ষোড়শ শতাব্দীর শেষ এবং সতেরোশো শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যের মুসলিম শাসকরা মুঘল আগ্রাসনকে প্রতিহত করলেও ১৬৩৬ সালে মুঘলদের হাতে আহমদনগরের নিজামশাহদের পতন হয়। আবার, সতেরোশো শতাব্দীর শেষ অর্থাৎ ১৬৮৬ সালে গোলকুণ্ডার কুতুবশাহ এবং বিজাপুরের আদিলশাহ সুলতানরা মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। তবে নিজামশাহদের পতন মানে এই নয় যে, দাক্ষিণাত্যের পশ্চিম ও উত্তরঅংশে মুঘলদের প্রতিহত করার মতো কেউ ছিল-না।নিজামশাহদের পতনের ফলে, দাক্ষিণাত্যের ওই অঞ্চলে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরী হয়েছিল, শিবাজী ভোঁসলের (১৬৩০-৮০) সুদক্ষ নেতৃত্বে মারাঠারা তাঁদের স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজত্বের মাধ্যমে সেই শূন্যস্থান পূরণ করে। সম্রাট আওরঙ্গজেব মুঘল রাজ্যসীমায় বিজাপুর ও গোলকুন্ডা রাজ্যের সংযুক্তিতে যুক্তিপূর্ণ কারণেই বিলম্ব করেছিলেন,সম্ভবত তাঁর আশঙ্কা ছিল ওই দুই স্বাধীন রাজ্যের পতনের পর দক্ষিণভারতে যে শূন্যতা তৈরী হবে তাতে মুঘলদের আরও স্বাধীন প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হবে। অবশেষে, ১৬৮০ সালে শিবাজীর মৃত্যুর পর, ১৬৮৬ সালে মুঘলরা বিজাপুর ও গোলকুন্ডা রাজ্যের অধিকার নেয় ও ডেকানে তাঁদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।

মারাঠা শক্তি হিসাবে শিবাজীর আত্মপ্রকাশের বহু আগে,বাহমনি সুলতানদের সময় থেকে প্রায় দুশো বছর ধরে তাঁরা দাক্ষিণাত্যের মুসলিম শাসকদের রাজ্যে স্থানীয় জায়গীরদার বা সামরিক প্রধান হিসাবে কর্মদক্ষতার পরিচয় রেখেছিলেন। শিবাজীর পিতা শাহজী ভোঁসলে ছাড়াও তাঁর মাতামহ এবং পিতামহ নিজামশাহদের রাজ্যে উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন। তাই, নিজামশাহদের পতনের পর ডেকানে মারাঠারা মুঘলদের সামনে রাজনৈতিক বাধা সৃষ্টি করলেও তাঁদের প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের মধ্যে ডেকানের মুসলিম শাসকদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। দক্ষিণভারতে মুসলিম শাসকরা প্রথম থেকেই ধার্মিকভাবে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, যার প্রভাব তাঁদের স্থাপত্যেও দেখা গিয়েছিল। ডেকান স্থাপত্যে সব সময়েই হিন্দু-মুসলিম শৈলীর মিশ্রণ ঘটেছে, যার বাইরে মারাঠা স্থাপত্যও ছিল-না।

১৩৫০ সাল থেকে ১৭০০ সালের মধ্যে মারাঠারা একটি জাতিগত গোষ্ঠী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে যদিও তাঁদের বেশিরভাগ শাখা নিজেদের রাজপুত বংশজাত বলে দাবি করেছিল। অবশ্য মারাঠাদের বিভিন্ন শাখা রাজপুতদের বংশশাখার মতো এক রক্তের টানে বাঁধা ছিল-না অথবা কোনো একজন দলপতির আজ্ঞায় চলতে রাজি ছিল-না। প্রত্যেকে পরিবার সহ নিজেদের জায়গীরে বাস করতেন কিন্তু কোনো গোষ্ঠীপতির শাসন বা জাতের মিলনে কোথাও একসাথে সমবেত হতে রাজি ছিল-না। আহমদনগরের নিজামশাহী সুলতানদের পতনের পর মারাঠাদের কাছে সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ এসে যায়। শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা কৃষকরা লাঙ্গলের বদলে হাতে তরোয়াল তুলে নেয়। কয়েক শতাব্দী আগে উত্তরভারতে রাজপুতদের মধ্যে পরিচয় গঠনের প্রক্রিয়ার অনুরূপ, মারাঠারাও দাক্ষিণাত্যে মুসলিম শাসকদের দরবারে দেশীয় যোদ্ধা-অভিজাত শ্রেণিতে পরিণত হয়েছিল। আহমদনগর রাজ্যের পতনের পর দাক্ষিনাত্যে তাঁদের গুরুত্ব আরও গতি পায়।বাহমনি সুলতানদের পতনের পর ডেকানের পাঁচ মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে তাঁরা যেমন ভূমি অনুদান পেয়েছিলেন তেমনই তাঁদেরকে রাজস্ব আদায়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। রাজ্যের মুসলিম শাসকদের প্রতি অনুগত থাকলেও মারাঠারা নিজেদের জায়গীরে স্বাধীন শাসক হিসাবেই পরিচালিত হতেন। মারাঠাদের সামরিক ঐতিহ্য থাকলেও শাসকদের কাছে থেকে প্রাপ্ত ইনাম, জায়গীর ও ওয়াতনের (জন্মভূমি) অধিকার তাঁদেরকে দাক্ষিণাত্যে এক নতুন জাতি’র পরিচয় দেয়।

