০১.

যশোর ধ্বংসকারী রাজা প্রতাপাদিত্য?

যশোর ধ্বংসকারী রাজা প্রতাপাদিত্য কিভাবে বারো ভুইাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং বৃহত্তর যশোরের যশ অর্জনকারী রাজা হলেন? একেবারে একজন লুন্ঠনকারী থেকে কিভাবে প্রতাপাদিত্য রাজা হলেন? রাজা প্রতাপাদিত্যর এই বিশেষ বিষয়গুলি মীমাংসা না করে একশ্রেণীর ঐতিহাসিকরা তাকে মহামান্য করে রাখছেন কোন সূত্র ধরে? নতুন প্রজন্মের কাছে দেখা দিয়েছে সেসব প্রশ্ন। আমাদেরকে যারা অন্ধকারে রেখেছে তাদেরও বিচার হওয়া প্রয়োজন। মহান একাত্তরের বিজয়ের স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত বাংলার ২৬ মার্চ প্রজন্ম কখনোই বিকৃত ইতিহাস বা কল্প কাহিনী মেনে নেবে না। আজকের বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা যশোর এক সময়কার বৃহত্তর যশোর জেলা নামে সুনামে এক অনন্য অতুলনীয় অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল। সেখানে ব্রিটিশ পিরিয়ডের বহু কীর্তিগাঁথা থাকলেও রাজা প্রতাপাদিত্যের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য কীর্তি, বিশেষ করে স্থাপত্য – ভবনাদী বা, যাকে বলা যায় রাজপ্রাসাদ বা, কাছারি বাড়ি বা, জমিদার বাড়ি বা, রাজবাড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি তার লেশ মাত্র নেই।

এটা কি করে সম্ভব হতে পারে? এবং কেন কিছু  নেই? যেখানে হাওর বাওর এর এলাকা কিশোরগঞ্জে যদি ঈসা খানের জঙ্গলবাড়ি বা তার নির্মাণাধীন বিভিন্ন ভবন থাকতে পারে, তারপরে সোনারগাঁওয়ে ঈসা খানের জমিদারবাড়ি থাকতে পারে; তাহলে উর্বরভূমি এবং উচ্চভূমি ও নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে মুক্ত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত যশোর জেলায় কেন সেরকম কিছু থাকলো না? এসবের অর্থ কি?

রাজা প্রতাপাদিত্য

রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ

তাহলে কি বুঝা যায়? শুধুমাত্র, সাতক্ষীরা অঞ্চলে কিছু মন্দির ভবন নির্মাণ করেছিলেন, যা “যশোরেশ্বরী মন্দির” নামে বিখ্যাত আর তাছাড়া মাগুরা জেলায় কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে পারে বলে ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন। কারণ, তিনি ওই দুই অঞ্চলের ক্ষেত্রে বিশ্বাস করতেন যে, সেখানে বেশি বেশি হিন্দুরা বাস করত। আরো জনশ্রুতি রয়েছে যে, তিনি আসলে ছিলেন একজন ভন্ড, প্রতারক, এবং লুন্ঠনকারী। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় যে, তাহলে কেন তাকে নিয়েই বাংলায় প্রথম নাটক “রাজা প্রতাপাদিত্য” রচিত হলো এবং তাকে কেন নায়ক হিসাবে দেখানো হলো?

আসলে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য আর ওই নাটকের প্রতাপাদিত্য কি একই ব্যক্তি? নাকি আলাদা?  “বৃহত্তর যশোর খুলনার ইতিহাস” গ্রন্থ রচয়িতা সতীশচন্দ্র মিত্র সাহেব কি বলেন;  চলুন – দেখে আসা যাক-

০২.

