রাবেয়া বসরি ইরাকের বসরার এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-মায়ের চতুর্থ সন্তান ছিলেন বলে তার নাম রাখা হয় ‘রাবেয়া’, আরবীতে যার অর্থ ‘চতুর্থ’। খুব ছোটোবেলায় বাবা-মা মারা গেলে তাকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। দিনের বেলা তিনি মনিবের ঘরের সব কাজ করতেন এবং রাতে স্রষ্টার প্রার্থনায় রত থাকতেন। এমনই কোনো এক রাতে প্রার্থনারত অবস্থায় তার মনিব তার চারপাশে এক আলোর বর্তিকা দেখতে পান, যা সম্পূর্ণ ঘরটিকে আলোকিত করে রেখেছিলো। এই অলৌকিক ঘটনা দেখে তার মনিব হতবাক ও বিহ্বল হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, রাবেয়া কোন সাধারণ মানুষ নন। পরদিন সকালেই তিনি রাবেয়াকে দাসী-জীবন থেকে মুক্তি দেন।

দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে একান্তভাবে স্রষ্টার নৈকট্য পাবার আশায় রাবেয়া চলে গেলেন জনমানবশূন্য এক মরুভূমিতে। ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি ধ্যানমগ্ন থাকতেন। অনর্গল বিধাতার সাথে কথা বলে যেতেন। পার্থিব কোনো কিছুই তিনি চাইতেন না। কিছুদিন সেই মরুভূমিতে থাকার পর তিনি পবিত্র নগরী মক্কায় গিয়ে হজ্জ্ব পালন করলেন।

ধর্ম সম্পর্কে তার দর্শন হচ্ছে, ভয় বা পুরস্কার কোনোটা দিয়েই স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করা যায় না, জান্নাত লাভের ইচ্ছা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবার আশা স্রষ্টার নৈকট্য লাভে বাধা সৃষ্টি করে। তার মতে, স্রষ্টার প্রেমে আমি এমনই নিমগ্ন থাকবো যে, কাউকে ঘৃণা করার সময় আমার হবে না। তার এই বাণী থেকে আমরা বুঝতে পারি, আমরা যদি শুধু ভালো কাজ করি ও মানুষকে ভালোবাসি, তবে অন্যের ক্ষতি করার সময়ই আমরা পাবো না। আর এটাই হবে সুন্দর পৃথিবী গড়ার জন্য আদর্শ পথ।

রাবেয়া খুবই সরল ও সাবলীলভাবে স্বতন্ত্র জীবনযাপন করেছেন। তিনি কখনোই কারো মুখাপেক্ষী হন নি। এমনকি নিজের এমন মনোভাব দিয়ে সফলতাও অর্জন করতে পেরেছেন, যা তার বীরত্বেরই বহিঃপ্রকাশ। বুদ্ধিজীবী ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্বে পুরুষকে ছাপিয়ে যাওয়ার সাহস নিজের মাঝে নিজে তৈরী করেছেন তিনি। ফলে সাধক হিসেবে একজন পুরুষ যা হতে পারতো, নারী হয়ে তিনিও সেভাবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, কোনো অংশে কমতি তিনি হতে দেন নি। এ কারণে ইসলামী সুফী ভাবধারায় তার এই অবস্থানকে নারীবাদের সাথে সামিল করা হয়ে থাকে।

স্বাধীন, আত্মনির্ভরশীল এই নারী পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, শুধুমাত্র বিত্তশালী কিংবা পুরুষ হলেই স্রষ্টাকে পাওয়া যাবে এমন কোনো কথা নেই, স্রষ্টাকে পেতে হলে নিজের অহমকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তার মতে, আত্মসংযমই মানুষের উন্নতির প্রধান নির্ণায়ক এবং এভাবেই জাগতিক ভোগ ও লোভ-লালসা থেকে নিজেকে মুক্ত করে স্রষ্টার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করতে হবে। তার এই জীবন দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে বহু নারী সুফী-জীবন গ্রহণ করেছিলেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, তিনি কখনও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন নি। তিনি মনে করতেন, যে নিরাপত্তা তিনি স্বামীর কাছ থেকে পেতেন, সেই নিরাপত্তা তিনি স্রষ্টার কাছ থেকে সরাসরি চেয়ে নিয়েছেন। স্রষ্টা ও তার মাঝে তিনি তৃতীয় কোনো কিছুকে প্রবেশ করতে দিতে চান নি।

