২০০১ সাল। ইন্টারনেট ও নিলামঘরে রহস্যময় প্রত্নবস্তু বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। প্রত্নবস্তুগুলোর প্রাপ্তিস্থান মধ্য এশিয়ায়। প্রথম দিকে এসব বিজ্ঞপ্তি দেখে কেউই তেমন গুরুত্ব দেয় নি। সবাই ভেবেছিলো পুরাকীর্তি পাচারকারী বা বিক্রেতারা নকল কিছু প্রত্নবস্তু তৈরী করে মানুষকে ঠকাবার ফাঁদ পেতেছে।
২০০২ সাল। আবারও নতুন কিছু প্রত্নবস্তু বিক্রির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলো। এবার বিশেষজ্ঞরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন, নড়েচড়ে বসলেন তারা। ইরানের পুলিশও এই রহস্য সমাধান করবার জন্য গুরুত্ব সহকারে কাজ শুরু করলেন এবং সমন্বিত তদন্ত কমিটির একান্ত প্রচেষ্টায় কয়েক জন পাচারকারীকে গ্রেফতারও করা হলো। তাদের কাছ থেকে জানা গেলো, বেশ কিছু প্রত্নবস্তু ইরানের তেহরান, বন্দর আব্বাস ও কের্মান থেকে সারা বিশ্বের ক্রেতাদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরও খানিকটা জেরার পর বের হলো, দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের কের্মান প্রদেশের একটি দুর্গম এলাকা ‘জিরফট’ এর প্রায় ২৫ মাইল দক্ষিণে হালিল নদীর উপত্যকা থেকে এই বিস্ময়কর বস্তুগুলো তারা সংগ্রহ করেছে। শুনে অবাক হয়ে গেলেন সবাই। ঐ অঞ্চলে যে কোনো সভ্যতার অস্তিত্ব ছিলো, সে সম্পর্কে তো কারো কোনো ধারণাই নেই।
ব্যাপক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলো মূল ইতিহাস। রোমাঞ্চকর সেই ঘটনা। সময়টা ২০০১ সাল। ব্যাপক বন্যার ফলে হালিল নদীর পানি তীরের ভূমিকে প্লাবিত করেছিলো। বন্যা শেষে প্লাবিত অঞ্চলের পানি সরে যাবার সময় উপরের স্তরের মাটিগুলোকেও ধুয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। এভাবেই বের হয়ে আসে এক প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র এবং মূল্যবান অনেক প্রত্নবস্তু। স্থানীয় লোকেরা এসব প্রত্নসামগ্রী দেখার সাথে সাথেই বুঝতে পেরেছিলো, এগুলো কতোটা মূল্যবান। এলাকার দরিদ্র লোকগুলোকে কাজে লাগিয়ে সেসব প্রত্নবস্তু সংগ্রহ করে পুরাকীর্তি-পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে বেশ কিছু অর্থ উপার্জন করে নেয় তারা।
এরপর প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এলাকাটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করলেন এবং নিশ্চিত হলেন যে, এই সভ্যতা প্রায় ৫০০০ বছরেরও পুরনো। ব্রোঞ্জ যুগের একটি সভ্যতা। দুই বছর যাবৎ অনিয়ন্ত্রিত খনন ও লুটপাটের কারণে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে প্রত্নস্থলটি। তাই প্রত্নস্থলটির বয়স সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া ছিলো বেশ কঠিন। তবুও প্রত্নতত্ত্ববিদরা হাল ছাড়েন নি। বেশ অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই বাকি অঞ্চলটুকু সংরক্ষণ ও অধ্যয়নের কাজে লেগে পড়েন তারা। সেই সাথে ঐ অঞ্চলের প্রাচীন সংস্কৃতি ও এর জনগণ সম্পর্কে জানবার জন্য আশেপাশের আরো কিছু অংশ তারা তাদের খনন-এলাকার অধীনে নিয়ে আসেন।
২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। ইরানের বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ইউসুফ মাদজিদজাদেহের নেতৃত্বে শুরু হলো খননকাজ। মাদজিদজাদেহের টীম একটি প্রধান নেক্রোপলিস বা সমাধিস্থল খুঁজে পান, যার নাম রাখা হয় মাহতুতাবাদ। প্রচুর পরিমাণ সম্পদ লুট হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এই জায়গাটি থেকেই সবচেয়ে বেশি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নবস্তুগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিলো।