দাউদ খানের সম্পদ লুণ্ঠন করে পালিয়ে আসে প্রতাপাদিত্যের বাবা

সত্যিই কি দাউদ খানের সম্পদ লুণ্ঠন করে পালিয়ে আসেন প্রতাপাদিত্যের বাবা? ইতিহাসের পুনর্পাঠ যেরকম ঘটে, ঠিক সেরকমভাবে ইতিহাসে পুনরাবৃত্তি এবং রিভার্সও ঘটে এবং রূপান্তরের মাঠেও কিছুটা জল ঢোকে। ইতিহাসবিদ্যা নিয়ে যারা চর্চা করেন তারা এটা ভালোভাবেই জানেন। তাছাড়া বাঙালির চরিত্রে বৈপরিত্য ব্যাপারটা এমন একটা আচমকার বিষয় নয়; সেটা খুবই সাদামোটা ফ্যাক্টর। বর্তমানে পি কে হালদার, আরাভ খান সহ আরো অনেকের চেহারা দেখলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ইতিহাসের অলিগলিতে উদাহরণ খোঁজা লাগবে না।

ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের মতানুসারে জানা যায় যে, সমসাময়িককালে কোন হিন্দু ব্যক্তি রাজা প্রতাপাদিত্যকে নিয়ে কোন রচনা করেছেন বলে জানা যায় না। তবে মুসলমানদের গ্রন্থ থেকে কিছুটা জানা যায়। এছাড়া পর্তুগীজ নাবিকের বিবরণী ও পারস্য ভাষার বা, ফারসি ভাষার একটি গ্রন্থে তার সম্বন্ধে কিছু বলা রয়েছে বলে অনেক ধারনা দিয়েছেন।

অবশ্য একশো-দুইশো বছর পরে ২/৩ জনের মতো  হিন্দু কবিগণ তাকে নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রামরাম বসু এবং কবি ভরতচন্দ্র রায় গুনাকর। রামরাম বসু রচিত ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ গ্রন্থে রাজা প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে বিস্তারিত রয়েছে।  আরো পরে নিখিলনাথ রায় মহাশয় প্রতাপাদিত্য জীবনি রচনা করেন। কিন্তু আশ্চার্যের বিষয় হলো এই যে, প্রতাপাদিত্যের মতো লুন্ঠনকারী –দস্যুকে নিয়ে কেন এতা মাতামাতি? স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৪/৫ বার তাকে নিয়ে রচনা করেছেন  নাটক, উপন্যাস প্রভূতি। কিন্তু কেন???এতো উৎসাহ ও ফুরসত তিনি পেলেন কোথায়?

রাজা প্রতাপাদিত্য

যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ।

চলুন জেনে আসা যাক সেই ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনা থেকে –

১৯০৩ সালে রবীন্দ্রনাথের বড় বোন স্বর্ণকুমারী দেবীর ও জানকীনাথ ঘোষালের মেয়ে সরলাদেবী চৌধুরানী ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’ সূচনা করেন। সাহিত্যিক মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় দ্বারা পরিচালিত একটি সাহিত্য সভা ছিল। সেটাকে সরলাদেবী দেশাত্মবোধক ও বীরত্বব্যঞ্জক রূপ দিতে ‘প্রতাপাদিত্য উৎসবের’ সূচনা করেন। তার যুক্তি ছিল যে,