১৬৭৪ সালে মারাঠা রাজ্যের প্রধান হিসেবে শিবাজীর অভিষেক হলেও সতেরোশো শতাব্দীর মধ্য সময়ে তিনি যে মারাঠা রাজ্য গড়ে তোলেন, তাঁর মূল ভিত্তি ছিল ভাষার অভিন্নতা ও বংশগত সম্পর্ক। আঠারো শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে শিবাজীর দেখানো পথে,ভাষার অভিন্নতা, বংশগত সম্পর্ক এবং চ্যান্সেলারি সংস্কৃতির কারণে মারাঠাদের বিভিন্ন শাখা,পারস্পরিক সহযোগিতাকে নিশ্চিত করতে মহা জোট গড়ে তোলে।মারাঠাদের সেই জোটবদ্ধ শক্তি শুধু দক্ষিণভারতই নয় মধ্য ও উত্তরভারতের বিভিন্ন শাসকদের সাথে মিত্রতা গড়ে তোলে, যদিও সেই মৈত্রী যে খুব দৃঢ় ছিল তা কিন্তু নয়।মারাঠাদের বিভিন্ন শাখা যে মহাজোট গড়ে তুলেছিল,তাঁরা যে সবাই শিবাজীর বংশধর ছিলেন তা বলা যায়-না, যেমন সাতারার মারাঠা রাজাদের সাথে শিবাজীর বংশগত সম্পর্ক নামমাত্রই ছিল। তবে গোষ্ঠী হিসাবে মারাঠাদের আত্মপ্রকাশ যে রাতারাতি হয়েছিল এমনটা নয়, ১৩৫০ সাল থেকে ১৭০০ সাল পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। সতেরোশো শতাব্দীর পর থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন রাজ্যে মারাঠাদের বিভিন্ন শাখা বা পরিবার শাসক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা শুরু করে এবং তাঁরা মিলিতভাবে যে সংঘ গড়ে তুলেছিল, তার প্রশাসনিক, সামরিক এবং রাজস্ব কাঠামো কেন্দ্রীয়ভাবে পুনা থেকে পেশোয়াদের দ্বারা পরিচালিত হতো। রাজপুত মডেলের মতো মারাঠাকে নতুন জাতের শ্রেণি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করার বিষয়টি মারাঠা রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থার গোটা যুগ ধরেই অব্যাহত ছিল।

