উপাসনা কক্ষের দেয়ালচিত্র

সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিংয়ের কাজ শেষ করার প্রায় পঁচিশ বছর পর শিল্পী মিকেলাঞ্জোলো ফিরে এসেছিলেন ভ্যাটিকান সিটিতে। সৃষ্টি করেছিলেন ‘দ্য লাস্ট জাজমেন্ট’ (১৫৩৬-৪১), ফ্রেস্কো দেখে চমকে উঠলেন সকলেই। চারদিকে গেল গেল রব। কারণ ধর্মের দিকে তীর ছুঁড়েছেন শিল্পী। যীশুকে দাড়িহীন করে আদতে নাকি পেগান মিথোলজির ক্লাসিক স্টাইলে আঁকা হয়েছে। ফ্রেস্কোতে নগ্ন নর-নারীর ছবি দেখে পোপ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে, শিল্পী বলেছিলেন,
-উনি মানুষের মুক্তির চিন্তায় ব্যস্ত থাকলেই ভালো। শিল্পীর সৃষ্টি রহস্যের মর্মোদ্ধার করার বৃথা চেষ্টা, ওঁনার করার কোনও দরকার নেই।

উপাসনা কক্ষের দেয়ালচিত্রে ফুলদানি মোটিফ ও ফুলকারি নকশা

 
তেমনই পাকিস্তানের লাহোর শহরে ওয়াজির খান মসজিদ, পৃষ্ঠপোষক ও শিল্পীদের তাক্বিয়াহের (শুদ্ধ চরিত্রের) বহিঃপ্রকাশ ছিল, যেখানে প্রচলিত ইসলাম ধর্মমতের বিরোধী বিশ্বাস বড় ভূমিকা নিয়েছিল। শিল্পী মিকেলাঞ্জোলো’র ‘দ্য লাস্ট জাজমেন্ট’ ফ্রেস্কোর প্রায় একশো বছর পরে, ওয়াজির খান মসজিদের শিল্পীরা হয়ত বলতে চেয়েছিলেন,
-মহান আল্লাহ’র আত্মা সেই মহাসুমুদ্রের মতো, যেখানে সমস্ত বিক্ষুব্ধ আত্মা নদীর মতো প্রবাহিত হয়ে, এই মসজিদে এসে শান্তি লাভ করে।

ওয়াজির খান মসজিদে বহুবর্নে চিত্রিত রঙিন টালি (কুইরডা সেকা)

 
সম্ভবত তাঁরা আলিম সম্প্রদায়ের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করেই ওইসব নান্দনিক চিত্রকলার মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের পরস্পরবিরোধী ধার্মিক চিন্তার মধ্যে সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা করেছিলেন। মুঘল স্থাপত্যে ওয়াজির খান মসজিদ ইসলামিয় বারোক শৈলীর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এই মসজিদকে ইসলাম ধর্মের সিস্টিন চ্যাপেল বলা যেতে পারে।

ওয়াজির খান মসজিদের খিলান ছাদে ফ্রেস্কো

 
ব্রিটিশ চিত্রকর ও কবি এডওয়ার্ড লিয়র যেমন তাজমহল প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তেমনই ওয়াজির খান মসজিদ- চিত্রকলার এমন এক তীর্থস্থান, যেখান থেকে পৃথিবীর চিত্র রসিকদের দুটি ভাগে ভাগ করা যায়- একদল যাঁরা দেখেছেন আর একদল যাঁরা দেখেন-নি। যেন আকাশ ও মেঘের জমজমাট মজলিস-মেঘের ফাঁক-ফোকর থেকে ঠিকরে আসে আলো- যেন সেই মত্ত মজলিসেরই হালকা হাসি।
 