মহারাষ্ট্রের ছত্রপতি শিবাজীকে কেন এত মহারাজা, সম্রাট উপাধি দিয়ে পুরো ভারত রাজ্যে জনগণ হৈ হৈ করবে? ভারতের রাজধানী তখন কলকাতা। রাজধানী কলকাতা হলো বাংলা ও বাঙালির।  বাঙালি মানুষের বসবাস যেখানে, সেখানে কেন মারাঠাকে বীর বানাতে হবে? তাই বাংলার রাজা নিয়ে উচ্ছ্বাস করতে হবে। বাংলার কি কোন হিন্দু রাজা, মহারাজা নেই? তখন সরলা দেবী চিন্তা করলেন, বাংলার রাজা কে আছেন? খুজে বের করতেই হবে। এমনকি তার লেখা মারাঠা প্রবন্ধে তাদের বিষয়ে অসূয়া ভাব দেখা যায় এবং তিনি বেশ ঈর্ষাও প্রকাশ করেন। তার জানাশোনার মধ্যে প্রথমেই আসলো যশোর খুলনা অঞ্চলের রাজা প্রতাপাদিত্যের নাম। কারণ রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি খুলনা আর তার পিতা মহোদয়ের আদিবাড়ি যশোর। তারা ছিলেন কুশারী বংশের। হঠাৎ করে কলকাতায় ঘাটি বেঁধে এবং ইংরেজের দালালি করে বহু সম্পদের মালিক বনে যান। এখন তো তাদের অনেক বড় বড় কিছু করে দেখাতে হবে। তাই তখন তারা বাংলার প্রতাপাদিত্যকে রাজা ভূষিত করে উৎসব শুরু করলেন। তারা বললেন কেন আমরা প্রতাপাদিত্যকে ‘বাংলার শিবাজী’ বলবো? বরং, শিবাজীকে বলব ‘মহারাষ্ট্রের প্রতাপ’; তবে আরেকটি প্রশ্ন দেখা দেয়, তা হলো প্রতাপের মত কী শিবাজিও লুঠেরা ছিলেন?; এইভাবে শুরু হয় প্রতাপাদিত্যের বন্দনা। সেখানে রবীন্দ্রনাথও যুক্ত হন। শুরু করেন প্রতাপাদিত্যেকে নিয়ে ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাস। ঘুরে যায় ইতিহাসের পাতা।

এবার তাহলে ফিরে যায় – কীভাবে দাউদ খানের সম্পদ লুণ্ঠন করে পালিয়ে আসেন প্রতাপাদিত্যের বাবা? এবং তারপরে কীভাবে তার ছেলে বনে যান মহারাজা প্রতাপাদিত্য। সতীশ চন্দ্র মিত্রের লেখা “যশোর-খুলনার ইতিহাস”, বই থেকে জানা যায়, প্রতাপাদিত্যের বাবা শ্রীহরি বাংলার আফগান শাসক দাউদ খান কররানির অধীনে একজন প্রভাবশালী ও বিশ্বস্ত রাজকর্মচারী ছিলেন। পরে তাঁর কাছ থেকে মৃত চাঁদ খানের জমিদারি ও ‘বিক্রমাদিত্য’ উপাধি লাভ করেন।

দাউদ খান কররানী (১৫৭৩-১৫৭৬) ছিলেন বাংলার সর্বশেষ স্বাধীন সুলতান। তিনি বায়েজীদ কররানীর কনিষ্ঠ ভাই। হানসুর ষড়যন্ত্রে বায়েজীদ কররানী মারা গেলে সুলায়মান কররানীর বিশ্বস্ত পারিষদবর্গের সমর্থনে তিনি বাংলার সিংহাসনে বসেন। তিনি তাঁর ভাইয়ের স্বাধীন নীতি বজায় রেখেছিলেন। তিনি নিজ নামে খুতবা পাঠ এবং মুদ্রা প্রচলন করেন।

রাজা প্রতাপাদিত্য

রাজা প্রতাপাদিত্যর হাফসি খানা। শাস্তিস্বরূপ মানুষকে জবাই করা হত।

পরবর্তীতে, দাউদ খানের পতন হলে শ্রীহরি বিপুল সংখ্যক সরকারি সম্পদের মালিক হয়ে যান। আসলে মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাবাহিনীর আক্রমনের খবরে দাইদ খান যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে  বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় দুজনে মিলে তাদের কোষাগারের যাবতীয় ধন-সম্পদ ও বিপুল সোনা নিরাপদ স্থানে রাখার কথা বলে জাহাজে করে সমস্ত অর্থকড়ি যশোর এলাকায় চলে আসেন। কেই কেই বলছেন, তারা ছিলেন কোয়াগারের দায়িত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী সমপর্যায়ের। যেকারণে, দাউদ খানের মারা যাবার সংবাদ শোনার সাথে সাথেই তারা সম্পদগুলো লুঠ করে যশোর এলাকায় চলে আসেন। এখন যশোরের রাজধানী ছিল ধুমঘাট, সে হিসেবে সেখানে আনেন না কোথায় আনেন , তা নিয়ে আরেকটি লেখা যেতে পারে। মতান্তরে, ১৫৭৪ সালে খুলনা জেলার বাওর এলাকায় গিয়ে নিজেকে ‘মহারাজা বিক্রমাদিত্য’ হিসেবে ঘোষণা করেন প্রতাপাদিত্যের বাবা শ্রীহরি।

