হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর কল্যাণে একাগ্রচিত্তে কাজ করে যাচ্ছেন নারীরা। অথচ তাদের অবদানের কথা তেমন গুরুত্বসহকারে কখনোই আমরা শুনতে পাই না। প্রাচীনকাল থেকে দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদ হাইপেশিয়ার মতো আরো অনেক নারী সমাজের কল্যাণে তাদের অসামান্য অবদান রচনা করেছেন। প্রায় ৬০০০ বছর আগেও প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতার অনেক নারীই সক্রিয়ভাবে সমাজ গঠনে ভূমিকা রেখেছেন। তবে দুঃখের বিষয় হলো, পাথরে খোদাই করা নারীদের সেই নামগুলোর বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে। তবে এদের মধ্যে এক জনের নাম পাওয়া গিয়েছে, যিনি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সালের দিকে ব্যবিলনে রসায়নবিদ হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি হলেন তাপুতি বেলাতেকালিম।

প্রত্নতাত্ত্বিকদের খুঁজে পাওয়া ৩২০০ বছরের পুরনো কিউনিফর্মটিতে প্রাচীন ব্যবিলনে সুগন্ধি উৎপাদনের ক্ষেত্রে তাপুতির অবদানের কথা লেখা ছিলো। তিনি সুগন্ধি প্রস্তুতকারক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। প্রাচীন ব্যবিলনে সুগন্ধি শুধুমাত্র সৌন্দর্য-বর্ধন বা প্রসাধনী হিসেবেই ব্যবহৃত হতো না, অনেক ক্ষেত্রে তা ঔষধ হিসেবে কিংবা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও পূজা-পার্বণের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

তাপুতি রাজপ্রাসাদের সুগন্ধি তৈরীর কারখানায় অফিসিয়াল তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করেছিলেন। ফলকে লেখা তাপুতির নামের শেষ অংশ ‘বেলাতেকালিম’ শব্দের অর্থ হলো, তত্ত্ববধায়ক বা প্রধান। মূলত তার কাজ ছিলো ব্যবিলনের রাজার জন্য সুগন্ধি প্রস্তুত করা।

প্রথম নারী রসায়নবিদ তাপুতির ৩২০০ বছর পুরনো পারফিউম তৈরীর ফর্মুলা লিখিত আক্কাদীয় কিউনিফর্ম ট্যাবলেট © The Archaeologist

আজ থেকে হাজার বছর আগেও সুগন্ধি তৈরীর ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ জ্ঞান না থাকলে কেউ সেই পদে আসীন হতে পারতেন না। রসায়নবিদ্যায় যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞান অর্জনের পরই এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হতো। সুতরাং নিঃসন্দেহে তাপুতি বেলাতেকালিম একজন সুদক্ষ রসায়নবিদ ছিলেন।

তাপুতির জীবনের প্রথম দিকের ইতিহাস বা তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমরা তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য খুঁজে না পেলেও তারই লিখে যাওয়া পদ্ধতির বর্ণনা অনুসরণ করেই আজ আমরা সুগন্ধি তৈরীতে সক্ষম হয়েছি। কতোটুকু পানি দিতে হবে, কতোটুকু ফুল মেলাতে হবে, কি কি তেল মিশাতে হবে, কতোটা লেমন-গ্রাস ব্যবহার করতে হবে -সমস্ত কিছুই কিউনিফর্মে ধাপে ধাপে লিখে গিয়েছিলেন তাপুতি। এই সমস্ত দ্রব্যাদির মিশ্রণ থেকে কিভাবে সুগন্ধি প্রস্তুত করতে হবে, তারও বিশদ বিবরণ ছিলো তার লেখনীতে। সুগন্ধি তৈরী করবার সময় তিনি এক ধরনের বিশেষ দ্রাবক ব্যবহার করতেন। সুগন্ধি এক বার প্রয়োগ করার পর সেই দ্রাবকটি বাষ্প হয়ে যেতো এবং শুধুমাত্র গন্ধটুকু রয়ে যেতো। সুগন্ধি প্রস্তুতিতে তরল-পাতন বা ফিল্টার করার জন্য তিনি যে ধরনের রাসায়নিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতেন, আজও বিভিন্ন ল্যাবরেটরীতে সেসব সরঞ্জামাদির ব্যবহার দেখা যায়।

একজন কেমিক্যাল-ইঞ্জিনিয়ারের মতো সুদক্ষভাবে তিনি কাজ করে গিয়েছেন সব সময়। কোল্ড এনফ্লারেজ বা টিংচারের মতো গন্ধ নিষ্কাশনের অন্যান্য অনেক কৌশল নিয়েও তিনি চিন্তা-ভাবনা করেছেন। কোল্ড এনফ্লারেজ হলো এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে কয়েক দিন ধরে এক টানা চর্বি বা চর্বি জাতীয় পদার্থের সাথে সুগন্ধি উদ্ভিদ রেখে দেয়া হয়। ধারণা করা হয়, একটি সুগন্ধি তৈরী করতে তাপুতির কখনো কখনো এক সপ্তাহও লেগে যেতো। আবার কখনো কখনো বেশ কয়েক সপ্তাহ সময়ও তিনি নিতেন।

তাপুতির নাম উল্লিখিত ভেঙে যাওয়া ট্যাবলেটের অংশবিশেষ

সুগন্ধি প্রস্তুতির ক্ষেত্রে তাপুতি ছাড়াও আরও অনেক নারী রসায়নবিদ কাজ করেছিলেন ব্যবিলনে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন তাপুতির সহকারী, নিনু। দুঃখের বিষয়, মাটির ট্যাবলেটটি ভেঙে যাবার কারণে তার নামের প্রথম অংশটুকু হারিয়ে গিয়েছে। আজ তাকে আমরা শুধুমাত্র ‘নিনু’ নামেই চিনি। সুগন্ধির প্রস্তুত-প্রণালী তিনিও দিয়ে গিয়েছিলেন।

নারীরা একটা সময় খ্যাতনামা রসায়নবিদ হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি যে সমস্ত সরঞ্জামাদি তারা নিজেদের কাজে ব্যবহার করতেন, সেগুলোও ছিলো অত্যন্ত উন্নত মানের। এতো প্রাচীন সময়েও যথেষ্ট উন্নত প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে মেসোপটেমীয় নারীরা পৃথিবীর প্রথম রসায়নবিদদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাদের প্রতি রইলো সশ্রদ্ধ সালাম। এই ঘটনার মাধ্যমে আরও এক বার প্রমাণিত হলো, প্রাচীন সময়ে নারীদের সম্মান কতোটা বেশি ছিলো।

তাপুতি বেলাতেকালিমের পারফিউম প্রস্তুতির চিত্র

 

রেফারেন্স: