সুকুমার রায় একটি অনন্যসাধারন প্রতিভার নাম, তাঁর প্রতিভার যে দিকটি সবাইকে টানে তা হল তাঁর ‘ননসেন্স’ রচনা। আবার অনেকগুলোই ছিলো অনেক বেশি সেন্সসমৃদ্ধ। তাঁর লেখা কবিতার বই ‘আবোল তাবোল’ পড়লে মনে হয়, সুকুমার রায়ের প্রতিভা অসাধারন ছিল বলেই তিনি এরকম কবিতা লিখতে পেরেছিলেন।

সুকুমার রায়

সুকুমার রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের কলকাকাতায়, মৃত্যু ১৯২৩ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার ১০০ নং গড়পার রোড। মাত্র ৩৬ বছরের জীবনে তিনি এমন কিছু সৃষ্টি করে গেছেন, যার আবেদন এখনো অমলিন। তাঁর লেখার ধাঁচ বা ধরন কোনটাই আজ পর্যন্ত অন্য কারো লেখার মাঝে পাওয়া যায় না। তিনি ছিলেন একজন বাঙালী শিশু সাহিত্যিক এবং বাংলা সাহিত্যে “ননসেন্স ছড়া”র প্রবর্তক। এছাড়াও তিনি ছিলেন লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও সম্পাদক। তিনি জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধূরীর পূত্র এবং তার পুত্র খ্যাতিমান ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়। সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালি নবজাগরনের স্বর্নযুগে। তার পারিবারিক পরিবেশ ছিল সহিত্যের প্রতি অগাধ ভালবাসা।পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন শিশুতোষ গল্প ও জনপ্রিয়-বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শৌখিন জ্যোতির্বিদ। তিনি ছাপার ব্লক তৈরির কৌশল নিয়ে গবেষণা করেন, এবং সেটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। তিনি মানসম্পন্ন ব্লক তৈরির একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মেসার্স ইউ. রয় এন্ড সন্স নামে ঐ প্রতিষ্ঠানের সাথে সুকুমার রায় যুক্ত ছিলেন। সুকুমারের মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে।উপেন্দ্রকিশোর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, তাছাড়া রায় পরিবারের সাথে জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল রায়, ইনাদের সাথেও ভালো সম্পর্ক ছিল।

সুকুমার রায় প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়বার সময় ননসেন্স ক্লাব নামে একটি সংঘ গড়ে তুলেছিলেন। এর মুখপাত্র ছিল সাড়ে বত্রিশ ভাজা নামের একটি পত্রিকা। সেখানেই তার আবোল-তাবোল ছড়ার চর্চা শুরু। ননসেন্স ক্লাবের মতোই আরও একটি ক্লাব গড়ে তোলেন সুকুমার রায়, নাম ‘মণ্ডা ক্লাব’। ‘মণ্ডা ক্লাবের কয়েকটি আমন্ত্রণ পত্র’ সিরিজের কয়েকটি কবিতাও আছে তাঁর।

তাঁর লেখা ‘খিচুড়ি’ ছড়ায় – হাঁসজারু’, ‘বকচ্ছপ’, ‘হাতিমির’ মতো অদ্ভুত কিম্ভূতকিমাকার কাল্পনিক প্রাণীদের নিয়ে ছড়া লিখেছেন। তাঁর ‘বাপুরাম সাপুড়ে’ তো প্রতিটি বাঙ্গালীরই পড়া । ‘শব্দকল্পদ্রুম’ নাটকে বৃহস্পতির মন্ত্র—‘হলদে সবুজ ওরাংওটাং’। আর-একটি হল ‘হ য ব র ল’-এর ন্যাড়ার গান—‘মিশিমাখা শিখিপাখা আকাশের কানে কানে’।আবার ‘আবোল তাবোল’-এর ‘মাসি গো মাসি পাচ্ছে হাসি-, নিমগাছেতে হচ্ছে শিম- , হাতির মাথায় ব্যাঙের ছাতা-, কাগের বাসায় বগের ডিম’। কিন্তু ‘আবোল তাবোল’-এর অনেক কবিতাতেই রীতিমতো সামাজিক সেন্স প্রকাশ পেয়েছে। ‘আবোল তাবোল’-এর পরে প্রকাশিত বইগুলির কবিতায় অনেক সময় ছোটোদের জন্য নীতিকথাও শুনতে পাই। তাঁর পাগলা দাশু বইয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভূমিকা লিখেন—

