মুঘল সাম্রাজ্যের বাদশা আওরঙ্গজেব আলমগীর

কাশিমবাজারের পরিস্থিতি দিন দিন শুধু খারাপের দিকেই যাচ্ছে। যদিও সুরাট, বোম্বাই ও মাদ্রাজের পরিস্থিতিও তেমন সুবিধের নয়। কিন্তু কাশিমবাজার মনে হচ্ছে একদম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুর্নীতি, অবৈধ ব্যবসা ও চোরাকারবারি যেনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আর কাশিমবাজার তো ইউরোপীয় চোরাচালানকারীদের কুখ্যাত কুঁড়েঘরে পরিণত হয়েছে। নাহ! এমন পরিস্থিতি আর চলতে দেয়া যায় না। ভয়ঙ্করভাবে আগুনে পুড়ে যাওয়া নিজের মেয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সহায়তায় সুস্থ হয়েছিলো বলে প্রাক্তন সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে ব্রিটিশদের পাওয়া বছরে তিন হাজার টাকা শুল্ক দিয়ে ব্যবসা পরিচালনার অনুমতিই আজকের এই বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী। এবার এই ফরমান বাতিল করতেই হবে। শুল্ক বাড়িয়ে দেয়ার সময় হয়েছে। শাহজাহানের ছেলে বর্তমান মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব অবশ্য এতে দ্বিমত করবেন না। কারণ কোম্পানির অনিয়ম তারও মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈঠকঘরে অন্যমনস্কভাবে এসবই ভাবছিলেন বাংলার সুবাদার তথা প্রাদেশিক শাসক ‘আমির-উল-উমার’ উপাধির অধিকারী মির্জা আবু তালিব ওরফে শায়েস্তা খান।

শায়েস্তা খান (আওরঙ্গজেবের মামা)

‘শায়েস্তা খান’ নামটি ভগ্নিপতি সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন তিনি। সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের মামা হন বলে তিনি খুব ভালোভাবেই সম্রাটের মনস্থিতি বুঝতে পারেন। এই সময় অবশ্য দক্ষিণের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আওরঙ্গজেব ব্যস্ত সময় পার করছেন। তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তাকেই কিছু একটা করতে হবে। যেই ভাবা, সেই কাজ। শুল্ক ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩.৫ শতাংশ করে দিলেন তিনি। কিন্তু এবার ঝামেলা বাঁধলো আরেক জায়গায়। বেঁকে বসলো ব্রিটিশরা। আর তাদের এই প্রত্যাখ্যানকে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিই হয়ে উঠলেন সম্রাট এবং সুবাদারের মাথা ব্যথার নতুন কারণ। নাম তার ‘চাইল্ড’। নামে শিশুসুলভ ছাপ থাকলেও নামের সাথে তার আচরণের কোনো মিল নেই। অবশ্য মাঝে মাঝে কিছুটা ‘চাইল্ডিশ’ আচরণও করে বসেন তিনি। কেননা কোনো কিছুতে ‘না’ শোনার অভ্যাস তার একদমই নেই। তাই শেষমেষ বাঁধিয়ে দিলেন এক দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ, যা ‘চাইল্ড যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এটিই ছিলো প্রথম বড় ধরনের অ্যাংলো-ভারত যুদ্ধ। প্রায় ১৬৮৬ সাল থেকে ১৬৯০ সাল পর্যন্ত এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিলো। যুদ্ধের শুরু যদিও চাইল্ডের জেদ থেকেই হয়েছিলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত চরম পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছিলো ইংরেজদেরকে। এই যুদ্ধের ইতিহাস ব্রিটিশদের জন্য চরম লজ্জার, কিন্তু আমাদের জন্য অত্যন্ত সম্মান ও গৌরবের। একগুঁয়েমি স্বভাব থাকার পরও কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাটিতে নাক খত দিতে হয়েছিলো চাইল্ডকে, ক্ষমা চাইতে হয়েছিলো সম্রাটের পায়ে লুটিয়ে পড়ে। উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো নত হতে হয়েছিলো ইংরেজদেরকে, মুঘল সম্রাটের কাছে। আর এই অপমানকে ধামাচাপা দিয়ে আজও নিজেদের মেকী আড়ম্বর প্রদর্শন করে যাচ্ছে এই শোষকজাতি।

