পরনে বিশেষ সূক্ষ্ম সুতায় তৈরী ধবধবে সাদা পোশাক, যা পরিধানের অধিকার রাজপরিবারের আর কারো নেই। মৃত্যুর পর সমাধিতে শায়িত থেকেও তিনি সবার চেয়ে আলাদা। এ যেনো শ্বেতশুভ্র বসনে চন্দ্রদেবী! ‘ভালচার্ড ক্রাউন’ বা ‘শকুনি শিরস্ত্রাণ’ তো একমাত্র দেবীরই আবাসন! এই শিরস্ত্রাণই সাক্ষ্য দেয়, মর্ত্যলোকে ফারাও ছিলেন দেবতা এবং তার স্ত্রী ছিলেন দেবী।
মিশরের সবচেয়ে বিতর্কিত ও শক্তিশালী সম্রাট দ্বিতীয় রামেসিস শেষ বিদায় জানাচ্ছেন প্রিয়তমা স্ত্রী নেফারতারিকে। শুভ্র দেবীকে নিজ হাতে তুলে দিলেন নৌকাসমাধিতে। তার অশ্রু যেনো আজ বাঁধই মানছে না। যেনো এই বিরহ কিছুতেই সইতে পারছেন না ফারাও। এতো টান কি তিনি আর কখনো অনুভব করেছেন?
প্রেমের নিদর্শন বলতে সবার আগে আমাদের মনে তাজমহলের কথাই চলে আসে। তবে ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের নির্মিত আবু সিম্বেলের নেফারতারির মন্দিরটি কি কোনো প্রেমের নিদর্শন থেকে কম কিছু ছিলো? একদমই নয়, বরং স্ত্রীর প্রতি ফারাও এর সেই অনুভূতি ও প্রবল টান ছিলো আরও অনেক তাৎপর্যপূর্ণ।
নেফারতারি দ্বিতীয় রামেসিসের অসংখ্য স্ত্রীর মধ্যে ছিলেন প্রধান, পেয়েছিলেন রাজকীয় স্ত্রীর মর্যাদা ও স্বামীর গভীর ভালোবাসা। বিভিন্ন সময় ভালোবেসে ‘লেডি অফ গ্রেইস’, ‘লেডি অফ অল ল্যান্ডস’ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে ডাকতেন তাকে রামেসিস। স্ত্রীর জন্য নির্মিত মন্দিরে রামেসিস লিখেছিলেন ‘তার জন্যই সূর্য উদিত হয়’। খুব কম রাণীর ভাগ্যেই সম্রাটের এমন প্রেম মিলেছে।
দ্বিতীয় রামেসিসের মতো কঠোর সম্রাট খুব কমই ছিলেন। তবে এই কঠোরতম ব্যক্তিকে বশ করার ক্ষমতা একমাত্র তার স্ত্রী নেফারতারিরই ছিলো, যা তার অতুলনীয় দক্ষতা ও যোগ্যতারই পরিচায়ক। তার পরিহিত সামগ্রী, মাথার বিশেষ মুকুট একজন ফ্যাশন আইকন হিসেবে তাকে বিশেষ করে তোলে।
রামেসিস তার মন্দিরে নিজের মূর্তির সমান উচ্চতায় নেফারতারির মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। প্রিয় স্ত্রীকে সমমর্যাদা প্রকাশের এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর হতে পারে না। নেফারতারিও অসীম যোগ্যতাবলেই অর্জন করে নিয়েছিলেন স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্ত সম্মান।
কো-রিজেন্ট বা সহশাসক হিসেবে স্বামীর সঙ্গে মিশর শাসন করেছেন নেফারতারি। রামেসিস যখন যুদ্ধে যেতেন তখন তার অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনাসহ রাজ্যের সমস্ত দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করেছেন এই নারী। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন যুদ্ধেও তার অবদান ছিলো। হিট্টাইটদের বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধেও তিনি শুরু থেকেই স্বামীর পাশে ছিলেন এবং পরবর্তীতে দীর্ঘ এই বিরোধে শান্তি আনয়নের ক্ষেত্রেও দক্ষ কূটনীতিবিদের ভূমিকা তিনি পালন করেছিলেন।
