একটি গ্রীষ্মের সকাল। ৪ নং নন্দী স্ট্রীটের বসুবাড়ির প্রশস্ত একটি কামরা। আলো-আঁধারি খেলা করছে সেখানে। পাতলা একটি গেঞ্জি গায়ে কাজে বুঁদ হয়ে আছেন এক ব্রিটিশ নাগরিক। তার বেশ-ভূষা দেখে বুঝবার কোনো উপায় নেই যে, তিনি এখানকার মানুষ নন। বসুবাড়ির এই ঘরটিতে পেইয়িং গেস্ট হিসেবে থাকছেন তিনি বহু দিন যাবৎ। সাধারণত কাজ ছাড়া অন্য কিছু করতে দেখা যায় না তাকে। এই মুহূর্তে তিনি একটি প্রবন্ধ লেখায় ব্যস্ত। প্রবন্ধের নাম ‘ইম্প্রেশন অফ ইস্ট পাকিস্তান’। এই ব্রিটিশ ব্যক্তিই সর্বপ্রথম এই প্রবন্ধে পূর্ব পাকিস্তানের একটি স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। পূর্ব বাংলার আলো-বাতাস-প্রকৃতি, আতিথেয়তা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ এই ব্যক্তি হলেন ডেভিড জে. ম্যাককাশন, যিনি বাংলার প্রাচীন স্থাপত্যের টেরাকোটা নিদর্শনের প্রেমে পড়েছিলেন।
ডেভিড ম্যাককাশনের জন্ম ইংল্যান্ডে ১৯৩০ সালের ১২ আগস্ট। ইংল্যান্ডে পড়াশোনা শেষ করে দক্ষিণ ফ্রান্সের দুটো স্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে নিজের কর্মজীবন শুরু করেন ডেভিড। এরপর ২৭ বছর বয়সে তিনি ভারতবর্ষে আসেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি প্রভাষকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে। কিছু দিন যেতে না যেতেই বিশ্বভারতীর পরিবেশ উত্তাল হয়ে উঠতে শুরু করে। সেই সাথে ডেভিডের শরীরও খারাপ হয়ে যায়। তাই তিন বছর পর ১৯৬০ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে যোগদান করেন তিনি। প্রথমে শিক্ষক হিসেবে এবং পরে রীডার পদে তিনি উন্নীত হন। যাদবপুরের পরিবেশে তিনি বেশ মানিয়ে নিয়েছিলেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এখানেই কর্মরত ছিলেন।
ভারতবর্ষের প্রতি ডেভিডের আগ্রহ ছিলো অনেক আগে থেকেই। ক্যাম্ব্রিজে থাকাকালেই টেগোর সোসাইটির সদস্য ছিলেন তিনি। সেই থেকেই রবীন্দ্রচর্চা, বিশ্বভারতী ও ভারতীয় সংস্কৃতি জানার এক সুপ্ত বাসনা তার মনে লুকিয়ে ছিলো।
আমরা বাঙালিরা সাধারণত ডেভিড ম্যাককাশনের নাম শুনেছি সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা কাহিনীর শেষ উপন্যাস ‘রবার্টসনের রবি’ থেকে। মূলত ডেভিড ম্যাককাশন ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের বন্ধু। সিনেমা ও পাশ্চাত্য সংগীতের প্রতি আগ্রহের সূত্র ধরেই দুজনের পরিচয়। এই পরিচয় গড়িয়েছিলো ঘনিষ্ঠতায়। তাদের দু জনের বন্ধুত্ব এতোই গাঢ় ছিলো যে, সত্যজিতের বেশিরভাগ সিনেমার শ্যুটিং স্পটে তিনি ডেভিডকে সাথে নিয়ে যেতেন। এই সিনেমাগুলোর ইংরেজি সাবটাইটেলও লিখে দিতেন ডেভিড।
