অনেকক্ষণ যাবৎ আশেপাশে কোনো জীবিত মানুষকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসছে আর্তনাদের সুর। এই সুর স্বাভাবিক নয়, স্বাভাবিক হবার কথাও নয়। আমি এখন ধুলোবালিতে আচ্ছন্ন একটি জায়গায় শুয়ে আছি। এই জায়গাটি কিছুক্ষণ আগেও একটি যুদ্ধক্ষেত্র ছিলো। এখানে শুয়ে থেকেও আমি বুঝতে পারছি এই অঞ্চলের ঘরবাড়িগুলো যে দাউ দাউ করে জ্বলছে। এই জায়গাটির এমন একটা অবস্থা হয়েছে যে এখন দিনের ঠিক কোন প্রহর তা পরিষ্কার করে বোঝার উপায় নেই।
নিশ্চয়ই ভাবছেন যে এমন তান্ডব করলো কে, কে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। ঐ তো, আমি দেখতে পাচ্ছি তাকে, রুক্ষ চেহারার সেই দানবটি আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমার ইচ্ছে করছে ঐ নিষ্ঠুর পশুটার বুক চিরে তার প্রাণটা এখনি বের করে নিয়ে আসি। কিন্তু আমি তো তা পারবো না। কারণ আমার দেহে তো প্রাণ নেই। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন, আমি একটি মৃতদেহ, কলিঙ্গ অঞ্চলের একজন সৈন্য ছিলাম আমি। কিন্তু এই পাষাণ হৃদয় লোকটির জন্য আমি আমার পরিবার, আমার সন্তানদের আর দেখতে পাবো না। অথচ এই প্রাণহীন নিষ্পলক চোখ দিয়ে এখন দেখতে হচ্ছে ঘৃণাতুল্য এক চেহারা। ঐ তো, সেই নিষ্ঠুর সম্রাট আমার খুব কাছে চলে এসেছে। কিন্তু এ কি, আশ্চর্য! সম্রাটকে খুব কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছি, তার চোখ অশ্রুসিক্ত। তবে কি এই পাষাণের হৃদয় বলতেও কিছু আছে? এই মুহূর্তে তার চোখে আমি অনুতাপ দেখতে পাচ্ছি। হঠাৎ করে সম্রাটের জন্য আমার করুণা হলো। সম্রাট পরম মমতায় হাত দিয়ে আমার খোলা চোখ দুটো বন্ধ করে দিলেন।
সময়টা ১৭৮৯ সাল। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোনস গত কিছুদিন যাবৎ বেশ পরিশ্রম করে বৌদ্ধ ধর্ম এবং বুদ্ধ নিয়ে নিজের গবেষণা ও ভাবনাগুলো লিখে ফেলেছেন, ইতিমধ্যেই যেটা ‘এশিয়াটিক রিসার্চেস’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এই পর্যন্ত আসতে জোনসকে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে তিনি তেমন কোনো সহায়তা পান নি। হিন্দু শাস্ত্রে যদিও বুদ্ধকে বিষ্ণুর নবম অবতার বলা হয়েছে, তবুও কোনো বিচিত্র কারণে ব্রাহ্মণরা বুদ্ধকে ধর্মদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতা হিসেবেই চিনতেন। ইতালীয় পর্যটক মার্কো পোলো ভারতবর্ষ ঘুরে যাওয়ার পরই ‘বুদ্ধ’ নামের যে কোনো ধর্মগুরু ছিলো তা ইউরোপে প্রচার হয়। জোনস নিজেও জানতেন না যে ‘বুদ্ধ’ সম্পর্কিত লেখাটি ছাপা হওয়ার পর দেশবিদেশ থেকে এতো সাড়া মিলবে। এ যেনো তার আকাঙ্ক্ষারও ঊর্ধ্বে। আশেপাশের বিভিন্ন দেশ থেকে পালি ও সংস্কৃত ভাষায় লেখা বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিলো। এরপর বিভিন্ন চিঠিপত্র থেকে জোনস নিশ্চিত হলেন যে, ভারতবর্ষের মগধেই হয় বৌদ্ধ ধর্মের সূচনা, যে ধর্মের প্রতিষ্ঠাতার নাম গৌতম বুদ্ধ। গৌতম বুদ্ধকে অনেকে ‘শাক্যমুনি’ বলেও সম্বোধন করতেন। জোনস এ-ও নিশ্চিত করলেন যে, গৌতম বুদ্ধের জন্ম-মৃত্যুও মগধেই।