তিনি পার্থিব কোনো কিছুর প্রত্যাশা না করে দারিদ্র্যকেই বেছে নিয়েছিলেন সঙ্গী হিসেবে। তাই ৮০ বছর বয়সে মৃত্যুকালে তার সম্পদের বিবরণ দিতে গেলে দেখা যায়, তার ঘরে ছিল একটি মাদুর, পর্দা, পানি রাখার একটি মাটির পাত্র এবং একটি বিছানা।

নারীবাদীদের মতে, যেহেতু রাবেয়া বসরি নারী ও পুরুষের সমতা নিয়ে কোনো কথা বলেননি, সেহেতু তিনি নারীবাদী কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। আমরা মনে করি, তিনি নারী জাতির অগ্রদূত। আজ থেকে প্রায় ১২০০ বছর আগের পুরুষতান্ত্রিক সমাজেও একজন নারী যে কোনো পুরুষের সাহায্য ছাড়া স্বাধীনভাবে চলার সামর্থ্য রাখে, রাবেয়া বসরি তারই একটি উজ্জ্বল উদাহরণ এবং এটাই নারীবাদ। সম্মান ও সমতা নিয়ে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকাটাই নারীবাদ। ইসলামের এই প্রথম মহিলা সুফী সাধকের প্রতি রইলো আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

 

শিউলি ফুলের বিষণ্ণতার গল্প

শরতের রাতের সৌন্দর্য বলতে যে ফুলকে বোঝানো হয়, তা হলো শিউলি ফুল। তবে এ সৌন্দর্য আনন্দের নয়, বেদনার প্রতীক। শিউলি ফুলের নাকি সব সময়ই মন খারাপ থাকে। সূর্যের ওপর তার এক রাশ অভিমান। তাই তো রাতের আঁধারেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পছন্দ করে সে এবং সূর্য ওঠার আগেই লুকিয়ে ঝরে পড়ে।...

মিশরীয় সিন্ডারেলা

মিশরে তখন ১৬ তম রাজবংশের যুগ। পার্সিয়ান আক্রমনের সম্ভাবনায় দিন গুণছে মিশর। সে সময় মিশরীয় সৈন্যদের তুলনায় গ্রীক সৈন্যদের কদর ছিলো অনেক বেশি। কারণ গ্রীক সৈন্যদের দক্ষতার গল্প প্রচলিত ছিলো বিশ্ব জুড়ে। এমন সময় ফারাও এপ্রিয়েজকে হত্যা করে মিশরের নতুন ফারাও হলেন রাজবংশের...

প্রাচীন সভ্যতায় ঈশ্বরের ধারণার উৎপত্তি ও সংখ্যাগত অবনমন

যে কোন সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলেই আমরা বহু ঈশ্বর বা গডের অস্তিত্বের কথা জানতে পারি। তবে আজকের প্রেক্ষাপটে ঈশ্বর সম্পর্কে এ ধারণা অনেকটাই পাল্টেছে। কেননা বর্তমান বিশ্বে বহু ধর্মমত এখনও বিদ্যমান থাকলেও ঈশ্বরের সংখ্যার বিষয়টি কমে এসেছে। একেশ্বরবাদ কিংবা বহুঈশ্বরবাদী...

হিন্দু দেব-দেবীর ধারণা প্রাচীন মধ্য এশীয় বিশ্বাসেরই প্রতিরূপ নয় তো?

