জাপানি লেখক রিয়ুনোসুকে আকুতাগাওয়া’র গল্প “নরকচিত্র”, লেখকের গল্পটি পড়ে গা’টা শিউরে উঠলো। শিল্পীর অস্বাভাবিক চাওয়াটা কিভাবে যেন তার নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে গেলো!
গল্পটি যোশিহাইদ নামের একজন প্রতিভাবান রাজশিল্পীকে নিয়ে। সম্রাট তাকে দিয়েছেন এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব,তাঁকে আঁকতে হবে নরকের চিত্র। নরকের সেই ছবি হবে এমন ভয়ঙ্কর ও জীবন্ত যে, যুগ যুগ ধরে মানুষের বিস্ময়ভরা চোখ তাকে তাকিয়ে দেখবে।ছবির সেই ভীতিকর, রোমহর্ষক ও নারকীয় দৃশ্য আর লেলিহান অগ্নিশিখা দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠবে। কিন্তু শিল্পী এটা কিভাবে আঁকবেন? তিনি তো কখনও নরক দেখেননি। নরকে থাকে অমানুষিক অত্যাচারের সব দৃশ্য, ভয় পাওয়া জন্তুর মতো মানুষের বিভৎস বিস্ফারিত মুখ।দাউদাউ লেলিহান আগুনের ভেতর চিৎকার আর আর্তনাদরত মানুষ।এগুলি তো তাঁর অজানা, কিভাবে আসবে সেগুলি তার তুলিতে!
যোশিহাইদের দৃষ্টিশক্তি, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং তুলির টান কেবল বিস্ময়করই নয়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের সমান। কিন্তু একটা জায়গায় তিনি নিঃস্ব, তার কল্পনা শক্তি নাই বললেই চলে। তিনি যেটা চোখে দেখেন, তার ছবিতে সেটি তিনি আশ্চর্যরকমভাবে জীবন্ত করে তুলতে পারেন কিন্তু যেটা চোখে দেখেননি, কল্পনার রঙ মিশিয়ে তাকে উজ্জ্বল বা বর্ণাঢ্য করে আঁকতে পারেন না।
শিল্পী ছবি আঁকা ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজের ছাত্রদের মাঝে হঠাৎ ছেড়ে দিলেন ভয়ঙ্কর বাদুড়; কালো বিষধর সাপ। সৃষ্টি হলো আতঙ্ক আর ভয়ের বিভৎস দৃশ্য। ভয়ে ছাত্রদের বিবর্ণ বিস্ফারিত মুখ ভয়াবহ হয়ে উঠলো আধো অন্ধকার সেই বন্ধ ঘরে।তিনি তীক্ষ দৃষ্টিতে সেই ভূতগ্রস্থ অপ্রকৃতিস্থ মুখগুলিকে স্মৃতির তাকে সাজিয়ে রাখলেন।
তারপর তিনি এঁকে চললেন নরকের পৈশাচিক ভয়ার্ত সব চিত্র। এমনিভাবে তিনি আঁকলেন আরও বেশ কিছু নারকীয় দৃশ্য দিয়ে সমৃদ্ধ ভীতিকর পরিবেশের চিত্র। চিত্র প্রায় সম্পূর্ণ। এখন কেবল একটি আগুনের দৃশ্য বাকি।দাইদাউ লেলিহান আগুনে চিৎকার আর আর্তনাদ করে জ্বলে মরা মানব- মানবীর বিভৎস প্রতিকৃতি, নরকের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ তো এটিই। আগুনের এই লেলিহান দৃশ্য না হলে তো ভয়ঙ্কর নরক আঁকা সম্পূর্ন হবে না।এর উত্তুঙ্গ মহিমা তৈরি হয় না, নরকের আতঙ্ক হৃদয় ছাপিয়ে উপচে পড়ে না! যে নরক তার জীবন্ত ভয়াবহতা দিয়ে যুগে যুগে মানুষের চোখে ত্রাস আর আতঙ্ক ছড়াবে, অগ্নির লেলিহান শিখার উন্মত্ত তাণ্ডব ছাড়া কিভাবে তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা পাবে?
যোশিহাইদ সম্রাটকে জানালেন, নরকের সব ভয়ঙ্কর চিত্র তিনি এঁকে ফেলেছেন। এখন শুধু জ্বলন্ত আগুনের গনগনে দাহ আর তাণ্ডব চিত্রটি আঁকা বাকি আছে। কিন্তু যেহেতু তিনি এই দৃশ্য দেখেননি, তাই এরকম দৃশ্য তাকে না দেখালে তার পক্ষে চিত্রটি আঁকা সম্ভব নয়। তিনি সম্রাটের কাছে প্রার্থনা জানালেন; প্রাসাদের সামনে সবার সামনে একটি রাজকীয় শকটে আগুন লাগাতে হবে, যার ভেতরে থাকবে একজন অভিজাত মহিলা যিনি মর্মস্তুদ আর্তনাদ আর যন্ত্রনার ভেতর জ্বলতে জ্বলতে মৃত্যুবরন করবে। কেবল এই দৃশ্যটি দেখলেই তার নরকের ভয়ঙ্কর রূপটি আঁকতে তার কোন অসুবিধা হবে না। সম্রাট তার প্রস্তাবে রাজি হলেন।
নির্দিষ্ট দিনে রাজপ্রাসাদের উদ্যানে রাজন্যবর্গের সামনে একজন অভিজাত মহিলাকে বহনকারী একটি মূল্যবান রাজকীয় শকট এসে দাঁড়ালো, তারপর সেই শকটে আগুন লাগিয়ে দেয়া হলো। বিভৎস আর্তনাদে দগ্ধ হতে লাগলো সেই মহিলা। কিন্তু আগুনের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলেন স্তম্ভিত অসহায় যোশিহাইদ, আগুন লাগা শকটের মধ্যে যে অভিজাত মেয়েটি প্রাণফাটা আর্তনাদে পুড়ে ছাই হচ্ছে, সে আর কেউ নয়, তারই নিজেরই মাতৃহারা একমাত্র কন্যা। সম্রাটের গোপন প্রনয় প্রত্যাখানের শাস্তি হিসাবে তার পিতার নিষ্ঠুর ইচ্ছার বলী করা হয়েছে তাকে।
বিমূঢ় স্তব্ধ যোশিহাইদ কন্যার অগ্নিদগ্ধ মৃত্যুর আর্তনাদ ও ভয়াবহতা বুকে নিয়ে ফিরে এলেন নিজের ছবির সামনে। সন্তান শোকাতুর হৃদয়ে সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য ফুটিয়ে উন্মাদের মতো আঁকলেন তার নরকের অগ্নিবিচ্ছুরিত পর্বটি।
তার অনন্যসাধারন চিত্রকলাটি শেষ হলো, তবে মেয়ের শোক সহ্য করতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করে নিজের জীবনের ইতি টানলেন।
লেখক রিয়ুনোসুকে আকুতাগাওয়া।