যদিও জোনস বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে লিখেছেন, কিন্তু তার মূল উদ্দেশ্য ছিলো অন্য কিছু। চতুর্দশ শতকে দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক দুইটি স্তম্ভ খুঁজে পান। তিনি এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে স্তম্ভ দুটিকে তিনি নিজের রাজধানীতে স্থানান্তরিত করেন। একটি তো দেখতে একদম সোনার মতো চকচকে ছিলো। সুলতান তার নামই দিয়ে দেন ‘মিনার-ই-জরিন’। এমন স্তম্ভের খোঁজ আস্তে আস্তে আরও মিলতে থাকে এবং একসময় সবাই বুঝতে পারে যে সমগ্র ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এসব মনোমুগ্ধকর স্তম্ভ। ইউরোপীয়রা ভাবতেন এগুলো গ্রীকদের বানানো, ভারতবর্ষের কেউ এমন কিছু বানাতে পারে এ কথা ঘুণাক্ষরেও কারো মাথায় আসলো না। অবশেষে এসব স্তম্ভের ইতিহাস উদ্ধার তথা প্রাচীন ভারতবর্ষের সত্যিকার ইতিহাস উদ্ধারের উদ্যোগ নেন উইলিয়াম জোনস। আর এই সূত্র ধরেই বৌদ্ধ ধর্মকে আবিষ্কার করেন তিনি। তিনি যার খোঁজ করছিলেন, তা তিনি তার জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেন নি। শুধু নিভে যাওয়া প্রদীপে খানিকটা আলোর সঞ্চার করে গিয়েছিলেন তিনি।
উইলিয়াম জোনস বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে কিছুটা জানলেন ঠিকই, কিন্তু যে উত্তরের আশায় তিনি হাত বাড়িয়ে ছিলেন তার দেখা পাচ্ছিলেন না। তাই তিনি প্রথমে সাল ও তারিখের দ্বিধা দূর করার সিদ্ধান্ত নিলেন। হঠাৎ করেই তার মনে হলো ছেলেবেলায় পড়া আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের ঘটনার কথা। গ্রীক লেখনীগুলো খুঁজে বের করলেন তিনি। আবারও ভালো করে পড়লেন হেরোডোটাস, স্ট্র্যাবো, মেগাস্থিনিস, আরিয়ান ও টলেমীর লেখাগুলো। আর এবার পেলেন একটি নাম, ‘স্যান্ড্রোকোটাস’। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর ভারতবর্ষে আলেকজান্ডারের বিজিত রাজ্যগুলো লাভ করেন তার সাতজন সেনাপতির একজন, যিনি সেলিউকাস নামে পরিচিত ছিলেন। সেলিউকাস মেগাস্থিনিসকে দূত বানিয়ে স্যান্ড্রোকোটাসের কাছে পাঠিয়েছিলেন। সেই সূত্রে, মেগাস্থিনিসের বই ‘ইন্ডিকা’ পড়ে জোনস জানলেন যে, স্যান্ড্রোকোটাসের রাজধানী ছিলো পালিম্বোথ্রা। এরপর সোমদেবের ‘কথাসরিৎসাগর’ ও বিশাখাদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ পড়ে তিনি নিশ্চিত হলেন যে স্যান্ড্রোকোটাসই মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, আর পালিম্বোথ্রা-ই পাটালিপুত্র। এরপর আরও দুটো নাম খুঁজে পেলেন তিনি, ‘বিন্দুসার’ এবং ‘অশোক’। কিন্তু আরও অগ্রসর হওয়ার আগেই ১৭৯৫ সালে মারা গেলেন জোনস। অদ্ভূত অনন্য স্তম্ভগুলোর রহস্য তার কাছে অজানাই রয়ে গেলো।
এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদক হোরেস হেম্যান উইলসনের গা ছাড়া ভাবের জন্য উইলিয়াম জোনসের মৃত্যুর পর স্তম্ভের রহস্য আবিষ্কারের কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ভারতের প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল কলিন ম্যাকেঞ্জি নিজ উদ্যোগে কিছুটা কাজ করেছিলেন। এরপর স্কটল্যান্ডের ফ্রান্সিস বুকানন সরকারি নির্দেশে ব্রহ্মদেশ (বর্তমান মায়ানমার), নেপাল, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি (বর্তমান তামিলনাডু ও অন্ধ্র প্রদেশ) ও সবশেষে বাংলা-বিহারে তথ্য সংগ্রহ করলেন এবং খুঁজে বের করলেন বৌদ্ধ ধর্মের মূল শেকড়।
