গভীর রাত। রাজ্যের সবাই গভীর ঘুমে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। গভীর রাতের এই নিঃস্তব্ধতাকে ছাপিয়ে প্রাসাদের কোনো এক কোণ থেকে ভেসে আসছে একটি শব্দ, ডুকরে কেঁদে ওঠার শব্দ। তাহলে কি প্রাসাদের জাঁকজমকেও লুকিয়ে থাকে আবেগের তীক্ষ্ণ অনুভূতিগুলো? রাত কতো গভীর হয়েছে তা এক বিন্দু টের পায় নি ছেলেটি। তুলতুলে বালিশের নিচে মুখ গুঁজে কেঁদেই চলেছে সে, যেনো চেপে কবর দিয়ে দিতে হবে নিজের এই আবেগগুলোকে। তার এই আবেগ যে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। আসবেই বা কি করে? আজ সে যা জানতে পেরেছে, এর পরে কারো পক্ষেই তো নিজেকে ঠিক রাখা সম্ভব নয়। এতো দিন ধরে যাকে সে নিজের বাবা মনে করে আসছে, সে কি আসলেই তার বাবা? নাহ, সে তো তার বাবা নয়, তাকে নাকি তার বাবা বনের মধ্যে আবর্জনার স্তূপে কুঁড়িয়ে পেয়েছিলো। অর্থাৎ বাবা-মা এর পরিচয়বিহীন সে। এমন অপ্রিয় সত্য শোনার পর নিজেকে স্বাভাবিক রাখা তো নিশ্চিতভাবেই কঠিন। কিন্তু ছেলেটি কাপুরুষ নয়, তার চরিত্রে আছে দৃঢ়তা, মনে আছে জীবের প্রতি অপরিসীম দয়া এবং প্রাণে আছে গৌতম বুদ্ধের আদর্শ। কারো বিন্দুমাত্র কষ্ট দেখলে হৃদয় ব্যথাতুর হয়ে পড়া কিশোর ছেলেটির ভাবোদোয় হলো খুব তাড়াতাড়ি। নিজেকে সামলে নিলো সে। টান টান হয়ে গেলো তার মুখের মাংসপেশীগুলো, স্পষ্ট হয়ে উঠলো তার দৃঢ় অভিব্যক্তি। সহসাই একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলো ছেলেটি। এভাবে পরিচয়বিহীনভাবে আর থাকবে না সে, নিজের আলাদা ও অনন্য পরিচয় তৈরী করতে হবে তাকে। তাকে স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তোলা ব্যক্তির কাছে সে চিরকৃতজ্ঞ, কিন্তু এর চেয়ে বেশি সে আর কিছু নিতে পারবে না তার কাছ থেকে। ছেলেটির ব্যক্তিত্ব এতে কিছুতেই সায় দেয় না। সময় এসেছে নিজেকে প্রমাণ করবার, নিজের বাবার কাছেও, সমাজের কাছেও। জেগে উঠলো তার ভেতরের সুপ্ত সত্তা। ভেতর থেকে জানান দিলো, মানুষের জন্য কিছু করতে চায় সে, করতে চায় গুরু গৌতম বুদ্ধের জন্যও, যার জন্য প্রয়োজন জ্ঞানার্জনের। বাবাকে নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলো ছেলেটি, আয়ুর্বেদশাস্ত্র পড়তে তক্ষশীলা যেতে চায় সে। শুরু হলো সর্বকালের সেরা চিকিৎসক, চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও সার্জন জীবক কুমারভচ্চের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়; মানবসেবার পথচলায় হাতেখড়ির যাত্রা।
খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ থেকে ৫ম শতাব্দীর দিকে যখন ভারতবর্ষের মগধে গৌতম বুদ্ধ ধর্ম প্রচার করছিলেন, এমন সময়ে জন্ম নেন মহামতি জীবক। মগধে তখন বিম্বিসারের রাজত্ব। বিম্বিসারের একজন ছেলে রাজকুমার অভয় মগধের রাজধানী রাজগৃহের (বর্তমান রাজগীর) একটি বনে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ অনেকগুলো কাকের চেঁচামেচির শব্দ শুনে সেদিকে গিয়ে দেখলেন এক নবজাতক শিশুকে ঘিরে