সলিমুল্লা হল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই।
গেটের কাছে বের হলেই প্রতিদিন দেখি সেই ছেলেটিকে দশ-এগারো বছর বয়স।পরনে একটা শতচ্ছিন্ন ময়লা প্যান্ট।গায়ে তালির উপর তালি- দেওয়া একটা  কালো ওভারকোট।এড়িউঠা দেহ।উস্কো-খুস্কো চুল।
কতদিন তেল পড়েনি,কে বলবে।একই চিরাচরিত একঘেয়ে নাকিকান্না-
একটা পয়সা সাহেব।সারাদিন না খেয়ে আছি।এক পয়সা দান করলে সত্তুর পয়সা পাওয়া যায়।
পকেট হাতড়িয়ে খুচরো পয়সা দেই কোনদিন,কোনদিন বকুনি দেই।বকুনি দিলেও বিপদ।পট করে নিচু হয়ে পায়ে ধরে সালাম করে বসবে।
নাছোড়বান্দা।
কিছুক্ষণ পরেই তাকে দেখব মেডিক্যাল কলেজ-গেটে।দু’পয়সা মুড়ি  কাগজের ঠোঙায় নিয়ে চিবোবে; চিরাচরিত নিয়মে পয়সা চাইবে।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হলেই গেটের কাছে আবার তার শ্রীমুখ!- একটা পয়সা সাহেব!
উঃ। জ্বালাতন! দুষ্টুমি করে মেয়েদের দেখিয়ে দেই।ছোট টিনের মগটা ঠুনঠুন আওয়াজ করে ছুটবে।
পয়সা আদায় করে তারপর ছাড়বে।যিনি দেবেন না চিরাচরিত প্রথায় নিচু হয়ে এক সালাম!একেবারে শক্তি-শেল!বাধ্য হয়ে ভ্যানিটি-ব্যাগে হাত দেবেন তিনি।এমনি করে চলতে থাকবে কিছুদিন।একমাস।তারপর হঠাৎ একদিন উধাও।
তাকে দেখব সদরঘাটে,ইসলামপুরের মোড়ে অথবা মিটফোর্ডের সম্মুখে।হয়ত সেখান থেকেও কিছুদিন পর উধাও।
আবার নতুন সেন্টার।
সাইক্লিক অর্ডার ঘুরে এসে আবার সেই মুসলিম হল।মেডিক্যাল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়।
ঃ এই যে হিয়ার উই আর!এই,তোর দেশ
কোথায়?
ঃ ফরিদপুর।
ঃ ভিক্ষে করিস কেন?
ঃক্ষিদে পায় যে!
ঃ থাকিস কোথায়?
ঃ চকবাজারে।
ঃ কে আছে?
ঃ কেউ নেই।
ঃ কাজ করবি?
ঃ ডান হাত অবশ যে!
ঃ দেখি? তাইতো!
চকবাজার থেকে মার্কেটিং করে ফিরছিলাম সাইকেলে।গলির মোড়ে এসে থমকে দাঁড়ালাম।তাইতো!
সেই ছেলেটি তিনটি ইট বিছিয়ে ছেড়া কাগজ,টুকরো খড়ি এবং পাতা এনে সেই ইঁটের মধ্যে পুরে মাটির পাতিল চাপিয়ে রান্না করছে।ধুঁয়াথেকে চোখ বাচাবার জন্য চোখ বুঁজে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে বাঁকা হয়ে।
টগবগ করে চাল ফুটছে ছোট মাটির পাতিলে
ঃ এই তোর সংসার নাকি?
ঃ জি,হুজুর।
ভাবলাম,জিজ্ঞেস করে বিপদে পড়লাম নাকি?এক্ষুনি হয়ত পয়সা চেয়ে বসবে।কিন্তু তা চাইল না।
ঃ যাস না যে ওদিকে?
ঃ জ্বর,সাহেব।
ঃ ক’দিন?
ঃ পাঁচদিন।
ঃ খাস কি?
ঃ এতদিন যা ছিল পকেটে।
ঃ ফুরিয়ে গেলে?
ঃ মরে থাকব।
ঃ কি নাম বললি?