১৮৩২ সালে জেমস প্রিন্সেপ নামক একজন তরুণ মৃতপ্রায় এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রাণের সঞ্চার করলেন এবং উইলিয়াম জোনসের অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। নিজের মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি উদ্ধার করেন সেই মনোমুগ্ধকর অসংখ্য স্তম্ভের গায়ে লিখে রাখা কথাগুলোর অর্থ। এবার পৃথিবীকে শুধু তাক লাগিয়ে দেয়া বাকি।
প্রিন্সেপ খুঁজে বের করেছিলেন অনন্য সেসব স্তম্ভের নির্মাণকর্তা রাজা দেবনামপিয়তিস্যকে, অনেকে যাকে ‘প্রিয়দর্শী’ নামেও চিনতেন। এই দেবনামপিয়তিস্য আর কেউ নন, উইলিয়াম জোনসের খুঁজে পাওয়া সেই রাজা স্যান্ড্রোকোটাস বা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রিয় পৌত্র অশোক মৌর্যই হলেন মহান সম্রাট দেবনামপিয়তিস্য বা প্রিয়দর্শী। ১৮৩৮ সালের মধ্যেই স্তম্ভের অধিকাংশ লেখার অনুবাদ করে ফেলেন প্রিন্সেপ। প্রিন্সেপের কাছে আরও প্রমাণ মিললো যে, বৌদ্ধ ধর্মের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন অশোক। বৌদ্ধ ধর্মকে ১৫০০ বছর টিকে থাকার শক্তি দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ মারা যান খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৬ সালে এবং জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর জৈন মারা যান খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৮ সালে। গৌতম বুদ্ধের এতো বছর পরে মহাবীর মারা গেলেও জৈন ধর্মের বিস্তার তুলনামূলক আগেই থেমে গিয়েছিলো। বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার কিন্তু থামে নি এবং এই কৃতিত্ব বুদ্ধের মৃত্যুরও ২০০ বছর পর সিংহাসনে আরোহণ করা সম্রাট অশোকের। তিনি এমনভাবে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার চালিয়েছিলেন যে, তার মৃত্যুর কমপক্ষে দেড় হাজার বছর পর পর্যন্তও যেনো বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার না থামে। আর জৈন ধর্মের ওপর তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন বলে অচিরেই হারিয়ে যেতে থাকে জৈন ধর্মের চিহ্ন।
প্রিন্সেপের খুঁজে পাওয়া সম্রাট অশোকের এই চেহারা নিশ্চয়ই ধার্মিক মনোভাবসম্পন্ন কোনো সাধারণ রাজার সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন, তাই না? তা-ই যদি হয়ে থাকে, তবে লেখার শুরুতে উল্লেখ করা সেই অতিবিধ্বস্ত যুদ্ধ ময়দানের নৃশংসতার জন্য দায়ী কে হতে পারে বলে ভাবছেন? আর অশোকের সাথেই বা তার কি সম্পর্ক থাকতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে চলে যেতে হবে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালে, যখন ভারতবর্ষে মোট ১৬টি জনপদ ছিলো এবং মগধ ছিলো এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ……………….<চলবে>