বৈষ্ণব মতে শ্রীহরির আর এক নাম ছিল গোপীনাথ। ১৫৬১ সালে তার ছেলে জন্ম লাভ করে। ছেলের নাম রাখেন প্রতাপ গোপীনাথ। সেই পরে ‘ রাজা প্রতাপাদিত্য’ নামে খ্যাতি পান। উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে শুরু করে, বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, যশোর ও নড়াইল পর্যন্ত বিস্তৃত রাজ্যে প্রবল প্রতাপে প্রায় ২৫ বছর রাজত্ব করেন প্রতাপাদিত্য। ধূমঘাটে ছিল তার রাজধানী। একটি সূত্র জানাচ্ছে যে, ধূমঘাটই পরে যশোহর নামে পরিচিত হয়। লোকশ্রুতি আছে যে, গৌড়ের যশ হরণ করে এনে যশোর রাজ্যের উত্থান বলে যশোহর নামকরণ হয়ে যায়। মির্জা নাথানের “বাহারিস্তান-ই –গায়বি” ও “যশোর-খুলনার ইতিহাস”, বই থেকে স্পষ্ঠ প্রমাণিত হয় যে, সত্যিই দাউদ খানের সম্পদ লুণ্ঠন করে পালিয়ে আসেন প্রতাপাদিত্যের বাবা শ্রীহরি।

০৩.

রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রতাপ বিলীন হল দুইবারের পরাজয়ে

যে কথা কেউ বলে না, অথবা, লুকিয়ে চলে যায়, তা একদিন ঠিকই প্রকাশ পায় সময়ের পরিক্রমায়। সেভাবেই রাজা প্রতাপাদিত্যের বর্ম ও প্রতাপ নিঃশেষে বিলীন হয়ে যায়। যা বহুবার প্রতারণার আশ্রয় নিয়েও এবং চুক্তি ও সন্ধি করলেও তা ভঙ্গ করেও শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাননি ধুরন্ধর এই প্রতাপাদিত্য। লুঠেরা বাবার জিনগত বৈশিষ্ঠ্য নিয়ে বেড়ে ওঠা প্রতাপ কয়েকবার বিশ্বাসঘাতকতা করেন সুবেদার ইসলাম খানের সাথে এবং তার সেনা বাহিনীর হাতে দুই দুইবার পরাজিতও হন। কোনভাবেই রক্ষা পাননি তিনি।

আসলে বাংলার সাথে মুঘলদের সেই সময়কার সম্পর্ক কি ছিল; তারপরে সুবা বাংলার রাজধানী বা প্রধান শহর বন্দর কি ছিল তখন; তাছাড়া যশোর বারো ভুঁইয়াদের অঞ্চলের মধ্যে কতটুকু উল্লেখযোগ্য ছিল? এরকমভাবে নানান দিক থেকে বিচার-বিশ্লেষন না করলে, আমরা যে সময়ের গল্প বলছি সেই সময়ের অরিজিনাল বিষয়বস্তুর উপর আমরা সঠিক মূল্যায়ন করতে পারবো না। সেকালের পারিপার্শ্বিক দিক দিয়েই সবকিছু বিচার ব্যাখ্যা করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

আপনারা সকলেই জানেন যে সেসময় মুঘল সম্রাট ছিলেন – মহামতি সম্রাট আকবর দ্যা গ্রেট এবং বাদশাহ জাহাঙ্গীর। সম্রাট আকবরের শাসনকাল ছিল ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ সাল পর্যন্ত। আর মুঘল সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট বিশ্ববিজয়ী বাদশাহ জাহাঙ্গীর ১৬০৫ সাল থেকে মৃত্যু অবধি ১৬২৭ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন।