ঃ লাডু মিয়া।
থাক থাক! লাডুতেই চলবে!মিয়ার আর দরকার হবে না।
দেখলাম লাডুর সংসার।জুতোর দোকানের অনেকগুলি ভাঙা কাঠের বাক্স রেখে দিয়েছে  ছোট গলির মোড়ে।তারই তিনটে এক করে লাডুর ঘর উঠেছে।দুইটা বাক্স দুইদিকে বন্ধ।মাঝখান দিয়ে যাবার পথ। ভিতরটা অন্ধকার।একটা তেল চিটচিটে কাথা,জুতোর বাক্স দিয়ে বালিশ হয়েছে।একটা ঝোলনা।সেই চির-চেনা টিনের মগ,একটা ভাঙা আয়না এবং ভাঙা চিরুণী।সংক্ষেপে লাডুর সংসার।
এরপর লাডুকে অনেকদিন দেখিনি।গলির মোড়ে পড়ে রয়েছে কেরোসিন কাঠের বাক্স দুটি! তার ঝোলনা,টিনের মগ,আয়না,চিরুণী-সব।
সাইকেল থেকে নেমে জুতার দোকানীকে জিজ্ঞেস করি।-লাট-বেলাট,মন্ত্রী-হাকিম,কাশ্মীর,হায়দরাবাদ,হিল্লী-দিল্লীর খবর সকলে রাখে-কিন্তু গরীবের খবর কেউ রাখে না।হয়ত কুকুর  বেড়ালের মত কোথায় মরে পড়েছিল,শহরের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য মুরদা-ফরাস ফেলে দিয়েছে।
কিন্তু না,লাডু মরেনি।মেডিক্যাল হাসপাতালে গিয়েছিলাম অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে।চার নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে চমকে থমকে দাঁড়ালাম।
ঃ কিরে লাডু। তুই এখানে?
ঃ হ’ সার (লাডু স্যার বলতে শিখেছে)
ঃ কবে এলি?
ঃ একমাস।
ঃ কি হয়েছিল?
ঃ জ্বর।
ঃ তারপর?
ঃ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম পথের ধারে।
ঃ তারপর?
ঃ কে একজন ফেলে রেখে গেছে এখানে।
লাডুর ভাগ্য ভাল।তার সিট হয়েছে।দিব্যি আরামে আছে সে!দুধের মত পরিষ্কার সাদা বিছানা।নরম বালিশ,পশমের কম্বল,তার উপরে স্প্রিং -এর খাট।লাডু কি এর আগে এত আরামে কোনো দিন ছিল।লাল টুকটুকে কম্বল গায়ে দিয়েছে।গায়ে হাসপাতালের স্ট্রাইপ-এর শার্ট।পরনে স্ট্রাইপ-এর পায়জামা।
স্প্রিং-এর খাটের উপর বসে মাখন দিয়ে সে রুটি চিবোচ্ছিল।আর খাটের উপর বসে দুলছিল।লাডু দিব্যি আছে!সকালে ডিম-রুটি-মাখন-চা-দুধ,দুপুরে ভাত-মাংস,দুধ-কমলালেবু,বিকেলে মাখন-রুটি,দুধ-পুডিং।

সাহিত্যিক ড. আশরাফ সিদ্দিকী

বন্ধুকে দেখে লাডুর সিটে যাই।সে তখনো স্প্রিং-এর খাটের উপর জোরে দুলছে।হি হি করে হাসছে।
ঃ কিরে,কেমন আছিস?
ঃ খুব ভাল।
ঃ চলে যাবি কবে?
ঃ কোনো দিন যাব না।
ঃ তার মানে?এখানে চিরদিন তোকে থাকতে দেবে নাকি?
