বাংলাদেশে মুঘল আমলের কীর্তি বলতে যে নামটি মাথায় আসে, তা হলো ‘লালবাগ কেল্লা’। আর লালবাগ কেল্লার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর কথা বলতে গেলে সবার আগেই চলে আসে পরী বিবির সমাধির কথা। কিন্তু কে এই পরী বিবি? সংখ্যাগরিষ্ঠ ঐতিহাসিকের প্রতিষ্ঠিত মতবাদ, এই সমাধিতে নাকি শায়েস্তা খানের মেয়ে এবং আজম শাহের স্ত্রী ইরান দুখত রহমত বানু শুয়ে আছেন। কিন্তু আসলেই কি ইরান দুখত আজম শাহের স্ত্রী ছিলেন? এমনকি সমাধিটি আসলেই সুবাদার শায়েস্তা খানের মেয়েরই কি না সেই বিষয়ে স্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। ইতিহাস সামান্য বিশ্লেষণ করলে কিছু সম্ভাবনা উঁকি দেয়, যা যুগ যুগ ধরে প্রতিষ্ঠিত এক ইতিহাসের ভিত নড়বড়ে করে দিতে পারে। কে জানে? হয়তো আসলেই এই সমাধি শায়েস্তা খানের মেয়ে ইরান দুখত ওরফে পরী বিবির, কিংবা হয়তো এই পরী বিবি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই না হওয়া কোনো আত্মত্যাগী নারী।
১৬৭৮ সালে ঢাকার শাসনকর্তা ফেদি খাঁর মৃত্যু হলে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তার তৃতীয় ছেলে আজম শাহকে ঢাকায় আসতে বলেন। আজম শাহ ঢাকায় আসার পরই তিনি একটি অত্যন্ত সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণের পদক্ষেপ নেন। এই দুর্গই আজকের লালবাগ কেল্লা।
লালবাগ কেল্লার কাজ চলাকালীন অবস্থায়ই মারাঠা বিদ্রোহের দুঃসংবাদ আসে আওরঙ্গজেবের কানে। জরুরি ভিত্তিতে তখনই ছেলে আজম শাহকে তিনি দিল্লিতে পাঠান সেই বিদ্রোহ দমনের জন্য। মাত্র পনেরো মাস ঢাকায় থেকে আজম শাহকে চলে যেতে হয় দিল্লীর উদ্দেশ্যে। লালবাগ কেল্লার কাজ রয়ে যায় অসম্পূর্ণ। বাকি কাজ সম্পন্ন করবার দায়িত্ব ন্যস্ত হয় শায়েস্তা খাঁর ওপর। কিন্তু কাজ সম্পন্ন হতে হতে আবারও এক দুঃসংবাদ শুনতে পান শায়েস্তা খান। নিজের মেয়ে ইরান দুখত রহমত বানু ওরফে পরী বিবির মৃত্যুর দুঃসংবাদ। তখন ১৬৮৪ সাল। শায়েস্তা খানের মেয়ের মৃত্যুর সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যায় লালবাগ দুর্গের কাজ। সবার মনে এক বদ্ধমূল ধারণার জন্ম নেয়, লালবাগের এই দুর্গটি অশুভ। শায়েস্তা খান নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, এই দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু হলেই মিলবে দুঃসংবাদ। সুতরাং অসম্পূর্ণ অবস্থায় অনন্তকালের জন্য দাঁড়িয়ে রইলো এক মুঘল স্থাপনা এবং প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস অনুযায়ী এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন ইরান দুখত।
কিন্তু ইতিহাস এ-ও বলে, পরী বিবি ছিলেন আজম শাহের স্ত্রী, যৌক্তিকতার বিচারে যার শক্ত কোনো অবস্থান নেই। কারণ শায়েস্তা খান তো ছিলেন আওরঙ্গজেবের মামা, সেই হিসেবে ইরান দুখত সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের মামাতো বোন এবং আজম শাহের ফুপু। মুঘল সাম্রাজ্যে যেখানে বিয়ের ক্ষেত্রে বংশ ও সম্পর্ক কঠোরভাবে বিবেচনায় আনা হতো, সেখানে কি করে আজম শাহ নিজের ফুপুকে বিয়ে করবেন? তাছাড়া মাত্র পনেরো মাস আজম শাহের ঢাকায় থাকাকালীন এমন বিয়ে কি করেই বা সম্ভব?
