ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য নানা দিক থেকেই ছিল বর্ণিল ও কৌতূহলোদ্দীপক। এই সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়ে মানুষের আগ্রহ আজও বলবৎ আছে। শক্তিশালী এই মুসলিম সাম্রাজ্যে মেয়েদের অবস্থান কেমন ছিল, মুঘল রাজপ্রাসাদে তাদের অবাধ বিচরণ নিয়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিই বা কেমন ছিল তা নিয়ে খুব একটা তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রাসাদের অভ্যন্তরে এই মহিলাদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল পৃথক পৃথক প্রতিষ্ঠান। মুঘল সাম্রাজ্যের অন্দরমহলে মহিলাদের ইতিহাস পাঠ করা যাক।

মুঘল হেরেম

ইতিহাসের বিখ্যাত সব সাম্রাজ্যের প্রাসাদের অভ্যন্তরে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছিল হেরেম। বৈবাহিক ও জন্মসূত্রে সম্পর্কিত রাজপরিবারে মহিলাদের আবাসস্থল হিসেবে হেরেমের পত্তন হয়। এছাড়া অনেকসময় উপহার হিসেবে পাওয়া অনেক সুন্দরী নারীও হেরেমের সদস্য হয়ে যেতেন। রাজকীয় মহিলাদের বাসস্থান হিসেবে পরিচিত হলেও এই হেরেম সম্রাটদের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারত। ফলে হেরেমের প্রভাবশালী অনেক মহিলারাই রাজকার্যে নাক গলাতেন। অটোমান সাম্রাজ্যে প্রাসাদের অভ্যন্তরে মহিলাদের জন্য আলাদা এই জায়গাকে বলা হত হেরেম, পারস্যে আন্দারুন আর ভারতীয় উপমহাদেশে জেনানা। মুঘল আমলের হেরেম ছিল সবচেয়ে বিখ্যাত। এসময় হেরেমকে বলা হত মহল। আবুল ফজল যার নাম দিয়েছিলেন শাবিস্তান-ই-খাস। হেরেমে সহজেই প্রবেশ করা যেত না৷ ফলে হেরেম সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণ্য বিবরণ খুব একটা পাওয়া যায় না। আকবরের আমলে মুঘল হেরেমে পাঁচ শতাধিক মহিলা থাকত। তাদের প্রত্যেকের আলাদা বাসস্থান ছিল। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে মহিলাদের সংখ্যা বেড়ে যায়। হেরেমের মহিলাদের বাসস্থান ছিল খুব জাঁকজমকপূর্ণ। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রভাবশালী সব মহিলাদের প্রাসাদ ছিল আগ্রাতে৷সম্রাটের আরও তিনটি প্রাসাদে তার উপপত্নীদের রাখা হতো। এগুলো ছিল লিথিভার মহল, মঙ্গলবার মহল ও জেনিসার মহল।

মুঘল হারেম নারীরা

হারেম হচ্ছে নারীদের জন্য নির্ধারিত পবিত্র স্থান

সুলতানি আমলের চেয়ে ভিন্নভাবে মুঘল সম্রাটগণ হেরেমকে এক সংগঠিত রূপ দান করেন। হেরেমের দারোগা ও পরিদর্শক পদে বাছাই করা নিষ্কলুষ  মেয়েদের নিয়োগ দেয়া হত। হেরেমের নিয়মশৃঙ্খলা দেখভালের জন্য একজন তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করা হতো। হেরেমের বিস্তারিত বিবরণ সংরক্ষণের জন্য একজন লেখিকা থাকত। বেতনভুক্ত এসব কর্মচারীরা তহশিলদারের কাছ থেকে নিজেদের বেতন বুঝে নিতেন। পুরো হেরেমের নিয়ন্ত্রণ করতেন একজন প্রধান মহিলা। যাকে বলা হতো মহলদার। তিনি সম্রাটের পক্ষে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতেন। প্রায় সময় দেখা যেত শাহজাদা ও মহলদারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে। কারণ শাহজাদারা মহলদারের গোয়েন্দাগিরি মেনে নিতে পারতেন না। হেরেমের পাহারা দেয়া হতো অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। সাধারণত হাবশী ও তাতার মহিলাদের পাহারাদার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হতো। সম্রাটের বাসস্থানের কাছে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মহিলা প্রহরীদের রাখা হতো। বাইরের সীমানায় রাখা হতো খোজা প্রহরীদের। তাদের থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে বিশ্বস্ত রাজপুত প্রহরীরা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরে হেরেমকে ঢেকে দিত। মূল দরজায় নিযুক্ত থাকত দারোয়ান। হেরেম ছিল একটি সংরক্ষিত এলাকা। রাজপ্রাসাদের কোন কর্মকর্তাদের পক্ষেও হেরেমে প্রবেশ করার সুযোগ ছিল না। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে মশাল জ্বালিয়ে হেরেমের দরজা বন্ধ করে দেয়া হতো। হেরেমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য এক প্রতিরক্ষার চাদরে পুরো মহলকে ঢেকে দেয়া হতো। হেরেম পাহারা দেয়ার জন্য সংযমী ও কঠোর মহিলাদের নিয়োগ দেয়া হত। হেরেমের খুটিনাটি সব ধরনের ঘটনা জানানোর জন্য একটা পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। এদের বলা হতো নাজির। অভিজাত কোন মহিলা যদি হেরেম ভ্রমণের ইচ্ছা পোষণ করতেন তবে অনেক আনুষ্ঠানিকতা পেরিয়ে তাদের অনুমতি দেয়া হতো। মহলে সংঘটিত সকল ঘটনার প্রতিবেদন সম্রাটের কাছে জমা দেয়া হতো।

হেরেমের প্রভাবশালী মহিলারা অনেকসময় রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। সম্রাট আকবরের অভিভাবক বৈরাম খানের পদচ্যুতির পর অনভিজ্ঞ সম্রাট হেরেমের মহিলা দ্বারা প্রভাবাধীন হয়ে পড়েছিলেন। ১৫৬০-৬২ সালের আকবরের এই শাসনকে ইতিহাসে পেটিকোট সরকার বা পর্দার শাসন নামে অভিহিত করা হয়।  হেরেম ছিল মুঘল সম্রাট, রাজপুত্র ও অভিজাতদের এক বিনোদনের মাধ্যম। ষষ্ঠ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব হেরেমের আমোদ ফূর্তি চর্চার রাশ টেনে ধরেছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পরই হেরেমের অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যায়।

অভিজাত মহিলারা

প্রাসাদের অভিজাত পুরুষরা একাধিক বিয়ে করতেন। বড় স্ত্রীকে বেশি মূল্যায়ন করা হতো। অভিজাত কর্মকর্তার স্ত্রীরা চালচলনে রাজকীয় হওয়ার চেষ্টা করতেন। তারা প্রায়ই রাজ পরিবারের মহিলাদের অনুকরণ করার চেষ্টা করতেন। অভিজাত মহিলারা তাদের স্বামীর উপর নিরংকুশ আনুগত্য ও শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। অভিজাত ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট দিনে তাদের স্ত্রীর সাথে দেখা করতেন। সেদিন ঐ স্ত্রী তার স্বামীকে আড়ম্বরের সাথে গ্রহণ করতেন। অভিজাতরা যখন বাইরে বের হতেন তখন তারা তাদের সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রীকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। বাকিরা মনমরা হয়ে প্রাসাদে বসে থাকত। অনেক স্ত্রীরা তাদের সতীনদের ওপর ঈর্ষা পোষণ করতো। কিন্তু স্বামী অসন্তুষ্ট হবেন এই ভয়ে তারা সেটি প্রকাশ করতো না। অভিজাত এই মহিলাদের পাহারা দিতো খোজা প্রহরী। খোজা প্রহরী ঠিকঠাক পাহারা না দিলে তাকে শাস্তির সম্মুখীন হতে হতো। এই অভিজাত মহিলারা অনেক বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। এদের মধ্যে জাফর খানের স্ত্রী ছিলেন সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয়। খলিল উল্লাহ খানের স্ত্রী ও আসফ খানের নাতনিও ছিলেন খুব ঐশ্বর্যশালী। হেরেমে তাদের প্রভাবও ছিল ব্যাপক। অভিজাত স্ত্রীরা তাদের স্বামীর কাছ থেকে একটি পৃথক গৃহ ও মাসিক খরচ বাবদ আলাদা ভাতাও পেতেন। তাদের আশেপাশে অনেক সেবা প্রদানকারী মেয়ে ও ক্রীতদাস থাকত। স্বামীর ওপর স্ত্রীদের প্রভাব অনুযায়ী সেই স্ত্রীরা প্রাসাদে আলাদা মর্যাদা উপভোগ করতো।

মুঘল  নারীরা

মুঘল অভিজাত মহিলা

উপপত্নীরা

অভিজাত ও রাজকীয় পুরুষদের  উপপত্নী রাখার প্রথা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল৷ বেশিরভাগ অভিজাত পুরুষরা উপপত্নী রাখতেন। তারা স্ত্রীর মর্যাদা পেত না তবে অনেক সময় অনেক উপপত্নী ভালবাসা দিয়ে সংশ্লিষ্ট পুরুষের মন জয় করতে পারতেন। সব উপপত্নীরাই তাদের পুরুষ সঙ্গীর মন জয় করতে সবরকম চেষ্টা করে যেতেন। উপপত্নীদের জন্য আলাদা বাসস্থান ছিল। তাদের পাহারার জন্য খোজা প্রহরী নিয়োগ দেয়া হতো। অভিজাতরা এদের স্ত্রীর সম্মান না দিলেও অনেক সময় তাদের বেশ গুরুত্ব সহকারে মূল্যায়ন করতেন। কেউ কেউ স্ত্রীর মর্যাদাও পেতে সক্ষম হতেন।

মহিলা জ্যোতিষী 

মুঘল প্রাসাদে মহিলা জ্যোতিষীদেরও উপস্থিতি ছিল। যদিও মুসলিমরা জ্যোতিষশাস্ত্র বিশ্বাস করেনা তারপরও সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে মুঘল হেরেমে এদের অবস্থান পাকাপোক্ত হয়। জাহাঙ্গীরের সময় একটি মূল্যবান মুক্তা হারালে এক মহিলা জ্যোতিষী ভবিষ্যৎবাণী করেন যে এটি খুব দ্রুতই পাওয়া যাবে এবং একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলা এটি নিয়ে আসবে। তার এই আগাম তথ্য সঠিক হয় এবং তাকে পুরষ্কৃত করা হয়।

গুপ্তচর 

আগা-ই-সার্ভকাদ নামের এক মহিলা গুপ্তচর ছিলেন হুমায়ুন ও আকবরের আমলে একজন গুরুত্বপূর্ণ মহিলা গুপ্তচর। তিনি খান-ই-খানান ও অন্যান্য প্রভাবশালী এবং উচ্চাভিলাষী আমিরদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতেন। উনি ছাড়াও মুঘল রাজপ্রাসাদে মহিলা গুপ্তচরদের উপস্থিতি ছিল।