সিংহবাহনের ওপর এক হাতে চাঁদ ও এক হাতে সূর্য নিয়ে চার হাতবিশিষ্ট এক দেবী যুদ্ধবাজ ভঙ্গিমায় আসীন নিজের সন্তানদের প্রতিরক্ষার জন্য। খুব পরিচিত লাগছে তাই না? নিশ্চয়ই দেবী দুর্গার সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু এ তো দুর্গা নয়, ব্যাক্ট্রিয়ান মাতৃদেবী ‘নানায়াহ’ বা ‘ননা’...

মহাবীর কর্ণের অন্তিম যাত্রা

সূর্যদেব অস্তে চলে যাচ্ছেন। গোধূলিবেলার লালচে আলোতে আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমার এই জন্মের শত্রুকে। তার গান্ডিব ধরা উদ্ধত হাতে চকচক করছে অঞ্জলিক বাণ, যা আমার মস্তক ছেদ করার জন্য একটু পরেই ছুটে আসবে।পান্ডব বীর অর্জুন, যে আমার চরম শত্রু আবার আমার সহদর কনিষ্ঠ ভ্রাতা।ওই...

মেহেদী হাসান খান

মেহেদী হাসান খান ১৮ বছর বয়সের মেহেদী হাসান খান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হলেন,কিন্তু পড়াশোনায় তার মন নাই! কিন্তু কেন? তিনি নাওয়া- খাওয়া, পড়াশোনা বাদ দিয়ে একটা ছোট্ট কম্পিউটার সম্বল করে বাংলা ভাষায় লেখার জন্য লড়াই শুরু করলেন। একটাই জেদ, বাংলা...

ঢাকার হারিয়ে যাওয়া সংগ্রহশালা- বলধা জাদুঘর

১৯২৫ সালের ঢাকা; ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে রেললাইন ধরে নারায়ণগঞ্জের দিকে কিছুদূর এগুলে উয়ারি। উয়ারির শেষ সীমানায় এক সরু রাস্তা চলে দিয়েছে নারিন্দার দিকে। সরু সেই রাস্তার একপাশে বহু পুরাতন খ্রিস্টান কবরখানা আর তার বিপরীতে উঁচু পাচিলঘেরা কম্পাউন্ডের ভেতর দোতলা...

সুন্দরবন ধ্বংসের ইতিবৃত্ত

ব্রাজিলের চিরসবুজ বিস্তৃত এমাজন (Amazon Rainforest) গহীন বনাঞ্চলকে বলা হয় বিশ্বের ফুসফুস, তেমনি সুন্দরবনও বাংলাদেশের শ্বাস-প্রশ্বাসের এক অঙ্গ। এই ঘন বনাঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও এক প্রতিরোধ। সুন্দরবনকে ঘিরে আশেপাশের জনপদে ছড়িয়ে আছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী। এমনি...

ঢাকার এক বিস্মৃত চিকিৎসক

দিনটি ছিল ১৫ই নভেম্বর ১৮৬৪ সাল, মঙ্গলবার। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। নারিন্দার খ্রিস্টান কবরস্থানের দীর্ঘ ঘাসের ঝোপে অবশ্য তখনই অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা হলে এই এলাকায় সহজে কেউ পা বাড়ায় না। কিন্তু সেদিন পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য- আছে ইংরেজ, আরমেনিয়, দেশী সব...

ঢাকার ঐতিহাসিক তারা মসজিদ

পূর্বকথাঃ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আরমানিটোলার মহল্লা আলে আবু সাঈদে তখন এক প্রভাবশালী জমিদারের বাস, নাম- মীর্জা গোলাম পীর। দাদা মীর আবু সাঈদ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা যুগে তুরস্ক থেকে এসে ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন। মীর্জা গোলাম পীরের আরেক নাম মীর্জা আহমেদ জান। তবে...