তারস্বরে কা-কা করে যাচ্ছে কাকের দল। ভীষণ মায়া হলো অভয়ের শিশুটিকে দেখে, তাই বনের মধ্যে পড়ে থাকা শিশুটিকে তিনি নিজের সন্তানের মতো করে লালন-পালন করতে লাগলেন। অভয় শিশুটির নাম দিয়েছিলেন ‘জীবক’, কারণ পরিত্যক্ত এক স্তূপের ভেতরেও জীবিত অবস্থায় শিশুটিকে উদ্ধার করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে অবশ্য অনেকে ধারণা করেছেন, শালবতী নামের কোনো নর্তকীই শিশু জীবককে এভাবে বনের মধ্যে ফেলে রেখে গিয়েছিলেন। তবে অনেকে এ-ও বলেন, বিম্বিসারের প্রেমিকা বৈশালী রাজ্যের নগরবধূ আম্রপালিই জীবকের মা, যার সৌন্দর্যকে সবার ভোগের উপযোগী বানানো হয়েছিলো বৈশালীর রাজার সম্মতিক্রমেই। তবে জীবকের সত্যিকার মা-বাবা কারা সেই সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায় নি।
একটু বড় হবার পর নিজের জন্মপরিচয়ের সত্যতা জেনে জ্ঞানের নগরী তক্ষশীলায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জীবক, কেননা বিম্বিসারের সম্পদে যুক্তিমতে তার কোনো অধিকার নেই। তক্ষশীলায় গিয়ে চিকিৎসা বিষয়ক জ্ঞান অর্জনে মনোযোগী হন জীবক। সবসময়ই রোগ-শোকে কষ্ট পাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন তিনি, আর তাই এবার সত্যি সত্যি মানবসেবার পথ বেছে নিলেন। পেয়েও গেলেন একজন শ্রেষ্ঠ গুরু, আয়ুর্বেদশাস্ত্রে অভিজ্ঞ আত্রেয়। গুরু আত্রেয়ের সান্নিধ্যে আসার পর নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন জীবক। চিকিৎসাশাস্ত্রের জ্ঞান অর্জনের এই যাত্রা মাত্র সাত বছরেই শেষ করে ফেললেন জীবক, যেখানে অন্যদের সাধারণত এর দ্বিগুণ সময়ের প্রয়োজন হতো। জীবককে পরীক্ষা করবার জন্য আত্রেয় তার সমস্ত শিষ্যকে পাঠালেন তক্ষশীলার আশেপাশের এক যোজন বা বারো মাইল দূরত্ব থেকে এমন কোনো গাছ নিয়ে আসতে যার কোনো ওষধি গুণ নেই। আত্রেয়ের অন্যান্য শিষ্যরা এমন কোনো না কোনো গাছ আনতে পারলেও জীবক পারলেন না। জীবক প্রতিটি গাছেই ওষধি গুণ পেয়েছেন। মৃদু হাসি ফুটে উঠলো গুরু আত্রেয়ের মুখে। জীবককে তিনি জানালেন যে তার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে।
সেই থেকে জীবক হয়ে উঠলেন একজন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক। অজস্র রোগীকে তিনি সুস্থ করে তুলেছেন। শুধু তা-ই নয়, শল্য চিকিৎসক বা সার্জন হিসেবেও তার জুড়ি ছিলো না। তিনি অনেক জটিল রোগীকে সফল অপারেশনের মাধ্যমে সারিয়ে তুলেছেন। আর শিশুদের চিকিৎসক হিসেবে তো তিনি ছিলেন অনন্য। তার লেখা পৃথিবীর প্রথম শিশু চিকিৎসা-সংক্রান্ত বই ‘বৃদ্ধ জীবক তন্ত্র’ পরবর্তীকালের চিকিৎসকদের গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। তার রচিত ‘কাশ্যপ সংহিতা’ বইটি থেকে অনেক ধরনের শিশুরোগ ও তা প্রতিকারের নিয়ম সম্পর্কে জানা যায়।