এভাবে চলতে চলতে একদিন সত্যজিৎ রায় সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাস অবলম্বনে তিনি ‘অভিযান’ সিনেমা তৈরী করবেন। যথা সময়ে কাজ শুরু হয়ে গেলো। ‘অভিযান’ সিনেমার শ্যুটিং এর জন্য তাদের যেতে হয়েছিলো বীরভূম জেলার হেতমপুরে। স্বাভাবিকভাবেই ডেভিড ম্যাককাশন সঙ্গে ছিলেন সত্যজিতের। বীরভূমের টেরাকোটা মন্দিরগুলো দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন ডেভিড। মুহূর্তে যেনো নিজের গন্তব্য খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। একেই তো খুঁজছিলেন তিনি এতো দিন যাবৎ। কৌতূহল থেকেই প্রথমে এই টেরাকোটা নিদর্শনগুলো নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন ডেভিড। তবে টেরাকোটার এই গবেষণা শুধু তার কৌতূহলেই সীমাবদ্ধ থাকে নি, পরিণত হয়েছিলো এক অদম্য নেশায়। কিছুটা আবেগের জায়গা থেকেই যেনো এই গবেষণা চালিয়ে যেতে লাগলেন ডেভিড।
পনেরো শতাব্দী থেকে শুরু করে বিশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলায় অসংখ্য টেরাকোটা মন্দির নির্মিত হয়েছে, যা নিয়ে আমাদের বাঙালিদেরই তেমন কোনো মাথা ব্যথা ছিলো না। ফলে অযত্নে-অবহেলায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো এসব নিদর্শন। এই অবস্থা থেকে স্থাপত্যগুলোকে বাঁচাতেই যেনো অন্তরে গভীর মমত্ববোধ দিয়ে ডেভিড ম্যাককাশনকে পাঠিয়েছিলেন স্বয়ং ঈশ্বর।
টেরাকোটা বা পোড়ামাটির এসব স্থাপত্যের খোঁজে বিরামহীনভাবে ছুটে বেরিয়েছেন ডেভিড ঐ বাংলা থেকে এই বাংলায়। কোনো জায়গাই বাদ রাখেন নি তিনি। বাংলা ছাড়াও ভারতবর্ষের আরও বহু জায়গায় গিয়েছিলেন তিনি, তবে তার মূল কাজটি বাংলা-কেন্দ্রিকই ছিলো। সারা সপ্তাহ যাদবপুরে শিক্ষকতা করে ছুটির দিনেই বেরিয়ে পড়তেন নিজের সাইকেলটি নিয়ে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য খুব সামান্য খরচই বরাদ্দ থাকতো তার হাতে। জোড়াতালি দেয়া পাতলা ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে দিয়েই কখনো লোকাল বাস বা ট্রেনে করে, আবার কখনো পায়ে হেঁটেই রওয়ানা দিতেন তিনি; খুঁজে বের করতেন জরাজীর্ণ পোড়ামাটির স্থাপত্যগুলোকে। নিজ হাতে যত্ন করে পরিষ্কার করতেন আগাছা। স্থাপত্যকে রক্ষা করার জন্য চারদিকে ছিটিয়ে দিতেন এসিড ও কীটনাশক। শুধু তা-ই নয়, যে এলাকায় তিনি যেতেন, সেই এলাকার মানুষদেরকে এসব মূল্যবান স্থাপত্য সংরক্ষণের বিষয়ে সচেতন করারও চেষ্টা করতেন, শিখিয়ে দিতেন এসিড ও কীটনাশকের ব্যবহার।
প্রাচীন মসজিদ, মন্দির, দরগা, দেবদেউল কোনো কিছুই বাদ রাখেন নি ডেভিড। চষে বেরিয়েছেন বাংলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। খাবার-দাবারের অনিশ্চয়তা, বন-জঙ্গলের ভীতি, দুর্গম পথ, প্রখর রোদ, ঝড়-বৃষ্টি কোনো কিছুই তাকে আটকাতে পারে নি।
বাংলার পুরাকীর্তির প্রতি তার এই প্রবল টান স্থানীয় মানুষদেরকে বিস্মিত করে তুলতো, বিস্ময় তৈরী করতো তার আচার-ব্যবহারও। একেবারে যেনো মিশে যেতেন তিনি জনসাধারণের সাথে। অবশ্য কাজের ক্ষেত্রে যতোই একাগ্রতা থাকুক না কেনো, আড্ডায়ও কিন্তু তার সমতুল্য কেউ ছিলো না। তার ছাত্রদের কাছে তিনি শিক্ষকের চেয়ে বন্ধু বেশি ছিলেন। তবে একটা কথা তিনি সব সময় বলতেন- “সময় নষ্ট করলে চলবে না, কাজ করে যেতে হবে নিরন্তর”। আজীবন তিনি তা-ই তো করেছেন।