ইতিহাসবিদ স্টুয়ার্টের বিবরণ থেকে জানা যায়, যুবরাজ আজম শাহ যখন ঢাকা ত্যাগ করেন, তখন তার সাথে শুধু তার ছেলে বিদার বখ্ত ছিলো। কোনো স্ত্রীর কথা সেখানে উল্লেখ ছিলো না। ইরান দুখত ওরফে পরী বিবির সাথে যদি তার বিয়ে হয়েই থাকে, তবে নববিবাহিতা স্ত্রীকে একা রেখে দিল্লীর উদ্দেশ্যে তিনি কি করে চলে গিয়েছিলেন?
এমন হাজারো প্রশ্ন যখন মাথায় উঁকি দেয়, ঠিক তখন ‘গ্লিম্পসেস অফ ঢাকা’ বইতে সৈয়দ মুহাম্মদ তৈফুর দাবী করে বসলেন, গৌহাটি রাজ্যের বৌদ্ধ রাজকন্যা রামানি গাভারুই আজম শাহের স্ত্রী এবং লালবাগের সেই সমাধিতে শুয়ে থাকা পরী বিবি। এই দাবীর পক্ষে তার যুক্তিগুলোও যেনো স্বাভাবিক ভাবনার জগৎকে প্রসারিত করতে চায়।
তৈফুর বলেন, আজম শাহের আগে থেকেই তিন জন স্ত্রী ছিলেন এবং দিল্লীতে যাবার পর তার আরেকটি বিয়ে হয়। মুঘল সাম্রাজ্য ইতিহাস সংরক্ষণ করতো। আর আজম শাহের ইতিহাসে এই চার জন স্ত্রীর উপস্থিতিরই রেকর্ড আছে। ঢাকায় থাকাকালীন তার কোনো বিয়ের রেকর্ড পাওয়া যায় নি।
বয়স খুব কম থাকতেই চাচা দারা শিখোর মেয়ে জাহানজেব বানু বেগমের সাথে বিয়ে হয় আজম শাহের। পরবর্তীতে গৌহাটির রাজকন্যা রামানি গাভারু এবং সুলতান মুরাদের নাতনির সাথেও বিয়ে হয় তার। ঢাকা ছেড়ে দিল্লী যাবার পর বিজাপুরের রাজকন্যা সাহার বানু বেগমকে বিয়ে করেন আজম।
পূর্ব বাংলার সুবাদার ও মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রতিনিধি মীর জুমলা ইতিপূর্বে আসাম রাজ্য দখলের জন্য একটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঘটনার পরিক্রমায় ১৬৬৩ সালে আসামের রাজা মীর জুমলার সাথে শান্তি চুক্তি স্থাপন করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। সেই চুক্তি অনুযায়ী, তিন লক্ষ রুপি, ৯০টি হাতি এবং আসামের রাজকন্যা রামানি গাভারুকে মীর জুমলার কাছে হস্তান্তর করবার কথা ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে এই চুক্তিতে উল্লিখিত ক্ষতিপূরণগুলো যথাযথভাবে পরিশোধ করা না হলেও রাজকন্যাকে ঠিকই মীর জুমলার সাথে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো। ফেরার পথে মীর জুমলা মারা যান এবং রাজকন্যা রামানি গাভারুকে আগ্রায় আওরঙ্গজেবের হারেমে অন্য নারীদের সাথে রাখা হয়।