ঃ না,আমি যাব না।লাডুর চোখে মুখে দৃঢ় প্রতিবাদের ভাব।
বন্ধুকে দেখতে আসি।লাডুর সিটের দিকে তাকাই।শিস দিয়ে সমস্ত ওয়ার্ডময় ঘুরে বেড়াচ্ছে।একবার এ-বিছানার পাশে,একবার ও-বিছানার পাশে!ট্যাপ থেকে পানি ভরে নিয়ে দেয় কখনো কখনো কোন রোগীকে।আবার নিজের বিছানায় বসে দুলে নেয়। এক টুকরো রুটি চিবোয়।চিনি ফুরিয়ে গেছে।পাশে রোগীর কাছ থেকে ধার নেয়।বিকেল বেলাতেই দিয়ে দেবে আবার।মাখন চেয়ে নেয় ডানদিকের বেড থেকে।নার্স এসে যায়।ওষুধ খাবার পালা।বিছানা থেকে নেমে এক ছুটে গিয়ে নার্স-এর পায়ে এক আভূমি-নমিত সালাম।
কিন্তু না,পয়সার জন্য নয় এবারে।
হা হা করে হেসে ওঠে সকলে।দেখে দেখে অভ্যাস হয়ে গেছে সকলের।
ঃ কিরে দুষ্টু,কেমন আছিস?-নার্স বলে।
অবশ হাতটা অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরিয়ে উত্তর দেয়,ভাল আছি।
নার্সের পেছনে পেছনে সমস্ত ওয়ার্ডময় ঘুরে বেড়াবে। নার্স-এর ওষুধের প্লেট,থার্মোমিটার,পিউরিফাইয়ার এবং ইনজেকশনের বাক্স বহন করে চলবে তার পেছনে পেছনে। সমস্ত ওয়ার্ড ঘোরা শেষ হবে।এইবার তার পালা।
ঃ আপা!
ঃ কি?
বুঝতে পারে সবই নার্স।তেতো ওষুধে তার অরুচি।
ঃ আচ্ছা,আজ নাক-মুখ বুঁজে খেয়ে ফেল।কাল মিষ্টি ওষুধ দেব।
ঃ আপা।
ঃ কি?
আবার করুণ চোখে আবেদন। বুঝতে পেরেছে নার্স।
ঃ চকোলেট? আচ্ছা,নে আমার এ পকেট থেকে।হাত বন্ধ আমার।
চার চারটে চকোলেট পেয়ে লাডুর আনন্দের সীমা নেই।দোল দোল দোল।দুলতে থাকে স্প্রিং-এর খাটে।
হাসপাতালের নার্স!কথাটি শুনেই আপনাদের কেমন লাগে,না?যার কোন গতি নেই,সেই নাকি হাসপাতালের নার্স হয়।জাত হারিয়ে নাকি বৈষ্ণব সাজে!নার্স রোকেয়ার জীবনে এমন কোন ইতিহাস আছে কিনা জানি না,তবে এটা ঠিক,দারিদ্র্য তাকে টেনে এনেছে এখানে।ঠিক লাডুর মতই দেখতে দুষ্টু একটা ভাই ছিল তার।তেরশ’ পঞ্চাশে,মন্বন্তর যুদ্ধ-দাঙা-হাঙামা,ব্ল্যাক মার্কেট অনেক কিছু ঘটে গেছে বাংলাদেশে।রোকেয়ার পিতা-মাতা সব কিছু গেছে।লাডুর দিকে তাকিয়ে তার ভাইটির কথা মনে পড়ে।সে যেন তার স্মৃতি বহন করে চলেছে।
ছেলেটার প্রতি কেমন মায়া পড়ে গেছে তার!কত রোগী আসে,কতো রোগী চলে যায়।কতজন এলো,কতজন চলে গেল।সে-ও হয়ত চলে যাবে একদিন এবং খুব শীগগিরই।
ঃ ইউ,বেড নম্বর ফোরটিন!দেখি টিকেট?
ঃ লাডু।
ঃ ইয়েস!এল এ আর ইউ লাডু!- হাইজ-ফিজিসিয়ান নাম লেখেন।
ঃ তোকে চলে যেতে হবে,ভাল হয়ে গেছিস তুই।
বেদনায় ম্লান হয়ে ওঠে লাডুর মুখ।খাট থেকে নেমে চট করে পায়ে সালাম করে ফেলে সে হাউজ-ফিজিসিয়ানের।পয়সা নয়।যাবে না সে এখান থেকে?না-না,সে কিছুতেই যাবে না।
ঃআচ্ছা বেশ।কাল না হয় পরশুদিন চলে যাবি।ডাক্তার বলেন।
নার্স রোকেয়া আসে বিকেলে,ঘড়ির কাটায় কাটায়।পায়ে সালাম করে না লাডু।চকোলেট চায় না।গম্ভীর হয়ে থাকে সে।তারপর কেঁদে ফেলে ঝরঝর করে।
ঃ আপা!আমি যাব না।
ঃ কি পাগল ছেলে  তুই, বলতো! তোকে চিরদিন কি এখানে থাকতে দেবে?