কোম্পানির সদর দপ্তর লন্ডন

আগে জানা যাক, কে এই ‘চাইল্ড’? তার পুরো নাম হলো জোসিয়া চাইল্ড। সেবার হেরে গেলেও ইংরেজরা কিন্ত তাকে সান্ত্বনা-পুরস্কার হিসেবে ‘স্যার’ উপাধি দিয়েছিলো এবং পরবর্তীতে নামের সাথে ‘স্যার’ যুক্ত হয়ে তার পুরো নাম হয় ‘স্যার জোসিয়া চাইল্ড’। জোসিয়া চাইল্ড সতেরো শতকের আশির দশক ও নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন পরিচালক ছিলেন। চাইল্ড ছিলেন একজন জাত-ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। বাণিজ্যিক কৌশল বিষয়ক তার সাংঘাতিক রকমের জ্ঞান ছিলো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে নিয়োগ ও প্রভাব বিস্তার করাও ছিলো তার কৌশলগত প্রয়োগের একটি অংশ। ইংল্যান্ডে তিনি ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। ১৬৮১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর হওয়ার আগে তিনি ১৬৭৭ সালে ‘হাউজ অফ কমন্স’ –এর সদস্যও হয়েছিলেন। তাকেই প্রথমে আওরঙ্গজেবের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ব্যবসায়িক ফরমান নিতে পাঠানো হয়েছিলো। চরম ব্যবসায়িক জ্ঞানের সূত্রে চাইল্ড খুব ভালোভাবেই ধারণা করতে সক্ষম ছিলেন যে কোথায় কলোনি বানালে তার লাভ। বাংলা যে প্রচন্ড রকমের উর্বর এক ভূমি সে বিষয়টিও তার জ্ঞানের সীমার আড়াল হয় নি।

প্রায় ৪০০ বছর আগে ১৬১৫ সালে চতুর্থ মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে টমাস রো-ও এসেছিলেন এই উপমহাদেশে বিশেষ সুযোগে, ব্রিটিশ রাজা প্রথম জেমসের দূত হিসেবে। তিনিই প্রথম অনুধাবন করেছিলেন যে, বাংলা অনেক সমৃদ্ধ ও একই সাথে প্রচন্ড শক্তিশালী একটি অঞ্চল, যে কোনো মূল্যে একে নিজেদের আওতায় না আনতে পারলে কোনো এক সময় নিশ্চিত হামলার শিকার হতে হবে; তা ছাড়া পর্তুগীজরাও এখানে ব্যবসার মাধ্যমে প্রচুর লাভবান হচ্ছে, সুতরাং যে করেই হোক বাণিজ্যিক আধিপত্য ব্রিটিশদেরই হওয়া চাই এখানে।

ভারতবর্ষে যখন থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলো, তখন থেকেই তারা এ উপমহাদেশের ইতিহাসের বিকৃত পরিবেশন শুরু করে। উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়া, নিজেদের গৌরব ও সফলতার চরম আত্মপ্রকাশ ইত্যাদি উদ্দেশ্যেই মূলত তারা ইতিহাসকে বিভিন্ন কৌশলে কলুষিত করেছে।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গৌরবগাঁথাকে অমর করে রাখবার জন্য সবসময়ই নানারকম কূটকৌশল অবলম্বন করেছে ব্রিটিশরা। তারা নিজেদের ইতিহাসকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সবসময়ই গৌরবময় রূপে তুলে ধরতে চায়। আর এ জন্যই তাদের সন্তানেরা সমস্বরে গেয়ে ওঠে, “ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কখনোই অস্ত যাবে না”। কিন্তু তাদের এক চরম অপমানজনক পরাজয়ের গল্প বেশ কৌশলে তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো, আর সেটি হলো চাইল্ড যুদ্ধের ইতিহাস। অন্তরালেই চলে গিয়েছিলো তাদের সেই ব্যর্থতার কাহিনী। আর তাদের এই লজ্জাজনক পরাজয় ঘটেছিলো সম্রাট আওরঙ্গজেবের সামরিক সামর্থ্যের মাধ্যমেই। তখন বৈশ্বিক জি.ডি.পি.-তে বাংলার কন্ট্রিবিউশান ছিলো ২৫ শতাংশ। আওরঙ্গজেবের কাছে তাদের এই চরম পরাজয়ের গল্পটি পরবর্তীতে স্বীকার করতে কষ্ট হবে বলে বিষয়টিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে সরিয়ে রাখতে তারা ভীষণভাবে চেষ্টা করেছিলো।