অন্যদিকে ১৫৮৪ সালে প্রতাপাদিত্য যশোর রাজ্যে তার বাবার উত্তরাধিকারী হন মাত্র। ১৬১০-১১ সাল পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেন। তিনি ধুমঘাটে একটি তৈরি করে , সেখানে যশোরের রাজধানী করেন। তারপর শুরু হয় মুঘলদের সাথে তার দ্বন্ধ – সংঘাত।

রাজা প্রতাপাদিত্য

যশোরেশ্বরী কালী মন্দির

কিন্তু, শত চেষ্টা স্বত্তেও রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রতাপ বিলীন হয়ে গেলোদুই দুইবারের পরাজয়ে। সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর সেলিম নুরুদ্দীন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন দিল্লীতে। বহু দূরের সুবাহ বাংলা থেকে তাঁর কাছে প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ যেতে থাকে। প্রথমে জাহাঙ্গীর প্রতাপকে দমন করতে তার সেনাপতি মানসিংহকে পাঠান। ১৬০৩ সালে বিশাল বাহিনীসহ যশোরের দিকে যাত্রা করেন মানসিংহ। প্রকৃতি বিরূপ হলেও ভবানন্দ মজুমদার নামে এক জমিদার সব রকম সাহায্য করায় মান সিংহ ধূমঘাট দুর্গ আক্রমণ করতে সমর্থ হন। অবশ্য এর আগে সুন্দরবনের পরিবেশ প্রতাপকে মুঘল আক্রমণ থেকে বাঁচতে ও প্রতিহত করতে যথেষ্ট সুবিধা দিয়েছিল। উড়িষ্যাভিযানে বীরত্বের জন্য মানসিংহ প্রতাপকে খুব পছন্দই করতেন; যশোর যুদ্ধেও তাঁর রণকুশলতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাই মুঘলরা যুদ্ধে জয়ী হয়েও প্রতাপাদিত্যকে বন্দী করলেও শেষে সন্ধি করলেন। চুক্তি অনুযায়ী যশোর রাজ্যের দশ আনার শাসক ও মুঘল অধীনস্থ সামন্ত রাজা হিসাবে প্রতাপাদিত্য স্বীকৃতি পান।

সম্পর্কের উন্নতির জন্য ১৬০৮ সালে প্রতাপাদিত্য মুঘল সুবাদার ইসলাম খানের কাছে প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে প্রতিনিধি হিসাবে পুত্র সংগ্রামাদিত্যকে পাঠান। কিন্তু ইসলাম খান প্রতাপাদিত্যকে হাজির হওয়ার শর্ত দিয়ে রাজপুত্রকে আটকে রাখেন। বাধ্য হয়ে ১৬০৯ সালে প্রতাপাদিত্যকে আত্রাই নদীর তীরে সুবাদার ইসলাম খানের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। নিজে ও পুত্র সংগ্রামাদিত্য পাঠান মুসা খানের বিরুদ্ধে মুঘলদের পক্ষ থেকে অভিযান চালাবেন – এই শর্তে দ্বিতীয়বার প্রতাপাদিত্য মুক্ত হন। কিন্তু সেই কথা না রেখে প্রতারণার আশ্রয় নিলে; মুঘলদের সঙ্গে তিনি পুনরায় সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন।

কারণ, ১৬১২ সালের ঘাগরাঘাটের যুদ্ধে মোঘল সেনাবাহনীর আক্রমনে বিধস্ত প্রতাপ সেনাপতি গিয়াসউদ্দিনের হাতে আত্নসমর্পন করেন। যদিও তিনি নানা ফন্দি-ফিকির করে সন্ধি করে বাঁচার উপায় খুঁজতেছিলেন। কিন্তু মুঘলদের সাথে অনেকবার প্রতারণা করার কারণে এবং প্রতারক জমিদার প্রতাপ হিসেবে খ্যাত প্রতাপাদিত্যের সাথে এবার আর কোন চুক্তিতে না গিয়ে মুঘল বাহিনী সরাসরি তাকে আটক করে ঢাকা প্রেরণ করে এবং তারপরে দিল্লীর সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে পাঠানোর সময় বেনারসে তার মৃত্যু হয় বলে জানা যায়। তার শেষ জীবনের বিষয়ে তেমন প্রামান্য কোন দলিল পাওয়া যায় না।