হিট্টাইট রাণী পুদুহেপার সঙ্গে আন্তরিক পত্রালাপের মাধ্যমে উভয় পক্ষের মধ্যে শান্তি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার সফল প্রয়াস করেছিলেন নেফারতারি। মিষ্টি ভাষায় লেখা স্নেহপূর্ণ চিঠিগুলো নিশ্চয়ই হিট্টাইট রাণীর মনকেও ছুঁয়ে দিয়েছিলো। এই চিঠিপত্র আদান-প্রদানের মাধ্যমে হিট্টাইট রাণীর সাথে বন্ধুত্ব তো গড়েছিলেনই, সেই সাথে সন্ধি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নিজের স্বামীর জন্য নতুন স্ত্রী হিসেবে হিট্টাইট রাজকন্যাকে মনোনীত করেও যোগ্যতার সাথে তিনি রাষ্ট্রের সবচেয়ে নিবেদিত কূটনীতিবিদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
অপরূপ সুন্দরী এই রাণীর মেধা ও বুদ্ধির কারণে দুটি রাষ্ট্র সম্ভাব্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলো। তার কূটনৈতিক যোগ্যতার বলে সুদূর গ্রীসের ক্রীট অঞ্চল থেকেও তার জন্য উপহার আসতো। বহু ছবিতে দেখা যায়, ক্রীটের রাণীর দেয়া কানের দুল পরিহিতা নেফারতারিকে। দুলটি তার অত্যন্ত পছন্দের ছিলো। মৃত্যুর আগে হয়তো নিজের মেয়েকে তিনি দুলটি দিয়ে গিয়েছিলেন, যে কারণে পরবর্তীতে তার মেয়ের কানেও শোভা পেয়েছে সেই দুল।
নেফারতারি ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত ও বহু ভাষায় দক্ষ। হায়ারোগ্লিফিক লিপি লেখা ও পড়ার দক্ষতা তার ছিলো অসাধারণ, যা সে সময় যে কারো ক্ষেত্রে ভীষণ বিরল এক যোগ্যতা। ভীষণ মার্জিত ছিলো তার রুচি, যা তাকে বিশেষ করে তোলে। হয়তো এ কারণেই মিশরের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সম্রাটের মন কেড়ে নিয়েছিলেন এই নারী। সম্রাটের অধীনে অসংখ্য লেখক নিযুক্ত থাকলেও নেফারতারি নিজে থেকেই বিভিন্ন জিনিস লিখে রাখতে পছন্দ করতেন। আর এ ব্যাপারে তার দক্ষতাও ছিলো সবার চেয়ে আলাদা। যোগ্য তো তিনি আগে থেকেই ছিলেন, তবে রাজকীয় স্ত্রী হবার পর তার যোগ্যতাকে আরো বাড়িয়ে তুলবার দায়িত্ব স্বয়ং রামেসিসের মা নিয়েছিলেন। তিনি নিজের তত্ত্বাবধানে নেফারতারিকে বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী করে তোলেন।
নেফারতারির প্রতি দ্বিতীয় রামেসিসের গভীর অনুভূতির প্রমাণ নেফারতারির সমাধি থেকেই পাওয়া যায়। বিভিন্ন দেয়ালচিত্রগুলোতে স্পষ্ট যে, সম্রাট তার স্ত্রীকে দেবীর সম্মান দিয়েছিলেন। এ যেনো এক অর্থপূর্ণ আবেগেরই বহিঃপ্রকাশ। নেফারতারি যেনো রামেসিসের জন্য জলজ্যান্ত এক বিজয়-মুকুট ছিলেন।
নেফারতারি অর্জন করেছিলেন মন্দিরের পৌরোহিত্যের ক্ষমতাও। দেবতাকে খাবার ও তেল নিবেদনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার অধিকারও তিনি অর্জন করেছিলেন, যা ছিলো রাণীর জন্য সর্বোচ্চ ও শ্রেষ্ঠ সম্মান।
সম্রাটকে নিয়মিতভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরামর্শ দেয়ার অধিকার তার ছিলো এবং সম্রাট তো স্ত্রীর প্রতি এক প্রকার বাধ্য ছিলেন বলা চলে। নেফারতারির সৌন্দর্যে মুগ্ধ রামেসিস সুযোগ পেলেই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে স্ত্রীর প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশ করতেন।