বাংলার জমি, বাংলার ভূমি অত্যন্ত লাভজনক বলেই পর্তুগীজ, ডাচ সবাই দলে দলে ভীড় করেছিলো ভারতীয় উপমহাদেশে। ইংরেজরা এসেছিলো সবার পরে। প্রথমে তারা ওয়েস্ট কোস্ট বা পশ্চিমের দিকে বাণিজ্য শুরু করেছিলো। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই তারা লক্ষ করলো যে, পর্তুগীজরা ইস্ট কোস্ট বা পূর্বে ব্যবসা করে বিপুল অর্থসম্পদ অর্জন করছিলো। আর এ কারণে তারাও অবশেষে ইস্ট কোস্টেই মনযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলো।

বাংলার অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেব বাংলাকে ‘ন্যাশান্স প্যারাডাইস’ বা ‘জাতির স্বর্গ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। সেই বাংলার সম্পদ নিয়ে ব্যবসা করবার জন্যই জোসিয়া চাইল্ড এই অঞ্চলে তার লোলুপ দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন। বাংলায় বাণিজ্য করার তাগিদ তার শুরু থেকেই ছিলো, তবে তার ইগো ও পরশ্রীকাতরতা এই তাগিদকে চাহিদায় রূপান্তরিত করেছিলো।

ব্রিটিশরা প্রথম কারখানা করেছিলো বোম্বের সুরাট শহরের পশ্চিম উপকূলে, এরপর আগ্রায় এবং এরপর মাদ্রাজে ও কাশিমবাজারে। বাংলায় পর্তুগীজদের রমরমা বাণিজ্যিক অবস্থান নিয়ে তাদের অনেক অসন্তোষ ছিলো। ব্রিটিশরা ব্যবসা-বাণিজ্যে সবার উপরে থাকার জন্য সবসময়ই একটি ভালো সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। অবশেষে ১৬৬১ সালে পর্তুগীজ রাজকন্যা ক্যাথরিনের সঙ্গে ব্রিটিশ রাজা দ্বিতীয় চার্লসের বিয়ের মাধ্যমে পর্তুগীজ-ব্রিটিশ সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং সেই সাথে শুরু হয় ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে পর্তুগীজদের বিরোধ। এই বিয়েতে যৌতুক হিসেবে চার্লসকে দেয়া হয় ‘মুম্বাই’। তখন গান পাউডারের অন্যতম উপকরণ সোরার ৭৫ ভাগই সরবরাহ হতো বাংলা থেকে। এ কথা মাথায় রেখেই ১৬৮১ সালে পাঠানো হয় বাংলার ইংরেজ কোম্পানিগুলোর গভর্নর উইলিয়াম হেজেজকে, বাংলায় একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য। জোসিয়া চাইল্ড তখন খুবই বিত্তশালী, বিভিন্ন রকম কলোনিয়াল ব্যবসাও পরিচালনা করছিলেন এবং আমেরিকায় গিয়েও প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছিলেন তিনি।

বাংলা তো চাইল্ডের জন্য প্রচন্ড গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলোই, তবে চট্টগ্রামই সবচেয়ে বেশি ধুর্ত চাইল্ডের নজর কেড়েছিলো। চট্টগ্রাম তখন ছিলো প্রচুর সমৃদ্ধ, আর বাণিজ্যিক যোগাযোগের জন্য সর্বোত্তম। প্রচন্ড শক্তিশালী এক দুর্গের মতো অঞ্চল ছিলো বলে চট্টগ্রাম দখল করাও ছিলো দুরূহ ব্যাপার। চট্টগ্রাম নিয়ে আরাকানদের সাথে মুঘল শাসকদের সবসময়ই ঝামেলা লেগে থাকতো। তবে সুবাদার শায়েস্তা খান তার ত্রিমুখী কর্মসূচি প্রণয়নের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

চাইল্ড কিন্তু মুঘলদের শক্তি ও শায়েস্তা খানের সতর্ক দৃষ্টি সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন নি। তাই তো নিজের মুখে কালি লাগার দায়ভার তার নিজের উপরেই বর্তায়। আওরঙ্গজেবের দূরদর্শিতা বিষয়ের ভুল অনুধাবনই ছিলো তার পরাজয়ের মূল।

মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমল থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমগ্র মুঘল সাম্রাজ্যে নিয়মিত বাণিজ্য করার অনুমতির জন্য সম্রাটদের কাছ থেকে একটি ফরমান লাভের চেষ্টা চালায়। ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ এই উপমহাদেশকে ইংরেজরা লুট করতে ছুটে আসে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে। শেষমেষ অনেক দেন-দরবার করে সম্রাট শাহজাহানের আগুনে পুড়ে যাওয়া মেয়েকে ড. বাউটনের সহায়তায় সুস্থ করার পর সম্রাটের কাছ থেকে তারা পেলো বাংলায় ব্যবসা করার ফরমান বা অনুমতিপত্র, যার মাধ্যমে ইংরেজরা মাত্র তিন হাজার টাকায় বছরে একবার শুল্ক দিয়ে পুরো বছর ব্যবসা করতে পারবে। এ ব্যবস্থা ছিলো বাংলার জন্য চরম ক্ষতির। শাহজাহানের পর তার ছেলে আওরঙ্গজেব যখন সম্রাট হলেন, মুঘল রীতি অনুযায়ী এসব অনুমোদন তখন বাতিল হয়ে গেলো। এতে ব্রিটিশদের ব্যবসায় লাভ কমে গেলো। বেঁধে গেলো বিশাল গন্ডগোল।

বাংলার সুবাদার যেহেতু তখন আওরঙ্গজেবের মামা শায়েস্তা খান, যার আমলে এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেতো, সেহেতু সে সময় বাংলা ছিলো ভাতে-মাছে ভরপুর, সবাই শান্তিতে বসবাস করছিলো। ব্রিটিশদের ব্যবসায় লাভ কমে যাওয়ায় মেজাজ গেলো বিগড়ে। আওরঙ্গজেব তখন ভীষণ ব্যস্ত। সম্রাট তার সেনাবাহিনীকে নিয়ে দাক্ষিণাত্যসহ অন্যান্য রাজ্যগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর চেষ্টা করছিলেন, অন্য কোনো দিকে তার মনযোগ দেয়া সম্ভব ছিলো না। এই সমস্ত কারণে ইংল্যান্ডের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের তেমন গুরুত্ব দেন নি তিনি। আওরঙ্গজেবের আমলে শায়েস্তা খান বাংলার একজন শক্তিশালী ও প্রভাবশালী গভর্নর ছিলেন। চাইল্ড যুদ্ধের সময়ও তিনি মুঘল বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন।

সময়ের সাথে সাথে কোম্পানির ব্যবসা স্থানীয় শাসক ও ব্যবসায়ীদের জন্য হুমকি হিসেবে উপস্থিত হলো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামমাত্র ট্যাক্স দিয়ে তাদের ব্যবসা চালাবার পাশাপাশি কোম্পানির বিভিন্ন কর্মচারীরা চোরাকারবারি, দুর্নীতি ইত্যাদি অবৈধ বাণিজ্য করতে থাকে। এক পর্যায়ে কাশিমবাজার ইউরোপীয় চোরাচালানকারিদের একটি কুখ্যাত কুঁড়েঘর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। অবশেষে এমন অবস্থা হলো যে, তা মুঘল কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলো। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে জড়িত এসব অসৎ ব্যবসায়ীরা আবার উল্টো স্থানীয়দের উপর হামলাও করতো। এভাবে কোম্পানি একচেটিয়া বাণিজ্য আইন লঙ্ঘন করে যাচ্ছিলো। এমন অবস্থায় বাংলার বাণিজ্যের বাজার সবার জন্য ঠিক রাখতে শায়েস্তা খান ২% থেকে ৩.৫% শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নতুনভাবে চালু হওয়া এই ট্যাক্স ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রত্যাখ্যান করে এবং বাংলা প্রদেশকে তারা ব্যবসায়ের জন্য দখল করার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। চাইল্ড নিজের জেদ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সম্রাট আওরঙ্গজেবকে হত্যার হুমকি দিয়ে বসেন।

বাংলা দখল করবার জন্য চাইল্ড তার সেনাবাহিনী নিয়ে চট্টগ্রাম অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। এদিকে আরাকানরা তো আগে থেকেই ছিলো মুঘল-বিরোধী। তাই কৌশলে তিনি আরাকানের রাজার সাথে চুক্তি করেন। কিন্তু শায়েস্তা খান কোম্পানির অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করার হুকুম দেন ও বেশ কিছু বিধিনিষেধ বেঁধে দেন। তবে একগুঁয়ে স্বভাবের চাইল্ড তা মানতে নারাজ। উল্টো তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ও ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় জেমসকে সেনা পাঠাতে অনুরোধ করেন। রাজা বারোটি যুদ্ধ জাহাজ দিয়ে অ্যাডমিরাল নিকোলসনকে পাঠিয়েছিলেন। এরপর চাইল্ড মাদ্রাজ থেকে আরও ৪০০ জন সৈন্য, ২০০ টি কামান এবং ৬০০ জন পুরুষের একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে এসেছিলেন। তার নির্দেশ ছিলো চট্টগ্রাম দখল করতেই হবে। কিন্তু ভাগ্য তাদের প্রসন্ন ছিলো না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জাহাজগুলো গিয়ে হুগলি বন্দরে নোঙর করতে বাধ্য হয়।