দীর্ঘদিন ধরে ডেকানে মুসলিম শাসকদের দরবারে মেলামেশার কারণে মারাঠাদের সংস্কৃতিতে পার্সিয়ান প্রভাব পড়েছিল।নিজেদের নাম, উপাধি এবং প্রশাসনিক ও সামরিক নামকরণ সেই প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল-না। তৎকালীন দাক্ষিণাত্যে মুসলিম শাসকদের প্রশাসনিক কাঠামো, বিশেষ করে রাজস্ব ব্যবস্থা মূলত তাঁদের উপরেই নির্ভরশীল ছিল। নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ ও প্রতিদ্বন্ধিতায় লিপ্ত মুসলিম শাসকরা নিজেদের স্বার্থের প্রয়োজনে তাঁদেরকে যেমন ‘রাজা’ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন, তেমনই মারাঠারাও নিজেদেরকে সামন্ততান্ত্রিক ক্ষত্রিয় প্রধান ও মুসলিম শাসকদের অনুগত হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন।১৫৬৫ সালে হিন্দু রাজ্য বিজয়নগরের বিরুদ্ধে তালিকোটার যুদ্ধে দক্ষিভারতের মুসলিম শাসকদের জোটে ছ-হাজার মারাঠা সেনা অংশগ্রহণ করেছিল। নিজামশাহী সুলতানরা তাঁদের সেনাবাহিনীতে বিপুল সংখ্যক মারাঠাদের চাকরি দেয় এবং তাঁদের পতনের পর ঐসব মারাঠা সেনা মুঘল ও আদিলশাহীদের সেনাদলে নাম লেখায়। কিন্তু শিবাজীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল ভিন্ন, মারাঠা স্বরাজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর যাঁরা তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন, তিনি তাঁদের যেমন শাস্তি দিয়েছিলেন তেমনই মুসলিম শাসকদের ঘনিষ্ঠদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাসাও করেছিলেন।পিতার সাথে তাঁর নিজের সম্পর্কও এর ব্যতিক্রম ছিলনা, নিজামশাহদের পতনের পর শিবাজীর পিতা শাহজী ভোঁসলে আদিলশাহীদের দরবারে স্থান নিয়েছিলেন এবং শিবাজী সেই আদিলশাহদের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। দাক্ষিণাত্যে শিবাজীর ‘স্বরাজ’ প্রতিষ্ঠার প্রেরণার পিছনে বহু পন্ডিত বিভিন্ন কারণ খুঁজে পেয়েছেন। যার মধ্যে সবচেয়ে প্রচারিত ভুল ধারণাটি হলো, ইসলাম ধর্মীয় মুসলিম শাসকদের হাত থেকে হিন্দুত্বকে বাঁচাতে ও হিন্দুধর্মের ওপর মুসলিম শাসকদের আক্রমণকে প্রতিহত করতে তিনি ডেকানে মারাঠা স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সম্ভবত ধর্মীয় আবেগের বিভাজনকে আরও দৃঢ় করা অথবা শিবাজীর কর্মকান্ডকে হিন্দু ধর্মের মধ্যে আকর্ষণীয় করে তুলতে কিছু ইউরোপিয়ান ইতিহাসবিদ সচেতনভাবেই ওই প্রয়াস করেছিলেন। সমকালীন ডেকানে হিন্দুদের হারানো আভিজাত্য ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করা, শিবাজীর কর্মকান্ডের প্রধান বিষয় ছিল-না।  

১৬৩৬ সালে নিজামশাহদের পতনের পর, তাঁদের রাজ্য মুঘল ও আদিলশাহীদের মধ্যে ভাগ হয় এবং শিবাজীর পিতা শাহজী ভোঁসলে আদিলশাহদের কাছ থেকে নিজামশাহদের প্রাক্তন রাজ্য জায়গীর হিসাবে দান পান। শিবাজী তাঁর স্বাধীন রাজত্ব সেই অঞ্চলেই প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে শিবাজী মুঘলদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন, তাই স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি কম সময়ই পেয়েছিলেন। তাঁর আমলে মারাঠা রাজ্যে দুর্গ ও সামরিক ইমারত ছাড়া রাজধানী রায়গড়ে মাত্র একটি মন্দির তৈরী করা হয়েছিল, ১৬৭৪ সালে রায়গড় গিরিদুর্গে তাঁরই উৎসাহে জগদীশ্বর মন্দির তৈরী করা হয়।

মুঘলদের হাতে শিবাজীর পুত্র শম্ভাজির (১৬৫৭-৮৯) বন্দি ও তাঁর হত্যাকান্ড, মারাঠা রাজ্যে সংকট তৈরী করে। শম্ভাজির পরিবারও মুঘলদের হাতে বন্দি হয়। শম্ভাজির পুত্র ও শিবাজীর নাতি ছত্রপতি শাহুও (১৬৮২-১৭৪৯) মুঘল হেফাজতে বন্দি অবস্থাতেই তাঁর নাবালকত্ব কাটান। অবশেষে পরিবারের অন্যান্য দাবীদারদের সাথে বেশ কয়েকটি লড়াইয়ের পরে ১৭০৮ সালে তিনি মারাঠা সিংহাসন অর্জন করেন।মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁর বাবার পরিণতি, সম্ভবত ছত্রপতি শাহু মুঘলদের প্রতি শ্রদ্ধা সহ সহানুভুতিশীল হবেন এই ভেবেই মুঘলরা তাঁকে মুক্তি দিয়েছিলেন। যদিও ১৭০৭ সালে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যু এবং ময়ূর সিংহাসনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার লড়াই মুঘল দরবারকে, বিচলিত করে তোলে।রাজনীতির মারপ্যাঁচে, কে পরবর্তী মুঘল সম্রাট হবেন, সেই ক্ষমতা সৈয়দ ভাইদের হাতে চলে যায়। তাঁরাই মুঘল দরবারে ‘কিং মেকার’ হয়ে ওঠেন। মুঘল দরবারের ঐরকম রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থায়, ১৭১৮ সালে ছত্রপতি শাহুর প্রধানমন্ত্রী, পেশোয়া বিশ্বনাথ ভাট (১৬৬২-১৭২০) ও মুঘলদের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, ওই চুক্তির মাধ্যমে মারাঠারা দাক্ষিণাত্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রাজস্ব আদায় ও জমির অধিকার অর্জন করে। পরিবর্তে ছত্রপতি শাহু মুঘলদের নামমাত্র আধিপত্য স্বীকার করে নেয়। বলা যায়, ঐসময় থেকেই মারাঠা রাজ্যের শিল্প ও স্থাপত্যে তাঁদের আনুষ্ঠানিক প্রভু মুঘলদের প্রভাব প্রবেশ করতে শুরু করে। আবার একই সময়ে দাক্ষিণাত্যের পূর্বদিকে, হায়দ্রাবাদের নিজাম-উল-মুলুক, প্রথম আসফ ঝা (১৬৭১-১৭৪৮) ছিলেন মুঘলদের প্রতীকী প্রতিনিধি এবং তাঁরই হাত ধরে তাঁদের শিল্প ও স্থাপত্যে মুঘলদের জাঁকজমক প্রবেশ করে। যদিও প্রথম আসফ ঝা ছিলেন মুঘলদের নামমাত্র প্রতিনিধি, তিনি দাক্ষিণাত্যের পূর্বদিকে স্বশাসিত শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন। দাক্ষিনাত্যে মুঘলরা তাঁদের শক্তি হারাতে শুরু করে এবং মারাঠা ও নিজামরা হয়ে ওঠেন মূল চালিকা শক্তি।মারাঠা এবং নিজাম, দু-পক্ষই তাঁদের স্থাপত্যে মুঘল শৈলীকে গ্রহণ করে এবং দাক্ষিণাত্যে স্থাপত্যের আঙিনায় তাঁরা নিজেদেরকে নতুন মুঘল বলে ভাবতে শুরু করে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই মারাঠারা রাজপূত দরবারকে নিজেদের প্রতিদ্বন্ধি ভেবে, স্থাপত্য ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতায় আরও বেশি করে মুঘল দরবারের অনুকরণ করা শুরু করে। ধীরে ধীরে মারাঠারা ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। মুঘলদের স্থাপত্যিক ভাষায় যেমন ক্ষমতা ও শক্তির অক্ষর মিশে ছিল,তেমনই মারাঠা স্থাপত্যের ভাষাতেও রাজনৈতিক ক্ষমতা ওই সময় থেকে প্রবেশ করে। স্থাপত্যিক ভাবে মুঘলরা যেমন তাঁদের সৌধের ভিজ্যুয়াল ভাষায় রাজনৈতিক শক্তিকে প্রকাশ করেছিল তেমনই অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে ডেকানে মুসলিম শাসকরা তাঁদের স্থাপত্যের ভাষায় সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। তাই স্থাপত্যের আঙিনায় ক্ষমতাকে প্রদর্শিত করা, মুঘলদের কাছ থেকে নয়, মারাঠারা দাক্ষিণাত্যের মুসলিম শাসকদের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন।

১৭০০ সাল অবধি, মারাঠারা সামরিক স্থাপত্যের দিকেই বেশি নজর দিয়েছিল, তাই সামরিক দুর্গ ছাড়া মাত্র কয়েকটি অসামরিক সৌধের স্থাপত্যিক ভাষায় তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতার আস্ফালন দেখতে পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়,ঐসময়ে তাঁদের রাজানুগ্রহে নির্মিত অধিকাংশ সৌধ ডেকানের মুসলিম শাসকদের স্থাপত্য শৈলীতেই তৈরী করা হয়েছে। মারাঠা শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশের প্রথমভাগে, শিল্প ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে তাঁদের নিজস্ব শৈলী অনুপস্থিতই ছিল। সম্ভবত, মারাঠারা তাঁদের স্থাপত্যে মুসলিম শাসকদের কারিগর ও একই সমবায় সংস্থার স্থপতিদের নিযুক্ত করেছিলেন, তাই তাঁদের সৌধ ও ডেকানের মুসলিম শাসকদের স্থাপত্যশৈলীর মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়-না।

মারাঠা স্থাপত্যের প্রাথমিক উদ্যোগ মূলত দুটি অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, বর্তমান মহারাষ্ট্র রাজ্যের সিন্দখেদ রাজা এবং ভেরুল(ইলোরা) গ্রামের মধ্যেই তা সীমিত ছিল। রাজ্যে উচ্চ পদমর্যাদার আমির হিসাবে মারাঠা যাদব ও ভোঁসলে পরিবার যথাক্রমে সিন্দখেদ রাজা এবং ভেরুল গ্রামের জায়গীর নিজামশাহদের কাছ থেকে দান পেয়েছিলেন। এই দুই অঞ্চলে যাদব ও ভোঁসলেদের তৈরী অনেক ইমারতের সন্ধান পাওয়া গেলেও অধিকাংশ সৌধেই কোনো লেখমালা পাওয়া যায়-না। তাই ঐসব সৌধের স্থাপত্যিক প্রমানের জন্য স্থানীয় উপাখ্যান, অবস্থাগত অবস্থান এবং দৃষ্টি ও কল্পনা সংক্রান্ত বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে সিন্দখেদ রাজা এবং ভেরুলের মারাঠা স্থাপত্যে, দক্ষিণভারতের মুসলিম শাসকদের স্থাপত্যিক সাদৃশ্য বেশ আকর্ষণীয়। আবার ১৬৭৪ সালে রায়গড় গিরিদুর্গে শিবাজীর উদ্যোগে তৈরী জগদীশ্বর মন্দির মারাঠা স্থাপত্যের প্রাথমিক নিদর্শন হলেও মন্দির শৈলীতে আদিলশাহী স্থাপত্যের প্রভাব চোখে পড়ে।

মহারাষ্ট্র রাজ্যে পুনে শহরের দক্ষিণদিকে সড়কপথে মাত্র একশো একত্রিশ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের উপর রায়গড় গিরিদুর্গ অবস্থিত। ১৬৭৪ সালে এই গিরিদুর্গে জগদীশ্বর মন্দির, শিবাজীর রাজ অভিষেক উপলক্ষে তৈরী করা হয়েছিল। মন্দিরটি দুর্গের উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। যদিও এই মন্দিরের স্থাপত্যিক সামঞ্জস্যের সাথে আধুনিক মধ্যযুগের কোনো হিন্দু মন্দিরের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়-না। বরঞ্চ মন্দিরটিকে দেখলে মনে হয়, স্থপতি বা কারিগররা হয়তো-বা মসজিদ নির্মাণেই বেশি দক্ষ ছিলেন। স্থাপত্যিকভাবে মন্দিরের গর্ভগৃহ গাঁথনি দেওয়া দুটি ঘনকাকৃতি কক্ষের সমন্বয়ে গঠিত এবং গর্ভগৃহের সামনে একটি মন্ডপ তৈরী করা হয়েছে। যেমন করে মসজিদে মিহরাবের সামনে নামাজ পড়ার জন্য লিওয়ান বা জুল্লাহ তৈরী করা হয়, সেইভাবেই গর্ভগৃহের সামনে উপাসনা করার জন্য ঐ মন্ডপটি তৈরী করা হয়েছে। বিজাপুর শহরে বিশেষ করে ইব্রাহিম রৌজার মসজিদে একই নকশা চোখে পড়ে। আবার এই মন্দিরের উপরে, প্রতি কোণায় ছোট মিনার আকারের যে গুলদস্তা তৈরী করা হয়েছে তার সাথে বিজাপুর শৈলীর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। বিজাপুর শহরে আকারে ছোট বহু মসজিদ দেখতে পাওয়া যায়, সেইসব মসজিদের গম্বুজ ও স্তুপিকায় যে ধরণের শৈলী ব্যবহার করা হয়েছে, স্থপতি জগদীশ্বর মন্দিরের গম্বুজ ও গুলদস্তার স্তুপিকায় সেই শৈলীই ব্যবহার করেছেন। আবার এই মন্দিরের প্রবেশপথে দু-পাশের খাম্বিয়া ও দ্বিস্তরীয় ছাদ প্রাচীরে, খিলান এবং স্প্যান্ড্রেলে বা-রিলিফে মেডেলিয়ানের নকশা ইসলামিক শৈলীর প্রতি স্থপতির প্রীতিকেই স্মরণ করায়। মধ্যযুগে দক্ষিণভারতে যাদব বা হয়সল রাজাদের আমলে নির্মিত যে সব হিন্দু মন্দির গড়ে উঠেছিল তার সাথে হিন্দু শৈলীর নিরিখে শিবাজীর আমলে তৈরী জগদীশ্বর মন্দিরের স্থাপত্যিক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়-না।বিজয়নগর রাজ্যের হিন্দু রাজা দ্বিতীয় দেব রায়ের (১৪২৫-৪৬ খ্রি) দরবারে পারস্যের রাষ্ট্রদূত আবদুর রাজ্জাক উপস্থিত হয়েছিলেন এবং তারপর থেকেই রাজ্যের দরবারে ধীরে ধীরে পারস্যের দরবারি প্রভাব প্রবেশ করতে শুরু করে। কিন্তু তাদের মন্দির স্থাপত্যেও গম্বুজ বা মিনারের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়-না। জগদীশ্বর মন্দির প্রাঙ্গনে বৃহৎ আকারের নন্দী মূর্তির ভাস্কর্যই শুধুমাত্র হিন্দু মন্দিরের স্থাপত্যিক দিককে নিশ্চিত করে।

জগদীশ্বর মন্দিরে নন্দী মূর্তি

কোরান শরীফ বলে, আল্লাহ এক। সেই পিতা সেই মাতা সেই প্রেমিক। তাঁর কাছেই স্মরণ নাও,তাঁর করুনায় নিজেকে সিক্ত করো। আবার বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে বলে, ভগবান হলো তোমাদের পিতা। তাঁকে পিতার মতো ভালোবাসো। ক্যাথলিকরা তাঁদের আভেমারিয়াতে(পুজোর মন্ত্রসঙ্গীত) মাতৃরূপে জননী মেরীর বন্দনাই করেন। জননীকে ভালোবাসতে বলে। আর হিন্দু বৈষ্ণব ধর্মে ভগবানকে পিতা বা মাতা রূপে কল্পনা না করে তাঁকে হৃদয়ে রাখতে বলে প্রেমিক রূপে। তিন ধর্মের মূল সুর-তো এক…. প্রেম ও ভালোবাসা। ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ। বৈষ্ণবের কাছে কীর্তনের যা মূল্য, একজন মুসলিমের কাছে আজান বা একজন ক্যাথলিকদের কাছে আভেমারিয়া, অর্থ একই। রায়গড় দুর্গে শিবাজীর আমলে তৈরী জগদীশ্বর মন্দির… সেই কথারই প্রতিধ্বনি তোলে আর যার সুর ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে।

মহারাষ্ট্র রাজ্যে ঔরঙ্গাবাদ শহর থেকে মাত্র ত্রিশ কিলোমিটার দূরে এবং খুলদাবাদ শহর থেকে সড়কপথে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইলোরা গ্রামে মারাঠা ভোঁসলে পরিবার বংশানুক্রমিক ভাবে জায়গীরদার ছিলেন। সম্ভবত

১৪১৫ সালে ভোঁসলে পরিবার দক্ষিণভারতে বাহমনি সুলতানদের রাজ্যে এসে উপস্থিত হয়েছিল।শিবাজীর পিতামহ মালোজী ভোঁসলে এবং তাঁর ভাই ভিঠোজি দুজনেই নিজামশাহী দরবারে প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন। মালোজী ভোঁসলে ইলোরা গ্রাম চিরস্থায়ী অনুদান হিসাবে নিজামশাহদের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন।

ঘৃষ্ণেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির

দৌলতাবাদ ও খুলদাবাদের নিকটবর্তী হওয়ায় এবং ঘৃষ্ণেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের অবস্থিতির কারণে, অতীতে ইলোরা গ্রাম নিজামশাহ রাজ্যে খুব পবিত্র ও বর্ধিষ্ণু অঞ্চল বলে স্বীকৃত ছিল। ইলোরা গুহা মন্দির থেকে মাত্র দু-কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঘৃষ্ণেশ্বর মন্দিরের বর্তমান রূপ রানী অহল্যাবাই হোলকারের দান। অষ্টাদশ শতাব্দীতে, সম্ভবত একই জায়গায় তাঁর আর্থিক অনুদানেই বর্তমান মন্দিরের পুনর্নবীকরণ করা হয় এবং ঘৃষ্ণেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির শিখরে ভূমিজ শৈলী তাঁর উৎসাহে সচেতনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।ভূমিজ শব্দের অর্থ ভূমি থেকে জাত। স্টেলা ক্র্যামরিশ ভূমিজ শৈলীর মন্দিরকে বলেছিলেন ‘Earth born’ ও ‘Country born’ মন্দির। ভূমিজ শৈলী কোনো ধর্মের কথা বলে না, কোনো ধার্মিক অনুশাসনের দ্বারা এই শৈলী গড়ে ওঠেনি। এই শৈলী সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কথাই বলে, তাই নাম ভূমিজ।

