বর্তমানে গোটা বিশ্ব তথা আমাদের দেশ ভারতবর্ষে জনপ্রিয় খাবার চকোলেট। জন্মদিনে, বিয়েবাড়িতে, উপহার হিসেবে, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কিংবা মুড হলেই চকোলেট কিনে খেয়ে নিই আমরা। হরেক রকমের চকোলেট, তার আবার গালভরা নাম। মোদ্দা কথায় চকোলেট আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী। এমনকি ‘ভালোবাসার সপ্তাহ’ মানে ৭-১৪ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৯ই ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘চকোলেট ডে’ হিসেবেও পালন করা হয়। কিন্তু আসলে চকোলেট দিবস কি ৯ই ফেব্রুয়ারি? না, বিশ্ব চকোলেট দিবস ৭ই জুলাই। কোথা থেকে এল এই চকোলেট? তার ইতিহাসটা কী? এই চকোলেটের পিছনে আরও কি কিছু গভীর বেদনাদায়ক গল্প লুকিয়ে আছে? আসুন খুঁজে দেখি।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধরণের ও আকারের চকোলেট আমরা দেখতে পাই। কিন্তু এগুলোই চকোলেটের আদি রূপ নয়। মূলত ‘শোকোলাটল’ বা ‘জোকোলাটল’ (Xocolatl) নামক এক ধরণের পানীয় থেকে ক্রমাগত পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও উন্নয়ন এর মাধ্যমে আজকের এই রূপ। ইউরোপীয় ‘বিজয়গাথা’র বাইরে এসে আমেরিকার প্রাচীন ‘মায়া সভ্যতা’র কথা আজ আমরা সবাই জেনেছি। সেই মায়া সভ্যতার সময়েই আজকের চকোলেটের উৎপত্তি। হ্যাঁ, আমেরিকার আদিনিবাসী ‘ব্ল্যাক’ মানুষরাই আজকের চকোলেটের প্রকৃত আবিষ্কারক। ‘চকোলেট’ নামটিও এসেছে তাদের ভাষার ‘স্কোকোলেট’ থেকেই। যার অর্থ ‘অম্ল পানীয়’। চকোলেটের মূল উপাদান ‘কোকো’। এই কোকো গাছের বীজ থেকে প্রস্তুত চকোলেট গোড়ার দিকে পানীয় হিসেবেই ব্যবহার করা হতো। পরবর্তীকালে মায়ার থেকে আমেরিকারই আরেক প্রাচীন সভ্যতা ‘আজটেক’ এই পানীয় তৈরি শিখে নেয়। আজটেক সভ্যতার মানুষদের ধর্মীয় বিশ্বাস, রূপকথার গল্পে জুড়ে যায় কোকো। তাদের আরাধ্য দেবতা ‘কোয়েটজালকটল’ই নাকি এই কোকো গাছ পৃথিবীতে এনেছিলেন। এই গাছের ফল খেলে সাম্রাজ্য, ক্ষমতা ইত্যাদি বাড়ে এরকম বিশ্বাসও ছিল তাদের। কোকো গাছ দেবতা জ্ঞানে পূজিত হত। এমনকি মুদ্রা হিসেবে কোকোর ব্যবহারেরও হদিস মেলে আজটেক সভ্যতায়। এই পানীয় তিক্ত হলেও তখনকার সময়ে অভিজাত শ্রেণীর মানুষের কাছে জনপ্রিয় ছিল। এটি এতটাই মূল্যবান ছিল যে সাধারণ মানুষের পক্ষে তা ক্রয় করা সম্ভব ছিল না।
পরবর্তীতে কলম্বাসের আমেরিকা আক্রমণ ও সর্বোপরি ইউরোপীয় হানায় একেবারে ধ্বংস হয়ে যাওয়া আমেরিকার প্রাচীন সভ্যতাগুলোর আবিষ্কারগুলিতেও ইউরোপীয় শিলমোহর পড়ে যায়। কলোম্বাস প্রথম কোকো বীজ ইউরোপে নিয়ে আসলেও স্প্যানিশ যোদ্ধা হার্নান কোর্টেসের মাধ্যমে ইউরোপে শোকোলাটল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তিনি মেক্সিকো থেকে জাহাজে কোকো বীজ নিয়ে এসে শোকোলাটল তৈরি করে সেটির সাথে চিনি ও সুগন্ধী জাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে রাজাকে খাইয়ে স্পেনের রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। তখনকার দিনে আসলে রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনো খাবার বা নতুন কোনো কিছুকেই জনপ্রিয় করা প্রায় অসম্ভব ছিল বিশেষ করে বাইরে থেকে আনা কোনো জিনিস।
