেষ প্রথমে ক্বাবাল-চকেই দাফন করা হয়েছিলো, কিন্তু তিন মাস পর এটি কাবুলে স্থানান্তরিত করা হয়। বাবরের বাগানে তার পাশেই খানজাদাকে আবারও দাফন করা হয়। দুই ভাই-বোন আজও পাশাপাশি অবস্থান করছেন।
রেফারেন্স: