বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পাঠক হিসেবে বিস্তর খাটাখাটি-ঘাটাঘাটি করলেও নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস বেশ একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। কথাটা কেমন একপাক্ষিক তথা একরোখা হলেও বাস্তবে এটাই ঠিক। এদেশ নদীমাতৃক, নদ-নদীর অববাহিকায় দেশের গোড়াপত্তন থেকে শুরু করে হাল-আমলের উত্থান-পতনের দিক পর্যন্ত নানাদিকে, নানাভাবে দিকবদল, ছন্দপতনের মাধ্যমে বর্তমান কালে উত্তরণ হয়েছে_তবে অবতরণের দিক দিয়ে নদী_তার আশেপাশে বসবাসকারী মানুষের জীবনের সঠিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার বর্ণনায় যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাই উত্তরণ-অবতরণের পারস্পারিক বিপরীতের মাঝে সম্পর্ক তথা কার ভারিত্ব বেশি সেদিকে না গিয়ে বরং যেটুকুই আছে তাতে দৃষ্টিপাত করাটাই সবচেয়ে ভালো হয়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদী মাঝি’ বা সমরেশ বসু’র ‘গঙ্গা’ নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসের উদাহরণ এটা যেমন সবার জানা কথা তদ্রুপ অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসও নদীকেই নিয়ে রচিত হয়েছে এটাও কারো অবিদিত নয়। বাঙালি সভ্যতার উৎপত্তি নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তবে ভব্যতার দিক দিয়ে বিচার করতে গেলে তাতে অবহেলার মাত্রাটা বেশি দৃষ্টিগোচর হয়_যার জ্বলন্ত উদাহরণ রচিত-বিরচিত সাহিত্যের বিভিন্ন দৃষ্টান্ত দেখে। সত্যিই তো নদীতে/নদীকে নিয়ে লেখার এমন কি আছে যে_ন্যাকাকান্না কাঁদতে বসলেন? তা অবশ্য হক কথা! কি-ই বা এমন আছে যে একজন ডাকাবুকো লেখক অনেককিছু লেখার নির্মল সুযোগ থাকতে নদীকে নিয়ে লিখতে যাবেন?নদীতে কি থাকে বা নদীর নিজস্ব কি আছে? উত্তর হতে পারে_পানি, মাছ। তাছাড়া আর কি থাকে? তারও জবাব আসতে পারে_এর আশেপাশে মানুষজন থাকতে পারে, তার সাথে সংগ্রামরত কতগুলো মানবসন্তানের প্রাত্যহিক জীবনাচারের কাহিনি জড়িত-বিজড়িত থাকতে পারে। আর কি থাকতে পারে/আছে? এর উত্তর দেওয়া মনে হয় স্বয়ং কল্পনাবাদী/ভাববাদী দর্শনচর্চা কারীর পক্ষেও অসম্ভব হয়ে ঠেকবে! কারণ এর পরে আর উত্তর হয় না! সব কেনো’র মনে হয় একটা কিন্তু আছে। সাথে সাথে বলা যেতে পারে_সব কেনো’র কোনো হ্যাঁ-না সরাসরি উত্তর হয় না! তাই চটজলদি উত্তর না খুঁজে উপন্যাসের দিকে আসা যাক। ইতিহাস আর ভবিষ্যৎ_দুটোই দুটোকে নিজ নিজ সত্ত্বাগুণে আচার-বিচারের নিমিত্তে সদাচার করার মাধ্যমে একটি আপোসে আসুক_অন্তত কদাচারের দ্বারা তারা বিদ্বেষ ছড়াবে না এটাই প্রত্যাশিত।
তিতাস একটি নদীর নাম_ঔপন্যাসিকের প্রথম রচনা হিসেবে সুধীমহল/বিজ্ঞমহলে পরিগণিত। বাংলা সাহিত্য তথা পৃথিবীর সাহিত্য খুব কম লেখকই আছেন যাদের প্রথম লেখার কল্যাণে রীতিমত বিখ্যাত হওয়ার তকমা পেয়েছেন বা তাদের ভাগ্য এধরণের উপাধি জুটেছে। অদ্বৈত মল্লবর্মণের লিখিত উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ অন্তত তারই উজ্জ্বল প্রমাণ হিসেবে নন্দিত যেমন হয়েছে তথাপি নিন্দুকের দ্বারা তা বারবার আলোচিত-সমালোচিতও হয়েছে। উপন্যাসটির বিচার-বিশ্লেষণ করলে দুটি দিক প্রধান হয়ে দেখা দেয়। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার সামঞ্জস্যতা বা পূর্ণতা-অপূর্ণতার তীব্র আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন আর বৃহত্তর ভাবে দেখতে গেলে গোষ্ঠীগত জীবনের একটি পট-পরিবর্তনের আভাস। উত্থান-পতনের নানা ঘটনার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের চরিত্রায়নে।
উপন্যাসের সমালোচনা মূলত দুটি দিকের প্রতি লক্ষ্য রেখে করতে হয় বা করা হয়। আর সেই সমালোচনায়-ই প্রকৃতপক্ষে ফুটে উঠে প্রদত্ত উপন্যাসের স্বার্থকতা বা ব্যর্থতার মাত্রা কতটুকু। প্রতিটি চরিত্রই মনে হয় উপন্যাসকে পাঠকের মনে অনেককাল স্থায়ী করে তুলে_অবশ্য সেসব চরিত্র আগে তাদের স্ব স্ব আবেদন তৈরি করার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। আর সে যোগ্যতার পরিস্ফুটন হয় স্বয়ং ঔপন্যাসিকের হাত দ্বারা। অর্থাৎ সহজ করে বলতে গেলে_রহিম-করিম-মফিজ স্বনামে-সুনামে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে বিলাতি উপাধিধারী নায়কের নায়কোচিত অবদানে ভাগ বসাতে পারে যদি ঔপন্যাসিক চান বা তাদের প্রতি সদয় হন। এরকম উপন্যাস রচনার একমাত্র প্রবাদপুরুষ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস_এটা সবারই জানা কথা। যাইহোক, চরিত্রের স্বার্থকতার সাথে সাথে উপন্যাসের নামের সাথে ঘটনার-দুর্ঘটনার কতটুকু সংযোগ-বিয়োজক আছে ইত্যাদীও দারুণভাবে প্রভাবিত করে সফলতা-বিফলতার ট্যাগ পেতে। তাই বলা যায়_উপন্যাস যথার্থ অর্থে স্বার্থক হয়ে উঠে ঔপন্যাসিকের কল্যাণে। অবশ্য একথা স্বরণ রাখা উচিত_একজন সাহিত্যিক তথা ঔপন্যাসিক মূলত তার সাহিত্যকর্ম রচনার সময় দুইভাবে তা করতে পারেন। তিনি সমাজের পারিপাশ্বিক ঘাত-প্রতিঘাতে যেসব ঘটনার সূত্রপাত হয় সেগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিতে পারেন বা বলা যেতে পারে তিনি যা দেখেন সেগুলোকে এবং সেভাবেই তা উপস্থাপন করেন। আরেক প্রকার হল_তিনি সমাজ তথা তার প্রোটাগনিস্ট মানুষকে যেভাবে দেখতে চান বা নির্মাণ করতে চান সেভাবে নিজ কর্মে ফুটিয়ে তোলেন। তাই এক্ষেত্রে পক্ষতার-নিরপেক্ষতার বিষয়গুলো অতটা স্ফটিকাকার না হলেও পাঠক যখন সেগুলোর পাঠান্তে বিচার করতে যায় তখন মনে হয়_একটু রাগ-বিরাগ তথা অনুরাগের ক্ষাণিক ঝলকের আভাস পাওয়া যায়। আর তখনই এধরণের শ্রেণীবিভাজনের আবির্ভাব হয়।
উপন্যাসের প্রারম্ভে দেখা যায়_তিতাস নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা এক জেলে সম্প্রদায়_যাদের আবার শ্রেণিগত পরিচিতি ‘মালো’। অথার্ৎ যাদের পেশা মাছ ধরা_তাদেরকে সাহিত্যিক ভাবে বলতে গেলে ধীবর তথা জেলে বলা যেতে পারে বা আমাদের সমাজে ডাকা হয়, তবে যারা মাছ ধরে তাদেরকে যে মালো বলে এটা উপন্যাসের খাতিরে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয়। সমাজের নিম্নবর্ণের, নিম্নবর্গের মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত এসব প্রান্তিক মানুষের পূর্বপুরুষেরা হয়ত_প্রতিপত্তির দিক দিয়ে আজকের মতো কপর্দকহীন ছিল না, আবার এমনও হতে পারে হয়ত তার বালাই ছিল না_তবে একথা মানতে দ্বিধা নেই বর্তমানের খাতিরে তারা নেহাতই সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন। সামাজিক অবস্থান, সাংস্কৃতিক রুচিশীলতা, ধর্মীয় আচ্ছন্নতা বা আর্থিক দৈন্যতা ইত্যাদীতে পীড়িত-নিপীড়িত অবস্থায় দিনাতিপাতে অভ্যস্ত ব্যক্তিজীবন তথা গোষ্ঠীজীবন_উভয়ক্ষেত্রে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব-নিকেশ, দ্বান্দিকতা, সম্পর্কের বিস্তৃতি-টানাপোড়ন কখনো যেমন পাঠকের মনে আক্ষেপের সূচনা করেছে, আবার তারসাথে কিছু কিছু ঘটনার অনাকাঙ্ক্ষিত জবরদস্তিমূলক সমাপ্তি বিরক্তির উদ্রেকও করেছে। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সমাপ্তি খুব করুণভাবে লেখক চিত্রায়িত করেছেন। নাটকের বেলায় এরকম বিয়োগাত্মক ঘটনা ঘটলে তাকে বলা হতো ‘ট্র্যাজেডি’ বা শোকাত্মক নাটক। তবে উপন্যাসের বেলায় হয়ত এমন বিভাজনের সুযোগ নেই। যদি থাকত তবে_প্রদত্ত উপন্যাসকে বলা হত সামাজিক আবরণে বিয়োগান্ত ঘটনার বিশ্লেষণ।
প্রধান চরিত্র হিসেবে সবার আগে উল্লেখ করতে হয়_বাসন্তীকে। উপন্যাসের এই চরিত্রটি মনে হয় সবার থেকে আলাদা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত_যে সমস্ত ঘটনা ঔপন্যাসিক তার রচিত উপন্যাসে ঘটিয়েছেন তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাক্ষী হিসেবে বাসন্তী’র সদর্প উপস্থিতি দারুণভাবে আকর্ষিত করে। নানা দুঃখ-বেদনায় জর্জরিত, কিশোরের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত, সুবলের সাথে পাণিগ্রহণ করলেও সে সংসার আর বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, কিশোরের বিয়ে করা বউ তথা অনন্তের মায়ের সাথে সখিত্ব গড়ে তুললেও তার নশ্বরতা, অনন্তের মাসীমা থেকে শুধুমাত্র মা হয়ে উঠার আকুল প্রতিক্ষা, অত্যাধিক-অপত্য স্নেহের কাছে সবকিছু বিসর্জন দিয়ে অনন্ত তাকে ছেড়ে চলে গেলেও পুনরায় ফিরে পাওয়ার ব্যাকুলতা এবং সর্বশেষে ঔপন্যাসিক কর্তৃক তাকে শুকিয়ে যাওয়া তিতাসের ধূ ধূ বালির বুকে তৃষ্ণালু স্বপ্নে মোহিত করে মৃত্যুর মাধ্যমে করুণ সমাপ্তি টানা ইত্যাদী ঘটনাগুলো চোখের কোণে জল এনে দেয়। এখানটাতে ঔপন্যাসিকের সমালোচনা একান্ত কাম্য মনে হয়। চাইলে একটু ভিন্নভাবে আর ভিন্নদিকে ঘটনার অবতারণা করে তার একটা উষ্ণীয় ইতি টানা অসম্ভব হতো না। মানব জাতির কষ্টের একটা সর্বোপরি কায়াহীন দিকের নির্দেশনা আছে বলে অনেকে বলে থাকেন তবে যুক্তির খাতিরে এটাও বলা যেতে পারে_সেটারও একটা সুস্পষ্ট-সুশৃঙ্খল পরিমাণ থাকা উচিত। উপন্যাসে বাসন্তী’র ব্যক্তিত্বের দিকে দৃকপাত করলে যা গোচরীভূত হয় সেটা হল_সে কখনো নিরাশ বা হতাশ হয়নি। ঔপন্যাসিক বারবার তাকে বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষার সামনে হাজির করেছেন তবে সবকিছুকে উতরে সে ভবিষ্যতের ভালোর দিকে সর্বদাই মনোযোগ দিত। কিন্তু অভাগা’র কপাল/বরাত মন্দ_বলে মানব সমাজে যে একটা কর্কশ সত্য আছে সেটারই বাস্তব প্রতিভূ হিসেবে উপস্থিত বাসন্তী নামক চরিত্রটি। এক্ষেত্রে বলা যায়_সৃষ্টিকর্তা যদি বাসন্তী’র বরাত/ভাগ্য লিখত, তবে অবশ্যই ঔপন্যাসিক থেকে অনেক সদয় হয়ে, নির্দয়তার মাত্রা কমিয়ে একটা যথোপযুক্ত ফায়শালা করতে পারতেন। তবে তা আর হয়ে উঠেনি! হয়ত আরো সমালোচনা করা যায় তবে বাস্তবতার চেয়ে অবাস্তবতার আশ্রয় নিয়ে লেখক এই চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছেন_এটা একবাক্য বলে ফেললে তা লেখকের প্রতি অন্যায় হবে। এরকম চরিত্রের হাজারো উদাহরণ আমাদের সমাজের আনাচে-কানাচে হরহামেশাই সাক্ষাৎ মেলে। তাই বিতর্কে না গিয়ে বাসন্তী’র এই করুণ পরিণতিকে নির্ধিদ্বায় মেনে নেওয়াই যুক্তিসংগত হবে।
কিশোর আর সুবল_দুজন বাল্যকালের হরিহর বন্ধু হলেও রুচিশীলতার দিক দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মেরু থেকে অবস্থান করে। জেলে পল্লি’র মালো বংশে জন্মগ্রহণ করলেও দুই বন্ধুর মধ্যে সখ্যতার বিচারে তা যেকোনো পরিশীলিত সমাজের আচার-বিচারের সমকক্ষ হওয়ার দাবি রাখে বলে মনে করি। সারাদিন মাছ ধরার নেশায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভ্রমণ করার যে অদম্য প্রত্যাশা-আশার সম্মীলন তা রবীন্দ্রনাথের সেই ‘অতিথি’ গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়। দুজনের মাঝে বড় হয়েছে পূর্ববর্ণিত বাসন্তী। বাসন্তী’র মনের মানুষ হিসেবে কিশোরের দিকে ঝোঁক থাকলেও ঘটনার পৃষ্ঠটানে তাতে সুবলের উপস্থিতি জানান দেয়_মানুষ যা চায়, তা পায় না। তাই তো দূরদেশে মাছ ধরতে গিয়ে কিশোরের পছন্দ হয় এক ভিনগাঁয়ের মেয়েকে। সুবল জানত_বাসন্তী কিশোরকেই ভালবাসে, সেখানে তার স্বীয় অবস্থান পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। যাইহোক, ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে কিশোর ঐ ভিনগাঁয়ের মেয়েকেই বিয়ে করে, সুবল তারপরে বাসন্তীকে। যদিও এই দুটি চরিত্রের অবশেষ পরিণীতি আগেরটার মতোই বিয়োগাত্মক হয়। সুবল মারা যায় মাছ ধরতে গিয়ে আর কিশোরের মৃত্যু হয় মানুষিক বৈকল্যগ্রস্ত হয়ে মানুষের প্রহারের দ্বারা। অবশ্য তারও আগে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসার পথে ডাকাতদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নিতান্তই পাগল হয়ে যায় সে। যদিও ঘটনাচক্রে অনন্তের মা তথা তার বউয়ের সাথে দেখা হয় তবে তখন তার আগের স্মৃতির লোপ হয়েছে। তাই শেষ সুস্থিত পরিণয়ের আর সম্ভব হয়নি।
অনন্তের মা, কিশোরের বউ এই দুটি পরিচয় উপন্যাসের দ্বিতীয় প্রধান নায়িকার থাকলেও তার নিজের কোনো নাম লেখক বলে যান নি। এক উৎসবের দিনে কিশোরের সাথে দেখা হওয়ার পরিপেক্ষিতেই প্রণয়সূত্রে গ্রথিত হয় তারা। শ্বশুর বাড়িতে ফেরার পথে ডাকাতের আক্রমণের মুখে পতিত হলে নিজ সতিত্বকে বাঁচাতে ঝাপ দেয় প্রমত্ত তিতাসে। ঘটনাক্রমে কিশোরের গ্রামেই তাকে ঠাই নিতে হয়। তখন অবশ্য কিশোরের হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত হয়ে পাগলপ্রায় অবস্থা। অনন্ত নামে একমাত্র ছেলেকে ভালোবাসার শেষ সম্বল হিসেবে স্মৃতিচিহ্ন রেখে, বিদায় নেয় উপন্যাসের মাঝ থেকে। এই চরিত্রের সাথে বাসন্তী চরিত্রেরও অনেক মিল লক্ষ্য করা যায়।
আর আর চরিত্রের সমাবেশ ঘটনার খাতিরে যেমন এসেছে, সাথে সাথে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সেগুলোকে বাধ্যতামূলক বিদায়ও নিতে হয়েছে। অনন্ত_অপ্রধান চরিত্র হলেও তাকে নিয়ে ঔপন্যাসিক তার লেখার কলেবর বৃদ্ধি করতে চেয়েছেন বলে মনে হয়। ছোট অনন্তের বড় হয়ে উঠা, বাসন্তী’র কাছ থেকে আরেকজনের প্ররোচনায় দূরে সরে গিয়ে, মালো পাড়ার এক মেয়েকে ভালোবাসার আশা দিয়ে, শহরে গিয়ে তাকে ভুলে যাওয়া এবং সবশেষে শিকড়ের মূলকে উপড়ে ফেলে দেওয়ার মাধ্যমে উপন্যাস থেকে অব্যাহতি পাওয়া_ইত্যাদী সাধারণ সচরাচর উপন্যাসে যেমন দেখা যায় সেটারই প্রতিনিধিত্ব করে। তাই এটাকে বড় করে দেখার কোনো শক্তপোক্ত কারণ খুঁজে পাই না।
এবার উপন্যাসের নামের স্বার্থকতার বিচার করতে যাওয়া সমীচীন হবে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, বা আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘কর্ণফুলী’ উপন্যাসের বেলায় দেখা যায়_নামের ক্ষেত্রে নদীর সংযোগ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে নদীর যে ধরণের ভূমিকা ছিল বা থাকার কথা সেটা ফুটিয়ে তোলা হয়নি। নদী সেখানে প্রাধান্য হারিয়ে, প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে হয় সমাজ, নয়ত মানুষ অথবা অন্যকোনো বিশেষ দিক তাতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নদীকে আসল ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু থেকে বেকসাইডে পাঠিয়ে দিয়েছে। তাই কার্যত নদীকেন্দ্রিক নামে থাকলেও