ইংরেজিতে ভারতীয় লেখালেখির শুরুতেও অসামান্য অবদান রেখেছিলেন ডেভিড ম্যাককাশন। শুধু তা-ই নয়, দুই বাংলার যতো স্থাপত্যের ছবি তিনি তুলেছেন, তা ইতিহাসে বিরল। ফটোগ্রাফিও এ ক্ষেত্রে ছিলো তার জন্য নেশার মতো। তার প্রিয় ক্যামেরা ছিলো লাইকা। টেরাকোটার সন্ধানে বেরিয়ে পড়া ডেভিডের অভিযানগুলোতে তার চিরসঙ্গী হিসেবে কীটনাশক, এসিড, মাপার ফিতা, টর্চ, নোটবুক ও টেপ রেকর্ডারের পাশাপাশি এই লাইকা ক্যামেরাটিও ছিলো অন্যতম। তার তোলা দুই বাংলার মন্দিরের প্রায় ২০ হাজার ছবি লন্ডনের ‘ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়াম’-এ সংরক্ষিত আছে।
টেরাকোটা ছাড়াও বাংলার পট শিল্পের প্রতিও ভীষণ আকৃষ্ট হয়েছিলেন ডেভিড। গ্রাম-বাংলার গরীব পটুয়া শিল্পীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন। তিনি পট শিল্পকে বিশ্ববাজারে স্থান দেয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করে গিয়েছেন।
ডেভিড ম্যাককাশন দুই বার পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে এসেছিলেন, যদিও বাংলাদেশ তখনো স্বাধীন হয় নি। এ দেশের মানুষের সহজ-সরল মানসিকতা, নির্দ্বিধায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার প্রবণতা ও আন্তরিক আপ্যায়ন ডেভিডকে যারপরনাই মুগ্ধ করেছিলো। তিনি সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন এ দেশের হিন্দু ও মুসলমান লোকদের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব দেখে। ‘ইম্প্রেশন অফ ইস্ট পাকিস্তান’ প্রবন্ধে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণের সমস্ত অভিজ্ঞতা চমৎকারভাবে উল্লেখ করেছেন। রাজশাহী, খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, পাবনা -এ সমস্ত অঞ্চলে তিনি টেরাকোটা শিল্পের আকর্ষণে ছুটে গিয়েছিলেন।
ডেভিড ম্যাককাশন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রীডার ছিলেন মাত্র। তিনি তার স্বল্প আয় দিয়েই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলো সংরক্ষণের যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়েছেন। কোনো প্রকার অনুদান ছাড়াই সামান্য চা-বিস্কুটকে নিজের দৈনিক খাবার হিসেবে চালিয়ে দিয়ে তিনি নিরন্তর নিজের গবেষণা চালিয়ে গেছেন। রাতের অন্ধকারেও টর্চ লাইটের আলো ব্যবহার করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে টেরাকোটা মন্দিরের দেয়ালগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহ করতেন তিনি। ভাস্কর্য ও পুরাকীর্তির চোরা-চালান ও পাচার তার হৃদয়কে ব্যথিত করে তুলতো। তিনি এই চৌর্যবৃত্তি ও পাচার রোধে বুদ্ধিজীবী মহলের সহায়তা চাইতেন। তার লেখা চিঠিগুলোর শেষে সব সময়ই থাকতো মূল্যবান পুরাকীর্তি ও স্থাপত্য সংরক্ষণের আকুল আবেদন।