এরপর সেই শোকোলাটল সপ্তদশ শতকের মধ্যেই ইউরোপে পানীয় হিসেবে বহুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উনিশ শতকে পানীয় চকোলেট থেকে সলিড চকোলেটের উদ্ভব। ১৮৪৭ সালে জোসেফ ফ্রে চকোলেট পেস্ট তৈরি করে হয়ে যান আধুনিক চকোটেলের জনক। ততদিনে শিল্পবিপ্লব ঘটে গেছে। তৈরি হয়েছে নানা ধরণের কারখানা। এসেছে কোম্পানি, কোম্পানি মালিক। খাবারও এর ব্যতিক্রম নয়। ফুড ইন্ডাস্ট্রি মালিকেরা নিত্যনতুন খাবার তৈরিতে এবং তা বাজারে বিক্রি করতে ও তার থেকে মুনাফা কামাতে ব্যস্ত। চকোলেট বানাতেও কোম্পানিগুলো পিছোলো না। শুরু হয়ে গেল প্রতিযোগিতা। আধুনিক চকোলেটের প্রথম কারখানা গড়ে উঠল স্পেনে। বর্তমানে বিশ্বের সবথেকে জনপ্রিয় চকোলেট ‘ক্যাডবেরি ডেয়ারি মিল্ক’। জানা যায়, জর্জ ক্যাডবেরি (জুনিয়র) স্পেন থেকে ক্যাডবেরি বারের রেসিপি শিখে এসে প্রথম এটি বানান ১৯০৫ সালে। তবে ক্যাডবেরি কোম্পানির প্রথম সদস্য হিসেবে ধরা হয় জন ক্যাডবেরিকেই।
এতক্ষণ চকোলেটের ইতিহাসের গল্প বললাম। এবারে আসছি আজকের সময়ের একটি বেদনাদায়ক হাড়হিম করা গল্পে। হ্যাঁ, চকোলেটের গল্পই। বেদনাদায়ক কেন বলছি সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। বর্তমানে চকোলেট বিশেষত ডার্ক চকোলেট স্বাস্থ্য সচেতনদের পছন্দের শীর্ষে। গল্পটা আসলেই ‘ডার্ক’। হ্যাঁ, গল্পটা নামের চেয়েও অনেক বেশি আঁধারে বেষ্টিত! আমাদের জীবনে যে চকোলেট মিষ্টিমুখের প্রতীক, আমাদের জীবনে যে চকোলেট আনন্দদায়ক সেই ইয়াম্মি চকলেটের গন্ধটাও অনেকের জীবনের জন্য এক অভিশাপ! না, তাদের একদমই ইচ্ছে নেই এই চকোলেটের সংস্পর্শে থাকার। বরং তারা পালাতে চায় ওই তথাকথিত চকোলেটি দুনিয়া থেকে! আফ্রিকার ১.৮ মিলিয়ন শিশু পালাতে পারে না তাদের বিভৎস শৈশব থেকে! তাদের শৈশবের বলিদানই হলো আজকের ইয়াম্মি ডার্ক চকলেট! আইভরি কোস্ট আর ঘানা। পশ্চিম আফ্রিকার এই দু’টি দেশে পৃথিবীর ৭০ শতাংশ কোকো চাষ হয় আজকের সময়ের। প্রতিদিনই মালি, বুরকিনা ফাসো ইত্যাদি প্রতিবেশি দেশ থেকে হাজার হাজার শিশু পাচার করা হয় আইভরি কোস্ট আর ঘানাতে। চকলেট ফার্মে কাজ করানোর জন্য তাদের কিনে আনা হয়। কখনো খাবার বা পড়াশোনার লোভ দেখিয়ে আবার কখনো জোর করে। অত্যধিক দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে আজকের ‘বিগ কর্পোরেট ফুড ইন্ডাস্ট্রি’-র মধ্যে থাকা ক্যাডবেরির মতো কোম্পানিগুলি তাদের মুনাফার স্বার্থে শিশুশ্রমকে নির্দ্বিধায় চালিয়ে যায়। ক্যাডমেরির মতোই ‘মার্স’, ‘নেসলে’, ‘হার্শে’-র মতো বড়ো কোম্পানিগুলিও একই কাজে লিপ্ত। ২০০১ সালের একটি সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী ‘হার্শে’ এবং ‘মার্স’-এর বেশিরভাগ মুনাফাই আইভররি কোস্টের কোকো বাগান থেকে। শুনলে অবাক হতে হয়, শুধুমাত্র আইভরি কোস্টেই ৬ লক্ষ বাগান রয়েছে। ২০১২ সালে ব্রিটিশ সংস্থা ‘বিবিসি’ গোপনে একটি সার্ভে চালিয়ে তার রিপোর্ট পাবলিশ করে। তাতে আরও জোরালোভাবে ফুটে ওঠে কোকো বাগান গুলিতে কর্মরত শিশুদের শৈশবের “ডার্ক” অধ্যায়গুলো। (“Cadbury: The bitter truth” ইউটিউবে পাবেন)।
না, মধ্যযুগীয় দাস প্রথার কাহিনী নয়। এ একেবারে খাঁটি নয়া উদারনৈতিক, বিশ্বায়নের যুগের কাহিনী। হ্যাঁ, দাস প্রথাই বটে! শিশুদের কীভাবে কাজ করানো হয়? সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এই শিশুগুলোকে দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করিয়ে তারপর খাদ্য হিসেবে সস্তা সেদ্ধ ভুট্টা আর কলা দেওয়া হয়। তারপর রাতে শেকল দিয়ে বেঁধে দরজা জানালাহীন কাঠের আস্তাবলে ফেলে রাখা হয় যাতে তারা পালাতে না পারে। এই অত্যাচার থেকে কেউ পালানোর চেষ্টা করলে তার কপালে জোটে বেধড়ক মার আর যৌন হয়রানি। মার খেয়ে বা ধর্ষণে কেউ মরে গেলে তার শরীরটা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় নদীতে বা কুকুরের মুখে। মায়া-ভালোবাসা বা নীতিশিক্ষা ওখানে আকাশকুসুম। আছে শুধু নৃশংসতা। সেই রক্তই যেন শুকিয়ে কালো হয়ে আছে পৃথিবী জোড়া ফ্রীজে রাখা ডার্ক চকোলেটে। কোকো ফিল্ডের পোকা, সাপ, বিছের কামড়ে অনেক শিশুই মারা যায়, অবশ্য তাতে মালিকদের কিছু যায় আসে না। ৫ থেকে ১২ বছর বয়সী বাচ্চাদের তো কোনো মজুরি দেওয়া হয় না। ‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার ল’ সেখানে উপহাস মাত্র।
কোকো ফার্মের ৪০ শতাংশ মেয়ে শিশু। তাদের বয়ঃসন্ধি আসে ফার্মেই। সেখানকার মালিক, ঠিকাদার এমনকি পুলিশের যৌন চাহিদা মেটাতে হয় ওই মেয়ে শিশুদেরই। যৌনরোগ আষ্টেপৃষ্টে ধরে কোমল শরীরে। পঁচে গলে যায় শৈশব। স্বপ্নেও পোকা আসে, ভয়ঙ্কর সব পোকা। খুবলে খায় চকোলেটি হৃদয়! এই শিশুগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘ম্যাশেটি’। এটি এমন এক ছুরি যা দিয়ে একটি শিশুকে কয়েক মিনিটে কিমা করে দেওয়া সম্ভব। এই ছুরিগুলোই শিশুদের হাতে দেওয়া হয় কোকোবিন পেড়ে বস্তায় রাখার জন্য। কারো আঙুল কাটে, কারো শরীরের বিভিন্ন স্থানে হয় গভীর ক্ষত। প্রায় ১০০ কেজির বস্তা চাপানো হয় পিঠে। বিশ্রামের জন্য থামলেই চাবুকের আঘাত। এই যুগেই ক্রীতদাস প্রথা চলছে এখনো। যেখানে মানবতা দাঁত বের করে উপহাস করে! আর এই গভীর অন্ধকার থেকেই বের হয় আমার আপনার প্রিয় ‘ডার্ক চকোলেট’! আর রক্তমাখা শিশুশ্রমে তৈরি হওয়া আজকের “মিষ্টিমুখ” এই চকোলেট দিয়ে “ক্যাডবেরি”-র মতো কোম্পানিগুলো আমাদের “খুশিয়া বাটে”।
নেসলে কোম্পানি বিশ্বের ‘কুখ্যাত’ কোম্পানিগুলির মধ্যে উচ্চস্থানে। তার বিরুদ্ধে অক্সফ্যাম, কেয়ার, ইউনিসেফ থেকে শুরু করে আরও অনেক সংস্থা ও নাগরিক প্রতিবাদ মঞ্চ গড়ে উঠেছে বিশ্বজুড়ে। গবেষণা বলছে এই নেসলের মতো কোম্পানিদের চকোলেট স্বাস্থ্যের পক্ষেও হানিকারক। অনেকদিন ধরে এদের চকোলেট খেতে থাকলে অসুখের সম্মুখীন হবার জোগাড়। ক্ষতিকর হাইড্রোজেনেটেড তেল, ট্রান্স ফ্যাট যা আলজাইমারের অসুখ (ব্রেনের ব্যাধি), করোনারি হার্ট অসুখ, প্রস্টেট এবং স্তনের ক্যানসার, লিভারের ক্ষতি, প্রজননতন্ত্রের ক্ষতি, ডিপ্রেশন ইত্যাদির কারণ হয়ে উঠতে পারে। বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকর রঙ যেমন টারট্রাজাইন (ই১০২), কারমাসাইন (ই১২২), কুইনোলিন ইয়েলো (ই১০৪); খাদ্য সংরক্ষক সোডিয়াম বেঞ্জয়েট (ই২১১) ইত্যাদির উপস্থিতি শিশুদের মধ্যে হাইপার-অ্যাক্টিভিটির জন্ম দেয়।