যাইহোক, তখন বাংলা ছিল মোঘলদের অধীনে একটি সুবাহ মাত্র। সহজ বাংলায় বলা যেতে পারে মুঘল সাম্রাজ্যের একটি মহকুমা। যা ১৬শ থেকে ১৭শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে বর্তমানের বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওড়িশা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ভারতে ও বাংলায় সুলতানদের শাসন ভেঙ্গে গেলে এই সাম্রাজ্যের উদ্ভব হয়। সুবাহ বাংলার রাজধানী ছিল জাহাঙ্গীরনগর অর্থাৎ ঢাকা, এবং তারপরে রাজমহল। এজন্য সোনরগাঁও থেকে সাভার পর্যন্ত ঈসা খান ও মুসা খানের সেসময়ের অনেক কীর্তিই আমরা দেখতে পাই ।

বাংলায় পাঠান কর্‌রানী রাজত্ব দূর্বল হয়ে পড়লে, ক্ষমতার পালাবদলও শুরু হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকার জমিদাররা স্বাধীনভাবে শাসন করতে শুরু করে। এখনকার বাংলাদেশের সোনারগাঁও, খুলনা, বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলে কিছু সংখ্যক জমিদার স্বাধীন রাজার মতো নিজ শাসন চালাতে থাকেন। অন্যদিকে, সম্রাট আকবর ১৫৭৫ সালে বাংলা দখল করার পর এসকল জমিদার ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোগল সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নেন এবং করেন। এরাই বাংরার ‘বারো ভুঁইয়া’ নামে পরিচিত। ‘বারো ভুঁইয়া’ নামে পরিচিত জমিদাররা হলেন: ১. ঈশা খাঁ – সোনারগাঁও; ২. ঈশা খাঁ লোহানী ও উসমান খাঁ লোহানীঃ – উড়িষ্যা ও হিজলী; ৩. ফজল গাজী – ভাওয়াল ও চাঁদপ্রতাপ; ৪. প্রতাপাদিত্য – যশোর; ৫. চাঁদ রায় ও কেদার রায় – শ্রীপুর বা বিক্রমপুর; ৬. রাজা রাজবল্লভ সেন,কন্দর্প রায়  ও রামচন্দ্ররায় – বাক‌লা বা চন্দ্রদ্বীপ; ৭. লক্ষ্মণমাণিক্য – ভুলুয়া; ৮. মুকুন্দরাম রায় – ভূষণা বা ফতেহাবাদ; ৯. কংসনারায়ন রায় – তাহিরপুর।

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে ঈশা খাঁ কেন জাতীয় বীর হলো না? শুধু কি মুসলিম বলে?

কিন্তু যে পরের ধনে পোদ্দারি করে গেল এবং পরাজিতই শুধু হল না; পুরো যশোরের সমস্ত ধন-সম্পদ হারালো এবং যশোরকে অবহেলিত একটি রাজ্যে পরিণত করলো যে প্রতাপাদিত্য সে কি করে বীরের সম্মান পেল? এ কেমন ধরনের প্রোপাগান্ডা!!! – – একবার চিন্তা করুন!!!

 

তথ্যসূত্র:

Khan, Muazzam Hussain (২০১২), “Pratapaditya, Raja”, Islam, Sirajul; Jamal, Ahmed A. (Edt.), Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh, Asiatic Society of Bangladesh.

যশোর-খুলনার ইতিহাস, সতীশ চন্দ্র মিত্র, ২০১১, লেখক সমবায়, বাংলাজার, ঢাকা.

বাহারিস্তান-ই-গায়বী, মির্জা নাথান।

উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য অন্তর্জাল সমূহ।