মগধে ফিরে জীবক বিভিন্ন ধরনের রোগীর চিকিৎসা শুরু করলেন। পরম ভক্তি ও ভালোবাসা নিয়ে তিনি গৌতম বুদ্ধেরও চিকিৎসা করেছেন। একবার গৌতম বুদ্ধের এক ক্ষতস্থান তিনি সারিয়ে তুলেছিলেন। আরেকবার গৌতম বুদ্ধ ভীষণ অসুস্থ হয়ে গেলে এবং ওষুধ সেবনে অস্বীকৃতি জানালে জীবক কৌশলে বুদ্ধের প্রিয় ফুল শ্বেতপদ্মের মাঝে ওষুধ বানিয়ে ফুলটি তার কাছে নিয়ে যেতে বললেন নিজের এক বন্ধুকে। বুদ্ধ যখন আপ্লুত হয়ে শ্বেতপদ্মের ঘ্রাণ নিলেন, তখন তার নিঃশ্বাসের সাথে ওষুধ পৌঁছে গেলো তার দেহে, আর এর পরই আরোগ্য লাভ করলেন বুদ্ধ।
জীবকের চিকিৎসার খ্যাতি দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে রোগীরা আসতে লাগলো জীবকের চিকিৎসা গ্রহণ করতে। রাজা বিম্বিসারও একবার ভীষণ অসুস্থ হলে জীবকের চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন। বিম্বিসার খুশি হয়ে তাকে নিজের রাজবৈদ্য নিযুক্ত করলেন। রাজকুমার অভয়ও জীবকের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তার সম্পদের কিছু অংশ দিয়ে দিলেন তাকে। জীবককে দেয়া একটি আমবাগানে জীবক গৌতম বুদ্ধের জন্য একটি বৌদ্ধ বিহার তৈরী করেছিলেন, যার নাম দেয়া হয় ‘জীবকাম্রকানন’।
বিম্বিসারের বন্ধু অবন্তীর রাজা চন্ডপ্রদ্যোৎ মহাসেনের জন্ডিসও সারিয়ে তুলেছেন জীবক একটি ঘি মেশানো ওষুধের মাধ্যমে। অযোধ্যার কাছে সাকেতনগরের অভিজাত পরিবারের একজন মহিলার দীর্ঘ সাত বছর যাবৎ মাথা ব্যথায় ভুগতে থাকার কষ্ট মাত্র কয়েকদিনের চিকিৎসায়ই দূর করেছিলেন জীবক, একটি ওষুধ তৈরীর মাধ্যমে যেটি নাকে টেনে নিতে হয়।
মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারে জীবক ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এছাড়াও অন্যান্য সার্জারিও খুব দক্ষ হাতে করতেন তিনি সেই প্রাচীনকালে। একবার এক ছেলে লাফ দিতে গিয়ে তার অন্ত্রের ক্ষতি হয়। শুধুমাত্র তরল খাবার খেয়ে আধমরা অবস্থায় বেঁচে থাকা ছেলেটিকে জীবক দক্ষ হাতে সুস্থ করে তোলেন।
জীবক তার চিকিৎসার মাধ্যমে একের পর এক চমক দিয়েই যাচ্ছিলেন। কিন্তু এতো কিছুর পরও তার মনে সামান্যতম হিংসাও বাসা বাঁধতে পারে নি। তিনি গৌতম বুদ্ধের আদর্শেই নিজের সম্পূর্ণ জীবন অতিবাহিত করে গেছেন। দরিদ্র রোগীকে তিনি বিনা অর্থে সেবা দিয়ে গেছেন। তার চারিত্রিক দৃঢ়তায় মুগ্ধ হয়ে বিম্বিসারের বিরোধী ছেলে ও বৌদ্ধবিদ্বেষী অজাতশত্রুও সারাজীবন তার মর্যাদা রক্ষা করে গেছেন এবং এক পর্যায়ে তিনি নিজেও বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
জীবকের চিকিৎসার মূল ভিত্তিই ছিলো আয়ুর্বেদশাস্ত্র, যার মাধ্যমে অজস্র রোগের প্রতিকার সম্ভব হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই আয়ুর্বেদশাস্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার এবং চর্চা করার মতো চিকিৎসক বর্তমানে দুর্লভ। বর্তমানকালের চিকিৎসা ব্যবস্থা যে পরিমাণ ব্যয়বহুল, সে জন্য অনেক অসহায় মানুষই তার প্রাপ্য চিকিৎসা নিতে সক্ষম হয় না। অথচ আমরা যদি অর্থের পেছনে না ছুটে জীবকদের মতো প্রাচীন চিকিৎসকদের আদর্শে ও তাদের দেখানো পথে চলার কথা কিছুটা হলেও ভাবতাম, তাহলে হয়তো আজকের পৃথিবীটা অনেক বেশি অন্যরকম হতো।