হুগলিত

তবে পরিস্থিতি ব্রিটিশদের অনুকূল না হলেও বাংলার জন্য তা ছিলো সৌভাগ্যসম। শায়েস্তা খানও তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ইংরেজ বাহিনীকে দমন করতে চট্টগ্রামে তাঁবু ফেলেন। হুগলিতে ব্রিটিশ নৌ বহর দেখে তিনি বেশ সতর্ক হয়ে যান। তাদের সাথে সমঝোতা করবেন এমন সিদ্ধান্ত নেবার প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলেন। কিন্তু ঠিক সেই সময়ই ঘটে যায় এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। হুগলি নদীর কাছের একটি বাজারে তিনজন ইংরেজ সেনার সাথে মুঘল কর্মকর্তাদের ভীষন ঝগড়া বেঁধে যায় এবং ইংরেজ সেনাদেরকে সেখানে মারাত্মকভাবে মারধোর করা হয়। প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি বিপরীত ক্রিয়া তো থাকবেই, নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র তো কোনো ক্ষেত্রেই খন্ডানো সম্ভব নয়। তাই এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে অ্যাডমিরাল নিকোলসন শহরে গুলি চালায় এবং এখানেই শেষ নয়, তারা বাংলার ৫০০ ঘরবাড়ি পুড়িয়েও দেয়। এতে শায়েস্তা খান প্রচন্ড রেগে যান। তিনি দ্রুত ইংরেজ শিবিরে আক্রমণ করার আদেশ দেন। তার আদেশ অনুযায়ী মুঘল বাহিনী ব্রিটিশদের আক্রমণ করে এবং একেবারে তাদেরকে নদীর মুখের ইঙ্গেলি দ্বীপে চলে যেতে বাধ্য করে। ইঙ্গেলি দ্বীপ হলো একটি নিম্ন জলাভূমি, মারাত্মক সব অসুখ-বিসুখ এর আবাসস্থল এই দ্বীপ। ঐ রকম এক জায়গায় মুঘল বাহিনী প্রায় পরবর্তী তিন মাস তাদের অবরোধ করে রাখে। জব চার্ণকের ভাষায়, এই জায়গাটি হলো বাংলার সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর এলাকা। এই কঠিন পরিস্থিতিতে থাকার সময় তিন মাসে চার্ণকের স্ত্রী-সহ প্রায় অর্ধেক ব্রিটিশ সেখানে মারা গিয়েছিলো এবং বাকি অর্ধেক হাসপাতালে পড়ে ছিলো। অনেকে উপায় না পেয়ে মক্কার তীর্থযাত্রীদের বহনকারী জাহাজগুলোও দখল করেছিলো।

গঞ্জের-সাওয়াই জাহাজ

এরই মধ্যে হেনরি এভরি নামের এক ইংরেজ জলদস্যু মক্কা থেকে হজ্জ্ব-ফেরত মুঘল জাহাজ ও গঞ্জের-সাওয়াই জাহাজসহ বেশ কয়েকটি জাহাজ লুট করে, ফলে এ দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যায়। গঞ্জের-সাওয়াই জাহাজটি ছিলো সম্রাট আওরঙ্গজেবের বাণিজ্যিক জাহাজ, এটি ছিলো সুরাট বন্দরের সবচেয়ে বড় জাহাজ, তার উপর ঐ জাহাজে যাত্রী হিসেবে ছিলো অনেক মুঘল নারী। আওরঙ্গজেব এই ঘটনায় প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হলেও এমনই এক সুযোগের অপেক্ষাই তিনি করছিলেন। এবার সম্রাট দেখালেন তার খেলা। দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার বাহিনী নিয়ে মাদ্রাজে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান এবং তাদের পরাজিত করেন। যুদ্ধ শেষে পরাজিতদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করারও আদেশ জারি করেন এবং অবিলম্বে পুরো ভারতবর্ষে সমস্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য বন্ধ ঘোষণা করেন। এর ফলে ব্রিটিশরা একদম অথৈ জলে পড়ে যায়। মুম্বাই, মাদ্রাজ, কোলকাতা এবং চট্টগ্রামের মতো বড় বড় শহরগুলোতে ব্রিটিশরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শক্তি বাংলা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই শহরগুলোতে অনেক হ্রাস পেয়েছিলো।