নেফারতারি ছিলেন রামেসিসের একদম প্রথম দিককার স্ত্রী। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে নেফারতারির সাথে তার পরিচয় ও পরিণয়। বিয়েটা কূটনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য হলেও নেফারতারিকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন দ্বিতীয় রামেসিস। প্রথম দেখাতেই চোখে চোখে প্রেম বিনিময় হয়ে যায় দুজনের মাঝে।
অনেকের মতে, অতি অল্প বয়স থেকেই দ্বিতীয় রামেসিস বাবার সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তার পারদর্শিতায় খুশি হয়ে বাবাই তাকে একটি হারেম উপহার দিয়েছিলেন, যে হারেমেই নেফারতারির সঙ্গে রামেসিসের দেখা হয়েছিলো।
ষোলো বছর বয়সে প্রিয় স্ত্রী নেফারতারির উপস্থিতিতেই রামেসিসের রাজ্যাভিষেক ঘটে। এক সাথে শুরু হয় তাদের দুজনের রাজকীয় জীবন। অল্প বয়সের এই প্রেম নেফারতারির মৃত্যুর পরেও রামেসিসের অন্তরে বিদ্যমান ছিলো। পরিবার থেকে যুদ্ধক্ষেত্র সমস্ত জায়গায় সঙ্গী হওয়া স্ত্রীকে রামেসিস মৃত্যুর পরেও ভুলতে পারেন নি।
দ্বিতীয় রামেসিসের চার ছেলে ও দুই মেয়ের জননী নেফারতারিও এক পর্যায়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিয়েছিলেন। রাজ্যের সবচেয়ে বুদ্ধিমতী এই রাণীর চলে যাবার পর তার উদ্দেশ্যে লেখা রামেসিসের কবিতাগুলোতে ফুটে ওঠে স্ত্রী-বিয়োগের কাতরতা। বিরহে পাগলপ্রায় হয়ে যান রামেসিস।
থিবসের দক্ষিণে আবু সিম্বেলে পাহাড় খোদাই করে দুটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন রামেসিস; একটি নিজের জন্য, অপরটি প্রিয়তমা নেফারতারির জন্য। তবে মৃত্যুর আগে স্বামীর হাতে গড়া এই প্রেমের নিদর্শন দেখে যেতে পারেন নি নেফারতারি। তার মৃত্যুর এক বছর পর আবু সিম্বেলের সেই মন্দিরটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। হয়তো দূর থেকে অপার্থিব এই রাণী নৌকাসমাধিতে যেতে যেতে মন্দিরটির দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়েছিলেন।
নেফারতারির সম্মানার্থে তৈরী সমাধিটিও ছিলো অনন্য। সমাধি-মন্দিরটি লুট হবার পরও বেশ কিছু জিনিস পাওয়া গিয়েছে। পাথরের সারকোফেগাস এবং দেহাবশেষের হাড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রমাণিত হয় যে, সমাধির মৃতদেহটি নেফারতারির সমসাময়িক কোনো ব্যক্তিরই ছিলো। সুতরাং মৃতদেহটি নেফারতারির হবারই সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়াও প্রায় তিন হাজার বছর আগের নেফারতারির ব্যবহৃত স্যান্ডেল, কসমেটিক্স জার সবই পাওয়া যায়।
মিশরের অত্যন্ত মর্যাদাবান রাণীর তালিকায় ক্লিওপেট্রা, নেফারতিতি কিংবা হাতশেপসুতের পাশাপাশি নেফারতারিও ছিলেন। অথচ তিনি তাদের মতো এতোটা পরিচিতি লাভ করেন নি। তবে আবু সিম্বেলের মন্দিরে স্বয়ং ফারাওকেও নেফারতারির পূজা করতে দেখা গিয়েছে। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, নেফারতারির অবস্থান কতোটা মর্যাদাপূর্ণ হওয়া উচিৎ।
রেফারেন্স:
- নেফারতারি
- Nefertari: into the Valley of the Queens
- Symbolism in the art of Queen Nefertari’s Tomb, Valley of the Queens
- ‘মিশরীয় মিথলজি আদি থেকে অন্ত’ –এস এম নিয়াজ মাওলা