সমাধিস্থলটি থেকে অল্প দূরে দুটো ঢিবির মতো জায়গা খুঁজে পেলেন তারা। ঢিবি দুটি পরস্পর থেকে প্রায় এক মাইল দূরে অবস্থিত। তাদের নাম রাখা হলো যথাক্রমে দক্ষিণ কোনার স্যান্ডাল এবং উত্তর কোনার স্যান্ডাল। উত্তর দিকের ঢিবিটি মূলত একটি উপাসনালয় ছিলো এবং দক্ষিণ দিকের ঢিবিটি ছিলো একটি সুরক্ষিত দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। দুর্গটি ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিলো। নিচের দিকে বেশ কয়েকটি ঘরও পাওয়া গিয়েছে। কার্বন-ডেটিং এর মাধ্যমে জানা যায়, এগুলো খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ থেকে ২২০০ সালের মধ্যে তৈরী হয়েছিলো।
বিভিন্ন সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে মতের অমিল হলেও এ বিষয়ে তারা একমত যে, জিরফট অঞ্চলটি খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম সহস্রাব্দের দিকে একটি রমরমা শহর কিংবা আবাসস্থল ছিলো। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের মধ্যে অঞ্চলটি পেশাগত দিক দিয়ে একটি প্রধান এলাকায় পরিণত হয়, যার কেন্দ্রবিন্দু ছিলো এই হালিল নদীর উপত্যকা। বিশাল বসতি গড়ে উঠেছিলো এখানে। কারুশিল্প ব্যাপকভাবে বিকাশ লাভ করেছিলো এই অঞ্চলে। শিল্প পল্লী এবং আবাসিক এলাকাও গড়ে উঠেছিলো এই স্থানে। প্রত্নবস্তুগুলোর মধ্যে লাপিজ লাজুলি, ক্যালসাইট, ক্লোরাইট, অবসিডিয়ান আগ্নেয়শিলা ইত্যাদি পাথরগুলোকে খোদাই করে বসানো হতো। এই শহরের মানুষগুলোর সাথে মেসোপোটেমীয় হরপ্পা সভ্যতার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জিরফটে খননের প্রথম পর্যায়টি শেষ হয়েছিলো ২০০৭ সালে। এরপর প্রায় সাত বছর এখানে কাজ বন্ধ ছিলো। দীর্ঘ বিরতির পর ব্রোঞ্জ যুগের সেই মানুষগুলোর শিল্পবোধ সম্পর্কে বিশদ তথ্য বের হয়ে আসে ২০১৪ সালে দ্বিতীয় পর্যায়ের খননের সময়। রোমাঞ্চিত হন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। একটি প্রত্নবস্তুতে ঐশ্বরিক শক্তির প্রভাবে ঘটে যাওয়া মহাপ্রলয়ঙ্কারী বন্যার মিথিক্যাল গল্পের ছবি পাওয়া যায়। সভ্যতা ধ্বংসকারী বিখ্যাত এই বন্যার গল্পের মোটিভ তো সুমেরীয় ও ব্যবিলনীয়দের কাছে ছিলো পরম ভালো লাগার বিষয়।
জিরফটের পুরাতত্ত্বগুলোতে অঙ্কিত বিছার চিত্রগুলো যেনো উরের রাজকীয় সমাধিস্থলে পাওয়া বিছামানবেরই প্রতিচ্ছবি। আবার জিরফটের ষাঁড়মানবের চিত্রগুলো একদম হুবহু গিলগামেশের আক্কাদীয় মহাকাব্যের ষাঁড়মানবের কথা মনে করিয়ে দেয়। গিলগামেশের রচনায় ষাঁড়-মানব এবং বৃশ্চিক বা বিছামানব উভয়েরই গল্প রয়েছে। বিছামানব মৃতদের দরজায় পাহারা দিয়ে তাদেরকে রক্ষা করতেন। জিরফটে বিছামানবের ছবি সম্বলিত অসংখ্য পাত্র পাওয়া গিয়েছে।
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে তৈরী নিখুঁত কারুকাজ করা একটি ফুলদানিসহ বেশিরভাগ প্রত্নবস্তুতে মেসোপোটেমীয় কিশ রাজা ইটানা ও স্বর্গের ঈগলের সাথে সাপের যুদ্ধের মিথিক্যাল চিত্রটি পাওয়া গিয়েছে। রাজা ইটানার নাম সুমেরীয় রাজাদের তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। মিথ অনুযায়ী, রাজা ইটানার একটি ঐশ্বরিক গাছের প্রয়োজন ছিলো, যেটি গ্রহণ করলে তার স্ত্রী গর্ভবতী হবেন। এদিকে একটি ঈগল ও একটি কমবয়সী সাপের মাঝে যুদ্ধ বেঁধে যায়। এক পর্যায়ে ঈগলটি সেই বাচ্চা সাপটিকে মেরে ফেলে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ঈগল ও সাপের মধ্যে চিরশত্রুতা জন্ম নেয় এবং সাপ নিজের সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চায়। সাপ যখন ঈগলকে আক্রমণ করে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে রেখে যায়, তখন রাজা ইটানা ঈগলটিকে রক্ষা করেন। ঈগলটি সুস্থ হবার পর খুশি হয়ে রাজাকে স্বর্গে নিয়ে যায়, তার কাঙ্ক্ষিত গাছ সংগ্রহ করবার জন্য। রাজা ইটানা স্বর্গ থেকে গাছটি নিয়ে আসেন এবং তার স্ত্রীকে দেন। রাজার স্ত্রী গর্ভবতী হন এবং এভাবেই ঈগলের সাহায্যে রাজা তার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার নিশ্চিত করেন।
জিরফটে পাওয়া প্রত্নবস্তুগুলো দেখে গবেষকেরা মনে করছেন যে, মেসোপোটেমিয়ারও বহু আগে এই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিলো এবং পরবর্তীতে মেসোপোটেমীয় সভ্যতা তাদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে নিজেদের শিল্পকর্মকে আরো বিকশিত করেছিলো। জিওলজিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমেও ধারণা পাওয়া যায় সভ্যতাটির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে।
নিঃসন্দেহে একটি শিক্ষিত জাতির বাস ছিলো এখানে। প্রাপ্ত ট্যাবলেটগুলোতে দুই রকম লিখিত ভাষার প্রমাণ মিলেছে। মেসোপোটেমিয়ার সীমান্ত অঞ্চল এলাম রাজ্যের শহরগুলোতে ব্যবহৃত ভাষা এর মধ্যে একটি। আর অপরটি একেবারে অজানা এক জ্যামিতিক ভাষা।
‘জিরফট’ নামটি তো বর্তমান সময়ের প্রত্নতাত্ত্বিকদের দেয়া। ব্রোঞ্জ যুগের এই অঞ্চলটির সত্যিকার নাম কি ছিলো, তা আমরা আজও জানতে পারি নি। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, বহুমূল্যবান সম্পদের প্রাচুর্য ও ঘনবসতিপূর্ণ সভ্যতার চিহ্ন ইত্যাদির বিবেচনায় ইউসুফ মাদজিদজাদেহ এই অঞ্চলটিকে সুমেরীয় কবিতাগুলোতে উল্লেখিত সম্পদশালী নগরী ‘আরাত্তা’ মনে করেন। আরাত্তার কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ না থাকায় এটি এতো দিন একটি মিথ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত ছিলো। খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ সালের এক লিখিত লিপি থেকে জানা যায়, সবুজ লাপিজ লাজুলি দিয়ে সাজানো দুর্গ, আর গাঢ় লাল ইটের তৈরী টাওয়ার দিয়ে সাজানো সবুজ-লাল এক রাজধানী ছিলো আরাত্তা। সেখানকার নিখুঁত কারুকাজের প্রত্নবস্তু সেই সময়ের অন্যান্য রাজ্যের চাহিদার বিষয় ছিলো। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ সালে সুমেরীয় রাজা এনমার্কার আরাত্তা থেকে কয়েকজন দক্ষ কারিগরকে উরুকে পাঠাবার জন্য অনুরোধ করে চিঠি পাঠান। তার ইচ্ছা ছিলো, আরাত্তার সুদক্ষ কারিগর দিয়ে তিনি উর্বরতা ও যুদ্ধের দেবী ইনানার জন্য একটি অপূর্ব সুন্দর মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন৷ উরুক ছিলো সুমেরীয় সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। উরুকের কোনো মন্দির তৈরীর জন্য প্রায় দুই হাজার মাইল দূরে অবস্থিত এক অঞ্চল থেকে দক্ষ কারিগর পাঠাবার জন্য যখন সেই অঞ্চলের শাসক স্বয়ং অনুরোধ করেন, তখন বুঝতে হবে, ঐ বিশেষ অঞ্চলের কারিগরদের দক্ষতা আসলেই অসাধারণ ছিলো। এ কারণেই মাদজিদজাদেহ মনে করেন, জিরফট হচ্ছে সেই আরাত্তা, যেখানকার কারিগরদের সুনাম ছিলো সর্বজনবিদীত।
অনেকে আবার একে প্রাচীন মারহাশি রাজ্যের একটি অংশ বলেও মনে করেন। অসংখ্য আক্কাদীয় ও সুমেরীয় গল্পে মারহাশির নামের উল্লেখ রয়েছে। আক্কাদীয় রাজা মারহাশির রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। তার বিজয়গাঁথার বর্ণনা থেকে অনেকেই অনুমান করেন, জিরফট আসলে মারহাশি অঞ্চলেই অবস্থিত। তবে জিরফট নিয়ে কোনো অনুমানেরই যথার্থ কোনো প্রমাণ নেই।
মানুষ কখনো কল্পনাও করতে পারে নি, এমন একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশাল শুষ্ক বালুর নিচে লুকিয়ে রয়েছে কোনো পরিমার্জিত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন। ১৮৬৯ সালে প্রথম যখন মেসোপোটেমীয় সভ্যতাকে মাটি খুঁড়ে বের করা হয়, তখন পৃথিবীর মানুষ পরিচিত হয়েছিলো সভ্যতার আদি রূপের সাথে। কে জানে, হয়তো আরো গবেষণার পর আবারো কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বেরিয়ে আসবে অন্য কোনো প্রাচীন সভ্যতার গল্প।
রেফারেন্স: