চেঙ্গিস খান। নামটি শুনলেই ভয়ে শিউড়ে উঠেন অনেকে। পরাজিত জাতিদের কাছে তিনি ছিলেন এক মুর্তিমান আতংকের নাম।এই মঙ্গোল সম্রাট ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম অপরাজিত জেনারেল।যিনি এককভাবে জয় করেছিলেন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অঞ্চল এবং যিনি একই সাথে ৪ কোটি নিরাপরাধ মানুষের মৃত্যুর দায়ী। ধ্বংস, হত্যা, চাতুর্য, ক্ষমতা, লিপ্সা এবং রণকুশলতার এক অভূতপূর্ব মিশেলে গড়া চেঙ্গিস খান বা তিমুজিনের জীবন। এই দুধর্ষ সমর নায়কের জীবনে প্রেম ছিল, বীররসের সাথে ছিল প্রেম রস।
বহুগামী চেঙ্গিসের জীবনের হাজার হাজার নারীর সঙ্গ এলেও বোর্তে ছিল তার প্রথম ও শেষ ভালবাসা। অসংখ্য সন্তানের পিতা হওয়া সত্ত্বেও শুধু বোর্তের গর্ভে জন্ম নেওয়া চার ছেলেকেই উত্তরাধিকারী হিসাবে মনোনীত করেছিলেন তিনি। বোর্তে আর তেমুজিনের এই ভালবাসা ইতিহাসে বেঁচে আছে অনন্য হয়ে। বেঁচে আছে বোর্তের গর্ভে জন্ম নেওয়া চেঙ্গিসের চার ছেলের নাম জোচি, তুলুই, ওদেগিই, চুঘতাই খানের মাধ্যমে।
মাত্র নয় বছর বয়সে তার পিতা মোঙ্গল রীতি অনুযায়ী তার জন্য টুকটুকে সুন্দরী বউ ঠিক করেন- নাম বোর্তে। পাশ্ববর্তী ওংগিরাত গোত্রের রাজকুমারী ছিলেন তিনি। তৎকালীন রীতি অনুযায়ী বউ থাকল বাপের বাড়ি। যে দিন তার বয়স ১৬ বছর পূর্ণ হবে সে দিন ঘটা করে তাকে স্বামীর বাড়ি আনা হবে। তিমুজিন নতুন বউকে দেখলেন আর শিশু অবস্থাতেই মহা প্রেমে পড়ে গেলেন। সময় পেলেই ছুটে যেতেন শ্বশুরবাড়ি।
স্ত্রীর সঙ্গে শিশুতোষ খেলা খেলে আবার বাড়িতে ফিরে আসতেন। এভাবেই খুব হাসি-তামাশা আর আনন্দ-ফুর্তির মধ্যে তার দিন কাটছিল। একদিন শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রীর সঙ্গে খেলা নিয়ে ঘটল অদ্ভুত এক ঘটনা। তারা প্রায় ‘কুনু কুনু কুসু কুসু’ খেলতেন। এ ছিল মঙ্গোলিয়ার মরুভূমিতে প্রচলিত এক ধরনের পুতুল খেলা। তিমুজিনের ছিল একটি মেয়ে পুতুল আর বোর্তের ছিল ছেলে পুতুল। তারা মহা ধুমধামে পুতুলের বিয়ে দিত এবং হাসি-তামাশা করে সময় কাটাত। কিন্তু সে দিন বোর্তে বলল আজ আর খেলব না।আমার পুতুলের বাবা মারা গেছে বলেই সে কান্না শুরু করল। তিমুজিন যতই বোঝায় ততই তার কান্না বাড়তে থাকে। ফলে সে অভিমান করে তার নিজের এবং স্ত্রীর পুতুল আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলে। তারপর রাগ করে ফিরে আসে নিজেদের বাড়ি। বহুদিন আর গেলেন না বোর্তের কাছে।
তিমুজিনের বয়স তখন ১৬, সে দিনই তারা প্রথম বাসর করতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন।কিন্তু সন্ধ্যার আগেই অপহৃত হলেন বোর্তে। মারকিত নামক এক মরুচারী বেদুইন গোত্র প্রধান অপহরণ করে নিয়ে যায় তিমুজিনের স্ত্রী বোর্তেকে। ১৭ বছর বয়সে তিমুজিন গোত্র প্রধানদের সহায়তায় উদ্ধার করে ঘরে তুলে আনলেন তার বাল্যবধূ বোর্তেকে। অবশ্য খুব বেশি দিন একসাথে থাকা হল না স্ত্রীকে নিয়ে। কিছুদিনের মধ্যেই আবারও এল বিচ্ছেদ। প্রতিপক্ষ অতর্কিত হামলা চালিয়ে হত্যা করল তিমুজিনের গোত্রের লোকদের। সেই সাথে তুলে নিয়ে গেল বোর্তেকেও। এই ঘোর বিপদে তেমুজিন পিতৃবন্ধু তুঘরুল খান ও নিজ বন্ধু জমুখার কাছে সাহায্য পেলেন। অবশেষে উদ্ধার করা হল বোর্তেকে। ফিরিয়ে আনার কিছুদিন পরেই বোর্তের গর্ভে জন্ম নিল চেঙ্গিসের বড় ছেলে জোচি। কিন্তু শত্রু শিবির থেকে বোর্তের মুক্ত হওয়ার মাত্র নয় মাস পর জন্ম হওয়ায় জোচির পিতৃ পরিচয় নিয়ে কানাঘুষা শুরু হল। তবে চেঙ্গিস আজীবন জোচিকে নিজের সন্তান হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন, স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন তার প্রথম প্রেম বোর্তেকে।