সত্যজিৎ রায় ছাড়াও পুরুষোত্তম লাল, আবু সাঈদ আইয়ুব, গৌরী আইয়ুব, বুদ্ধদেব বসু, প্রতিভা বসু, নরেশ গুহ, অশীন দাশগুপ্ত, উমা দাশগুপ্ত, তারাপদ সাঁতরা, অমিয়কুমার বন্দোপাধ্যায়, মানিকলাল সিংহ প্রভৃতি ব্যক্তিদের সাথেও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো ডেভিডের। এরা সবাই ডেভিডের কাজ, তার একাগ্রতা, তার প্রচেষ্টা ও তার আবেগের প্রশংসা করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের লেখা পড়লেই বোঝা যায় যে, বন্ধু ডেভিডের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধাবোধ বিদ্যমান ছিলো।
আমাদের স্থাপত্যগুলোর প্রতি, এগুলোর সংরক্ষণের প্রতি দায়িত্বটা কিন্তু আমাদেরই বেশি ছিলো। অথচ সেটিকে সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্ব মনে করে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে গিয়েছেন ডেভিড ম্যাককাশন। টেরাকোটা শিল্পের প্রতি, বাংলার সংস্কৃতির প্রতি, পুরাকীর্তি ও পটশিল্পের প্রতি তিনি যে আবেগ ও ভালোবাসা দেখিয়েছিলেন, তা সত্যিই অবাক করবার মতো, যেনো তিনি এগুলোকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন। এই গবেষণা ও কাজের মাধ্যমে তিনি আমাদের সামনে এগিয়ে যাবার পথটিকে ভীষণ মসৃণ ও সহজ করে দিয়ে গিয়েছেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিবেদিতপ্রাণ এই ব্রিটিশ ব্যক্তি মাত্র ৪১ বছর বয়সে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তবে মৃত্যুর পর তার স্থান হয়েছিলো তার ভালোবাসার বাংলাতেই। কলকাতার ভবানীপুর সমাধিক্ষেত্রে আজও চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ডেভিড ম্যাককাশন। টেরাকোটা-প্রেমিক এই ব্রিটিশ ব্যক্তির কবরটিকেও টেরাকোটায় মুড়িয়ে দিয়েছিলেন তার বন্ধুরা।
তার মৃত্যুর পর তার প্রিয় ছাত্র সুহৃদকুমার ভৌমিক, গবেষক তারাপদ সাঁতরা ও অমিয়কুমার বন্দোপাধ্যায়সহ তার আরো কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের উদ্যোগে তার অসম্পূর্ণ সংগৃহীত গবেষণাগুলো প্রকাশিত হয়েছিলো, যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘লেইট মেডিয়েভাল টেম্পলস অফ বেঙ্গল’, ‘ব্রিক টেম্পলস অফ বেঙ্গল’, পাটুয়াস অ্যান্ড পাটুয়া সংস অফ বেঙ্গল’।
ডেভিড ম্যাককাশনের কাজগুলো আমাদেরকে তার কাছে চির ঋণী করে দিয়েছে। আমরা সব সময় ব্রিটিশদের নেতিবাচকতা নিয়েই আলোচনা করে থাকি, তবে এ ধরনের কিছু মহৎপ্রাণ ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা আবশ্যক। হয়তো ভারতবর্ষে একজন ডেভিড ম্যাককাশনের আগমন না ঘটলে আমরা আমাদের নিজেদের শিল্প ও সাংস্কৃতিক জ্ঞানের ক্ষেত্রেই বেশ পিছিয়ে থাকতাম।
রেফারেন্স:
- ডেভিড ম্যাককাচন—বাংলার এক বিস্মৃতপ্রায় প্রত্ন-ভাস্কর্য গবেষক
- প্রয়াণের অর্ধশতক পেরিয়ে ডেভিড ম্যাককাচন