পৃথিবীতে তখন উজ্জ্বল দুপুর। ভেসে আসছে মসজিদ থেকে ধুহর নামাজের সুর আর তার সঙ্গে পায়ের শব্দ- সময়েরই বুঝি, এক আর্ত এবং বিষন্ন সময়ের পদধ্বনি। হঠাৎ হেঁকে উঠল হাওয়া -আচমকা এক তুমুল ঝড়। সঙ্গে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। আর তারপরেই আচমকা রোদ। ভিজে জল, চিকচিকে প্রাঙ্গণে রোদ, যেন ছড়িয়ে দিচ্ছে গোলাপের পাপড়ি। যে এক কবিতার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এ-যেন সেই কবিতা যে কেঁদে ওঠে মানুষের যে কোন দুঃখে, যে কোন অসুখে। খারাপ সময় এলে বান্দাকে বলে-এ পথে নয়, ভালোবাসা ওই পথে গেছে। কবিতা শুধু শব্দের মেলা নয়- ওয়াজির খান মসজিদের ইট পাথরের মতো, কবিতারও চোখ-মন-বিবেক আছে। তাইতো সে মসজিদ প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে হেলাল হাফিজের শব্দে বলে ওঠে,
তোমার বুকে বুক রেখেছি বলেই আমি পবিত্র আজ,
তোমার জলে স্নান করেছি বলেই আমি বিশুদ্ধ আজ‘।

উপাসনা কক্ষে যাওয়ার অলিন্দপথে ‘নবীর কেশ’ ছবির বিপরীত কুলুঙ্গিতে আরও একটি ফ্রেস্কো চোখে পড়ে। যেখানে বাম দিকের বার্চ গাছটিকে দেখলে মনে হয় একটি ঘোড়া তার মুখে খাদ্য থলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং গাছের কালো ও প্রশস্ত পাতা, ঘোড়ার টানা টানা চোখকে চিহ্নিত করছে। যদিও ছবিতে ঘোড়ার মুখের অংশটি বিবর্ণ এবং সমস্ত পর্ণরাজি ক্লান্তিতে নুয়ে পড়েছে। শিল্পী ঘোড়ার মুখকে গাছের কল্পনায়, খেয়ালি তসবিরের রূপ, সচেতনভাবেই দিয়েছিলেন। ছবিটি ইসলামি চিত্রকলার প্রচলিত ‘চিত্র ধাঁধা’র একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। শিল্পী তাঁর খেয়ালি ব্যঞ্জনায় যে ঘোড়াকে বার্চ গাছে রূপক অর্থে ফুটিয়ে তুলেছেন, সম্ভবত সেই অশ্ব হলো রসুলুল্লাহ মহানবী হজরত মুহাম্মদের ঘোড়া- বুরাক, যার পিঠে চড়ে তিনি জেরুসালেমের উদ্দেশ্যে নৈশ যাত্রা করেছিলেন।

ওয়াজির খান মসজিদে উপাসনা কক্ষে যাওয়ার অলিন্দপথে কুলুঙ্গির ফ্রেস্কোতে একটি গাছে কেশ গুচ্ছ পড়ে থাকতে দেখা যায়। ফ্রেস্কোটি চিত্রজগতে ‘নবীর কেশ’ নামে পরিচিত। রসুলুল্লাহ (আল্লাহ’র প্রেরিত নবী) যখন তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে তীর্থযাত্রার জন্য মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন, তিনি কেশ মুন্ডন করেছিলেন এবং একটি বাবলা গাছের ওপর ওই চুল ফেলা হয়েছিল। কোরান শরীফের অল ফাতিহা সুরাতে ওই ঘটনার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। সম্ভবত শিল্পী এই ফ্রেস্কোর মাধ্যমে পয়গম্বর নবী রসুলের ওই আখ্যান বর্ণনা করেছিলেন।

অলিন্দপথে ‘নবীর কেশ’ ছবির বিপরীত, অপর একটি কুলুঙ্গিতে আরও একটি ফ্রেস্কো দেখতে পাওয়া যায়। ছবিতে শিল্পীর বক্তব্যকে সনাক্ত করা বেশ কঠিন। ছবির কেন্দ্রীয় অংশে শক্তিশালী বিড়াল জাতীয় শ্বাপদ, সম্ভবত বাঘের অবয়বকে ওই খেয়ালি তসবিরে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যেখানে ছবির মধ্য অংশে ফুলদানির বাইরে ডান ও বাম দিকে নীলাভ টিউলিপ তার চোখকে চিহ্নিত করছে।