বেনামে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পক্ষ সেখানে যুক্ত হয়ে আগেরটার সমাপ্তি ঘটিয়েছে। অদ্বৈত মল্লবর্মণের বেলায় কথাটা যে একদম খাটে না তেমন নয়। তিনিও তার উপন্যাসে নামের দিক দিয়ে নদীকে টানলেও চরিত্রের চিত্রায়ন বা ঘটনার বিশ্লেষণ_ উভয় দিক দিয়েই নদী পূর্ববর্ণিত অপ্রধান হয়ে দাঁড়ায়। নদীর পাড়ে, তবে একদম নদীকে নিয়ে যাদের বসতি তাদের তথা মালো পাড়ার মানুষরা হয়ে ওঠে তার রচনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। অথচ নদীর অবদান মনে হয় মাছ ধরাতে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। হতে পারে_ আবার তার উল্টোটাও হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কেননা অন্যসব নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস থেকে এটা আমার কাছে ব্যতিক্রম লেগেছে। নদীর বহমানতার সাথে মানুষের জীবন তথা তার/তাদের জীবনের জঙ্গমশীলতায় নানা পট-পরিবর্তনের ধারা বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে। নদীর জন্ম আছে, তার হয়ত একটা অশৃঙ্খল বিকাশ আছে, যৌবনের প্রমত্ত গতি আছে এবং সবশেষে তার একটা করুণ বিনাশের পরিণতি আছে। যুগ যুগ ধরে বয়ে চলার মাধ্যমে কালের বিবর্তনে অনেককিছুর নিরব ঘটনার সাক্ষী থেকেছে তিতাস নদী। তার আশেপাশে বসবাসকারী মানব সম্প্রদায়ের জীবনে সে হয়ত দৃশ্যত প্রধান হয়ে দাড়ায়নি তবে ঔপন্যাসিক ঘটনার শেষ বর্ণনাতে বাসন্তী’র মৃত্যুর দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে জানান দিয়েছেন_নদীর মতো শুকিয়ে, বন্ধ্যত্ববরণ করতে যাচ্ছে তিতাস পাড়ের মানুষের জীবন ব্যবস্থাও। আর এখানেই মনে হয় নামের স্বার্থকতার আভাস মেলে।
অবশেষে বলা যায়_অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস কিঞ্চিত সমালোচনার দোষে দুষ্ট মনে হলেও সার্বিক বিচারে সেটা ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও চলে। বৃহত্তের মাঝে ক্ষুদ্রতরের হয়ত আহামরি কোনো প্রভাব নিয়ে আসার মতো ক্ষমতার চেয়ে অক্ষমতাই বেশি, তবে মাঝে মাঝে সেই অপ্রধান চরিত্র বা ঘটনা যখন প্রধান হয়ে দাড়ায় তখন আর কোনো সমালোচনা বোধহয় ধোপে টেকে না। তদ্রুপ উপন্যাসেও এরকম কিছুর সমাবেশ থাকার কারণেই এটা বিশিষ্টতা পেয়েছে। তাই সর্বপরী বলা যায়_বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসের ঘাটতি আছে তা যেমন সত্য কথা তদ্রুপই যেগুলো আছে তারও শিল্পমূল্য_অমূল্য হিসেবে বিবেচিত হওয়ার আবেদন, যোগ্যতা রাখে।
সবশেষে উপন্যাসের মানবিক সম্পর্ক নিমার্ণ-বিনির্মাণের একটি তাৎপর্যবাহী উক্তি দিয়ে বিদায় হচ্ছি_’ মানুষের সমন্ধ আসনে-যাওনে, আর গোরুর সমন্ধ লেহনে-মোছনে’। (সমাপ্ত)
বি.দ্র._পুরোটাই ব্যক্তিগত মন্তব্য-উপলব্ধি। তাই যথোপযুক্ত সমালোচনা একান্ত কাম্য।