ঃ না,আমি কিছুতেই যাব না।
অশ্রুসজল হয় নার্সের চোখ।হারিয়ে যাওয়া ভাইটির কখন স্মৃতি মনে পড়ে।কি অসহায়!পিতা নেই,মাতা নেই।আত্নীয়-বান্ধবহীন সংসারে বিপুল জন-সমুদ্রে খড়-কুটোর মত ভেসে চলে এরা!
দুইদিন পর হাউজ-ফিজিসিয়ান আবার বলেন,তুই আজও যাসনি?কাল সকালে উঠে চ’লে যাবি!
রোকেয়া ফিসফিস করে ডাক্তারকে বলে,আর কটা দিন থাক,শরীরে এখনো নর্মাল ভিগার আসেনি।
ঃআচ্ছা বেশ থাক।থাকুক দিন কয়েক।
সুপার আসেন কিছুদিন পরে।এ বেড থেকে ও বেড- ঘুর ঘুর করে ঘুরে বেড়ায় লাডু।শিস দিয়ে সিনেমার গান গায় গুন গুন করে।
ঃ হু ইজ দ্যাট বয়?
ঃ পেসেন্ট।নার্স বলে।
ঃ এই ছোকরা!বেড ছেড়ে ওখানে ঘুরছিস কেন? বেড নং ফোরটিনের কাছে এসে টিকিট দেখে সুপার।
ঃ ভাল হয়ে গেছে! তবে রাখা হয়েছে কেন এতদিন?
আমতা আমতা করেন হাউজ-ফিজিসিয়ান আর নার্স।
ঃ ডিসচার্জ করে দেবেন কাল।সুপারের আদেশ।
ঃ তোকে এতবার বলি,বেড ছেড়ে ঘুরাঘুরি করবি না,দুষ্টুমি করবি না।এইবার হলো তো? কালই চলে যেতে হবে তোকে।নইলে চাকরি যাবে আমার।
ফোস ফোস করে কাঁদছে লাডুঃ না-না।আমি যাবো না।আমি কিছুতেই যাব না!
ঃ কি পাগল! ভাল মানুষকে কি এখানে থাকতে দেয় কখনো?
ঃভাল মানুষ মানে?আমার অবশ হাত ভাল করে দাও।
ঃ ওটা তো তোর জন্ম থেকেই! ওকি আর ভালো হয়?
সব ওকালতিই ফেল হয় লাডুর।সারাটা দুপুর গম্ভীর হয়ে শুয়ে থাকে সে।মনে মনে বুদ্ধি আটে।
হৈ চৈ পড়ে যায় বিকালে।ডাক্তার ছুটে আসে।নার্সরা আসে আইওডিন আর ব্যান্ডেজ নিয়ে।কাচে মারাত্মকভাবে পা কেটে গেছে লাডুর।পা কেটে ভেতরের সাদা মাংস দেখা যাচ্ছে।রক্তে ভেসে যায় ওয়ার্ড।
ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় শুয়ে থাকে লাডু
বিকেলে রোকেয়া আসে।
ঃ কেমন করে কাটলি?
ঃ কাঁচে।
ঃ বিছানায় উঠে বসে সে।নার্স রোকেয়াকে কাছে ডেকে নিয়ে আসে।কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,ওরাতো বললো থাকতে দেবে না-তুমিও বললে,ভাল মানুষকে থাকতে দেবে নাএখানে!


দরজার কাছে সেই ভাঙা কাঁচের টুকরোটা ছিল না-সেইটা দিয়ে দিলাম পায়ে এক হ্যাচকা টন।
ভেবেছিলাম একটু কাটবে,কিন্তু বড্ড বেশি কেটে গেল যে আপাঃযা রক্ত পড়ল।এবারে বেশ নিশ্চিন্তে থাকা যাবে এখানেঃতাই না,আপা?
অশ্রু-সজল হয় রোকেয়ার চোখ।
দীর্ঘ একমাস পরে ঘা সারে তার।ধীরে ধীরে সুস্থ হয়।আবার তাগিদ।কোনো রোগীকেই এতদিন রাখার নিয়ম নেই।সুপারের কড়া হুকুম।
ঃতুই এবার চলে যা,লাডু!রোকেয়া অশ্রুসজল চোখে বলে।
ঃ না,না,না-আমি যাব না!আমি কিছুতেই যাব না।
লাডুর পুরাতন জবাব।ওষুধের প্লেট,ইনজেকশন,ফাইল ইত্যাদি নিয়ে রোকেয়ার পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়ায় সমস্ত ওয়ার্ড দিয়ে।তার কাছ থেকে চকলেট নিয়ে সকলকে দেখিয়ে আরাম করে চুষতে থাকে।
ঃ এটা কি ওষুধ,আপা?