ইলোরা গুহামন্দির ও পাহাড়ের নিচে,উঁচুনিচু যে বিস্তৃত মালভুমি দেখতে পাওয়া যায়,অতীতে মুসলিমদের কাছে সেই জমি বরকত অর্থাৎ পবিত্র বা সৌভাগ্যের অঞ্চল বলে পরিচিত ছিল। ইলোরা গুহামন্দির থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে ওই মালভূমিতে অবস্থিত খুলদাবাদে, সুফি সাধক শাহ মুন্তাজাবউদ্দিন বখসের (চোদ্দোশো

শতাব্দীর শেষের দিকে তাঁর মৃত্যু হয়) মকবরা ছাড়াও মালিক অম্বরের (১৫৪৮-১৬২৬) মকবরা অবস্থিত। 

১৬০০ সাল থেকে মালিক অম্বরের অভিভাবকত্বে নিজামশাহদের দ্বিতীয়ভাগের পথচলা শুরু হয়েছিল। ১৬২৪ সালে ভাটওয়াদীর যুদ্ধে মালিক অম্বরের গরিলা কৌশলের কাছে মুঘল ও আদিলশাহীদের মিত্র ফৌজ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। যুদ্ধে মালিক অম্বরের জয় হয়। সেই যুদ্ধে শিবাজীর পিতা শাহজী ভোঁসলে মালিক অম্বরকে সমর্থন করেছিলেন। বর্তমানে মহারাষ্ট্র রাজ্যের আহমদনগর শহর থেকে মাত্র আঠারো কিলোমিটার দূরে ভাটোদি পারগাঁও গ্রামই হলো অতীতের ভাটওয়াদী।প্রাঙ্গনচত্বরে মালিক অম্বরের মকবরার পাশের সৌধেই সমাহিত আছেন তাঁর বেগম বিবি করিমা। খুলদাবাদে, সুফি সাধক শাহ মুন্তাজাবউদ্দিন বখসের দরগার পাশে যেমন মালিক অম্বরের মকবরাটি অবস্থিত তেমনই চিস্তী সুফী শেখ জৈনুদ্দিন সিরাজীর পাশে খোলা আকাশের নিচে মুঘল সম্রাট আলমগীর আওরঙ্গজেবের (১৬১৮-১৭০৭) মাজারটি (সম্মানিত ব্যক্তির কবর বা জিয়ারতের স্থান) অবস্থিত। ইলোরা গুহা মন্দির থেকে দক্ষিণদিকে যেখানে সড়কপথে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মাজারের দূরত্ব মাত্র সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার সেখানে ইলোরা গুহা মন্দিরের উত্তরদিকে মালিক অম্বরের মকবরার দূরত্ব সাড়ে চার কিলোমিটার এবং পশ্চিমদিকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে ঘৃষ্ণেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরটি অবস্থিত।

রানী অহল্যাবাঈয়ের হাতে সংস্কার হওয়ার আগে আদি ঘৃষ্ণেশ্বর মন্দিরের বিধিসম্মত পৃষ্ঠপোষকতা ভোঁসলে পরিবারের হাতেই ছিল, মনে করা হয়, ১৬০৬ সালে মালোজী ভোঁসলে এই মন্দিরটি তৈরী করেছিলেন। আজও মন্দিরের চারপাশে তাঁদের পারিবারিক ছত্রী বা স্মৃতিসৌধ দেখতে পাওয়া যায়। যেভাবে মুসলিম সমাজে পুণ্যাত্মা দরবেশের দরগার চারপাশে মুরিদদের কবর ছড়িয়ে থাকে তেমনই ঘৃষ্ণেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের চারপাশে ভোঁসলেদের পারিবারিক ছত্রী ছড়িয়ে আছে। ঘৃষ্ণেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের চারপাশে তিনটি সমাধিসৌধ দেখতে পাওয়া যায়। ঘৃষ্ণেশ্বর মন্দিরের দক্ষিণদিকে অবস্থিত সমাধিসৌধটি শিবাজীর পিতামহ মালোজী ভোঁসলের হলেও  

উত্তরদিকের মকবরাটি কার তা সনাক্ত করা যায়-না। যদিও ঐ মকবরায় কোনো সৌন্দখ চোখে পড়ে না। আবার ঘৃষ্ণেশ্বর মন্দিরের পশ্চিমদিকে অবস্থিত মকবরায় সৌন্দখ দেখতে পাওয়া গেলেও মকবরাটি কার স্মৃতিতে তৈরী করা হয়েছিল, তা নিশ্চিত করে বলা যায়-না। যদিও খুলদাবাদে মালিক অম্বরের মকবরা ও ঘৃষ্ণেশ্বর মন্দির সংলগ্ন তিনটি স্মৃতিসৌধের স্থাপত্যে আদিলশাহী শৈলী ভীষণ আকর্ষনীয়।

প্রথম বুরহান নিজামশাহের (১৫১০-৫৩) আমলে গুজরাট থেকে সুফী সাধক, শাহ শরীফ (১৫২৬- ১৬১৭) আহমদনগর শহরে এসে তাঁর খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। জানা যায়, মালোজী ভোঁসলের কোনো সন্তান ছিল না, শাহ শরীফের আশীর্বাদে তাঁর দুই পুত্র সন্তান হয়। খুশি হয়ে মালোজী ভোঁসলে শাহ শরীফের নাম থেকে তাঁর দুই পুত্রের নাম রাখেন শাহজী ও শরীফজী। আহমদনগর বাস স্ট্যান্ড থেকে শাহ শরীফের দরগার দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার, স্থানীয়ভাবে দরগা দরিয়া নামে পরিচিত। ঘৃষ্ণেশ্বর মন্দিরের পাশে ওই অপরিচিত মকবরা দুটি শাহ শরীফের বংশধরদের হয়ে থাকতে পারে, যা মালোজী ভোঁসলের আদেশেই হয়তো-বা তৈরী করা হয়েছিল। সুফী সাধক বা তাঁর বংশধরদের মকবরার পাশে নিজের সমাধিসৌধ তৈরী করা মুসলিম শাসকদের কাছে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করা হতো। ভেরুল (ইলোরা) গ্রামে হয়তো সেই কারণেই মালোজী ভোঁসলের স্মৃতিসৌধ ওই দুই মকবরার পাশে তৈরী করা হয়।

মহারাষ্ট্র রাজ্যে ঔরঙ্গাবাদ শহরের পূর্বদিকে সড়কপথে নব্বই কিলোমিটার দূরে, বুলধানা জেলায় সিন্দখেদ রাজা গঞ্জটি অবস্থিত। ১৪৫০ সালে সুলতান দ্বিতীয় আহমদ বাহমনির আমলে সিন্দখেদ পরগনার শাসনভার স্থানীয় এক কাজীর হাতে ছিল। ১৫৫০ সালে নিজামশাহ সুলতানদের কাছ থেকে শিবাজীর মাতামহ রাজা লাখুজি রাও যাদব চিরস্থায়ী অনুদান হিসাবে সিন্দখেদ অঞ্চলের জায়গীর এবং রাও খেতাব ইনাম পান।ভোঁসলেদের মতোই নিজামশাহ দরবারে মারাঠা যাদব রাও পরিবার বংশানুক্রমে প্রশাসনের উচ্চপদে আসীন ছিলেন। নিজামশাহ রাজ্যে স্থানীয়ভাবে মারাঠা জায়গীরদাররা নিজেদের স্থানীয় রাজা ভাবতেন,রাও যাদবরাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন-না।সিন্দখেদ পরগনার শাসক হয়ে,ওই বছরেই তাঁরা সিন্দখেদে দুর্গের আকারে সুরক্ষা প্রাচীরে ঘেরা একটি প্রাসাদ তৈরী করেন।প্রাসাদটি শিবাজীর মা জিজাবাঈয়ের জন্মস্থান হিসাবে স্থানীয়ভাবে ‘জিজৌ’র শ্রুস্থি’ বলে পরিচিত।জানা যায়, শিবাজীর পিতা শাহজী খুব সুপুরুষ ছিলেন এবং ছোট বয়েস থেকেই তিনি লাখুজি রাও যাদবের খুব প্রিয় ছিলেন। কন্যা জিজাবাঈয়ের সাথে শাহজীর বিবাহ, লাখুজি রাও যাদবের ইচ্ছাতেই হয়েছিল।  

সিন্দখেদ শহরে পাথরের তৈরী রাজা লাখুজি রাও যাদবের প্রাসাদটি প্রতি দিকে বারো মিটার লম্বা এবং উপরে ইটের তৈরী গম্বুজ চোখে পড়ে।আবার দেয়ালের গায়ে যেমন কীর্তিমুখের ভাস্কর্য দেখতে পাওয়া যায় তেমনই দক্ষিণ ভারতের মুসলিম শাসকদের ঐতিহ্য মেনে প্রাণী মোটিফের ভাস্কর্যে হাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে সিংহের বিজয় মুহূর্তকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।প্রাসাদে ভারবহনকারী স্তম্ভ এবং ত্রিখিলান যুক্ত স্তম্ভপথে (বে) ডেকানের মুসলিম শাসকদের স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব স্পষ্ঠ।