রামানি গাভারু ছিলেন অসম্ভব রূপবতী। যুবরাজ আজম শাহ তাকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারেন না। এক সময় তাকে বিয়ে করার ইচ্ছার কথা বাবা আওরঙ্গজেবকে জানান আজম শাহ। আওরঙ্গজেব রামানি গাভারুকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করেন এবং নতুন নাম দেন রাহমাত বানু বেগম। ধর্মান্তরিত রাজকন্যাকে বিয়ে করেন আজম শাহ। ঢাকায় আসার সময়ও সাথেই ছিলেন রামানি গাভারু ওরফে রাহমাত বানু বেগম। সুন্দরী স্ত্রীকে সবসময় পরীর সঙ্গে তুলনা করতেন আজম শাহ, ‘পরী’ বলে সম্বোধনও করতেন মাঝে মাঝে। তৈফুরের মতে, সন্তান প্রসবের সময় আকস্মিকভাবে মৃত্যু হয় পরীর মতো সুন্দরী সেই অসমীয় রাজকন্যার এবং লালবাগের দুর্গটিতেই সমাহিত করা হয় তাকে। সুতরাং পরী বিবির সমাধির সেই পরী বিবি হয়তো আসামের সেই অবহেলিত রাজকন্যা রামানি গাভারু এবং পাশের ছোট সমাধিটি হয়তো তারই কন্যা সন্তানের। আর যদি তা না হয়, তবে কোথায় গেলো রামানি গাভারুর সমাধি?
খুবই দুঃখজনক ব্যাপার, আমাদের উপমহাদেশের নারীদের ইতিহাস লিখে রাখার প্রয়োজনীয়তা কোনোকালেই তেমন অনুভূত হয় নি। পরী বিবির সমাধি নিয়ে কেনো আজ তৈরী হলো এমন সংশয়? আসাম তো নিজেদের ইতিহাস লিখে রাখে। তবে কেনো রাজকীয় জীবন ছেড়ে আসা রামানি গাভারু নামের এই মেয়েটির ইতিহাস লিখে রাখা হলো না? কেনো অবমূল্যায়ন হলো এই আত্মত্যাগী নারীর? মুঘলদের কাছে শুধু সমাধিটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, সমাধিতে শায়িত নারীর পরিচয় নয়।
আসলে লালবাগ কেল্লায় যিনি ঘুমিয়ে আছেন, তিনি কে? কোন পরী বিবি? এই সম্পর্কে আসলে ইতিহাসে কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণাদি নেই। তবে সে সময় ইতিহাসের বেশিরভাগ বই লেখা হতো আরবি কিংবা ফারসি ভাষায়। হয়তো সেই বইগুলোকে যথার্থভাবে অনুবাদ করে পরী বিবির সমাধি সংক্রান্ত সত্যতা উদঘাটন করা যেতেও পারে। কাজটি হয়তো এতো সহজ নয়। তবে ইতিহাসের সত্যতা উন্মোচন এবং একজন আত্মত্যাগী নারীর জীবনের রহস্য খুঁজে বের করবার দায়িত্ব থেকে পিছপা হবার গ্লানি আর কতোকাল বয়ে চলবে এই সমাজ, এই দেশ, এই উপমহাদেশ?
রেফারেন্সঃ
- Bibi Pari-An enigma
- BIBI PARI-AN ENIGMA – Stay Curious SIS
- মীর জুমলা
- পরি বিবির সমাধির রহস্য!
- পরী বিবি
- আওরঙ্গজেব
- মুহাম্মদ আজম শাহ
- Ramani Gabharu
- ইতিহাস-স্থাপত্যে সমৃদ্ধ লালবাগ কেল্লা
- ৰমণী গাভৰু ওৰফে ৰহমত বানু বেগম (ভিডিও)
- In Search of a Lost Ahom Princess
- শায়েস্তা খাঁ