ঃ কুইনাইন-মিকশ্চার।
ঃ ওটা কি?
ঃ টিনচার আইওডিন।
ঃ এটা?
ঃ বেলেডোনা। লাডুর প্রশ্নের চোটে বিরক্ত হয়ে ওঠে রোকেয়া।বলে, বড্ড বকিস তুই!থাম তো!
ঃ আচ্ছা আপা!ফিস ফিস করে কানে কানে বলে সে,এমন কোন ওষুধ নেই,যেটা খেলে চিরদিন থাকা যাবে এখানে।শরীরটা ভালোও হবে না,বেশি খারাপও হবে না।
ঃ উঃ, বড্ড বিরক্ত করস তুই!কান ঝালাপালা হয়ে গেলো। রোগীকে ওষুধ আনতে আলমারীর দিকে যায় রোকেয়া।রাশিকৃত বোতল।গায়ে লেবেল আঁটা।
ঃ হেই সবুজ ওষুধটা কিসের?
ঃ লাডুর প্রশ্ন বিরামহীন।
ঃ ওটা দাঁতের।
ঃ ওটা লাল টুকটুকেটা?
ঃ ওটা খেলে ক্ষিদে লাগে।
ঃ আর এই ইঁটের রঙেরটা।টিনচার আইওডিনের শিশি দেখিয়ে প্রশ্ন করে লাডু।রোকেয়া এবারে ভীষণ বিরক্ত হ’য়ে যায়।
ঃ এটা? এমন এক ওষুধ যা খেলে কোন দিন তোকে এখান থেকে যেতে হবে না।একেবারে চিরদিনের জন্য থেকে যেতে হবে।ছোট একটা ধমক দিয়ে রোগীদের কাছে চলে যায় সে। লাডু এক দৃষ্টে তাকিয়ে দেখে বোতলটা। মাঝের তাকে তিনটে বোতলের পর সবচেয়ে বড় বোতল।মনে মনে মুখস্থ করে রাখে- মাঝের তাকে তিনটে বোতলের পর।
খাটের উপর বসে আবার দুলতে থাকে সে।সমস্ত ঘরময় টহল দিয়ে বেড়ায়।গান গায় গুন গুন করে।
রাত্রি চারটে বাজে।সমস্ত হাসপাতাল ঘুমুচ্ছে।কেউ জেগে নেই।নার্সরা ডিউটি শেষ করে চলে গেছে।
এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে আস্তে বিছানা ছাড়ে লাডু।ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় আলমারীর দিকে।মাঝের তাকে তিনটে বোতলের পর।
আলমারী খুলে বোতলটা ধীরে ধীরে বের করে নিজের বিছানায় মশারীর নীচে গিয়ে ঢোকে।গলগল করে ঢেলে দেয় মুখে।কিন্তু একি! সমস্ত জিব মুখ যে পুড়ে যাচ্ছে আগুনের মত।যেন নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে ঢুকছে ওষুধটা।তবে যে আপা বলেছিল-হাত থেকে খসে পড়ে যায় বোতল।কপাল ঘেমে ওঠে।সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসে।
সকালবেলা চার নম্বর ওয়ার্ড ভরে গেল ডাক্তার -নার্সে।ওয়ার্ডের সমস্ত রোগী ঝুকে পড়ল চৌদ্দ নম্বর বেডের সম্মুখে।সেই চঞ্চল ছেলেটা আইওডিন খেয়ে আত্মহত্যা করেছে।সমস্ত শরীর মুখ নীল হয়ে গেছে।
টসটস করে পানি গড়িয়ে পড়ে নার্স রোকেয়ার গাল বেয়ে।পাগলের মত চিৎকার করে বলেঃ না,না,সে আত্মহত্যা করেনি।সে এখানে থাকতে চেয়েছিল-চিরদিনের জন্য থাকতে চেয়েছিল।এ পৃথিবীতে তার কেউ ছিল না!
বিশ্ববিদ্যালয় যাই।বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে আসি। গলির ধারের সেই ভিক্ষুক ছেলেটি আর বিরক্ত করে না।