এমন পরিস্থিতিতে মুঘল বাহিনী বিভিন্ন স্থান থেকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের গ্রেপ্তার করে চলছিলো, ফলে আর কোনো উপায় না পেয়ে চাইল্ড অবশেষে সমঝোতার সিদ্ধান্ত নেন, কেননা তার ব্যবসায়িক মন তাকে যে কোনো মূল্যে সমৃদ্ধ বাংলায় বাণিজ্য করা থেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ। তাই সমঝোতার আশ্রয় নেন তিনি এবং পরাজয় স্বীকার করে মুঘল দরবারে ক্ষমা চান। সম্রাটের ক্ষমা পাবার জন্য ব্রিটিশদেরকে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হয়েছিলো (আজকের হিসেবে তা প্রায় ৪.৪ মিলিয়ন ডলার)। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে চাইল্ড সম্রাট আওরঙ্গজেবের পায়ের সামনে হাঁটু গেঁড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মাফ চাওয়ার সেই দৃশ্যটি অমর করে রাখার জন্য একটি ছবিও আঁকা হয়েছিলো। অবশ্য পরে সম্রাট আওরঙ্গজেব কোম্পানিকে ক্ষমা করেছিলেন এবং ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছিলেন।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, চাইল্ড যুদ্ধের প্রায় ৭০ বছর পরে ইংরেজ লর্ড ক্লাইভ পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন এবং সমগ্র বাংলা দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এভাবেই ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলো এবং তাদের জয়ের গল্প দিগ্বিদিক ছড়িয়ে দিলেও এই পরাজয়ের গল্প ইচ্ছে করেই ইতিহাস থেকে মুছে দেবার চেষ্টা করেছিলো তারা। তবে যতো কূটকৌশলই অবলম্বন করুক না কেনো, শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে মুঘল সাম্রাজ্যের কাছেই পরাজিত হতে হয়েছিলো, যা তাদের অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই।

সত্যি বলতে বাংলার মতো এতো সমৃদ্ধ একটি অঞ্চলের এই বর্তমান দৈন্যদশা আমাদেরই অসচেতনতার ফলাফল। আমাদের সচেতনতার অভাবেই আমরা আজ পরাধীন। দক্ষিণ এশিয়ার এই এক টুকরো জমি যে কতো গুরুত্বপূর্ণ, সে সম্পর্কে আমাদের সামান্যতমও ধারণা নেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই চরিত্র, আমাদের শক্তিশালী অবস্থানের জন্য তাদের এমন বাজে পরিণতি যদি আমরা মনে রাখতাম, তাহলে ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে এমন চরম পরাজয় বাংলার মানুষকে দেখতে হতো না। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর কিছু সময়ের ব্যবধানেই ব্রিটিশরা তাদের এই চরম অপমানজনক পরিণতিকে গৌরবময় ও বাণিজ্যিকভাবে সফল একটি ইতিহাসে পরিণত করেছিলো। পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলাকে জয় করার মাধ্যমে তারা সারা পৃথিবীর ইতিহাস তৈরীতে একটি আমূল পরিবর্তন সাধন করেছিলো, যেটা চাইল্ড যুদ্ধের প্রেক্ষাপটের কথা ভাবলে আমাদের জন্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমেরিকার সাথে সংঘটিত যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানিকে তারা নিমিষেই ঢেকে ফেলতে পেরেছিলো বাংলা বিজয়ের মাধ্যমে। ফলে পৃথিবীতে বহু বছর তারা রাজত্ব করে গিয়েছে এবং একটি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী দেশকে তারা লুটপাটের মাধ্যমে দারিদ্র্যের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী কবলিত এলাকায় পরিণত করে ফেললো। এরই পরিণতি হিসেবে একসময় বৈশ্বিক জি.ডি.পি.-তে ২৫ শতাংশ দানকারী দেশকে এখন বিদেশী কোম্পানির সাহায্য লাভের আশায় কিংবা বিদেশে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ লাভের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয়। চিন্তার ভুল, গণনার অসমতাই আজ আমাদের মতো সমৃদ্ধ জাতিকে দরিদ্র জাতিতে পরিণত করেছে, যে চলমান ঘটনা আজও বাংলাদেশে বিদ্যমান।