তাঁর বিখ্যাত ছড়াগুলির মধ্যে অন্যতম — ‘ভুতুড়ে খেলা’, ‘রামগরুড়ের ছানা’, ‘গোঁফচুরি’, ‘প্যাঁচা আর প্যাঁচানি’, ‘অবাক কাণ্ড’, ‘ন্যাড়া বেলতলায় যায় ক’বার’, ‘শব্দ কল্প দ্রুম’, ‘একুশে আইন’, ‘মূর্খমাছি’, ‘জীবনের হিসাব’। তাঁর আরেক বিখ্যাত কবিতা ‘জীবনের হিসাব’, যেখানে সুকুমার রায় বইয়ের বাইরে জীবনমুখী জ্ঞানার্জনের জন্য উপদেশ দিয়েছেন।

তাঁর লেখা গল্প হ-য-ব-র-ল, গল্প সংকলন ‘পাগলা দাশু’ ও নাটক চলচ্চিত্তচঞ্চরী, বিশ্বসাহিত্যে সবযুগের সেরা ‘ননসেন্স’ ধরনের ব্যঙ্গাত্মক শিশুসাহিত্যের অন্যতম বলে মনে করা হয়। কেবল ‘ আ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ ও কয়েকটি মুষ্টিমেয় ধ্রুপদী সাহিত্যই যার সমকক্ষ। এছাড়াও হরেক রকমের বিষয় নিয়ে সুপাঠ্য প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গল্প, নাটক ও তিনি লিখে গিয়েছেন৷

সুকুমার রায়ের স্ত্রীর নাম সুপ্রভা রায়, তিনি জন্মেছিলেন কলকাতার দক্ষিন রাঢ়ীয় কায়স্থ বংশের ব্রাহ্ম পরিবারে।তাঁর মৃত্যুর সময় মুখাগ্নি করার কথা তার জ্যেষ্ঠ পূত্র সত্যজিৎ রায়ের, কিন্তু মুখাগ্নি করার কথায় তিনি শিউরে উঠে বলেন, কি মা’র মুখে আগুন দিবো আমি? তাঁর চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি ঝরতে থাকে।

সুকুমারের মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গাপাধ্যায়ের মেয়ে।তাঁর আদিনিবাস ছিলো ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার মসূয়া গ্রাম। বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মৃত্যুর পর তিনি ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনার ভার নেন। এর পর থেকেই তিনি লেখালেখি নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়েন। তিনি বেশিরভাগ লেখাই লিখতেন সন্দেশ’ পত্রিকার জন্য। সন্দেশের সম্পাদক থাকাকালীন তার লেখা ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ আজও বাংলা শিশুসাহিত্যে মাইলফলক হয়ে আছে।

সন্দেশ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশের প্রতিলিপি —-

শ্রী শ্রী কাগায় নমঃ

শ্রীকাক্কেশ্বর কুচকুচে

৪১ নং গেছোবাজার কাগেয়াপট্টি।

আমরা হিসাবী ও বেহিসাবী খুচরা ও পাইকারী সকল প্রকার গননার কার্য্য বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করিয়া থাকি। মূল্য এক ইঞ্চি। Children half price, অর্থাৎ শিশুদের অর্ধমূল্য। আপনার জুতার মাপ, গায়ের রং, কান কটকট করে কিনা, জীবিত কি মৃত ইত্যাদি আব্যশকীয় বিবরন পাঠাইলেই ফেরত ডাকে ক্যাটালগ পাঠাইয়া থাকি।

সাবধান! সাবধান!! সাবধান!!!

আমরা সনাতন বায়স বংশীয় দাঁড়ি কুলীন, অর্থাৎ দাঁড়কাক। আজকাল নানাশ্রেনীর পাতিকাক, হেঁড়েকাক, রামকাক, প্রভৃতি নীচশ্রেনীর কাকেরাও অর্থলোভে ব্যাবসা চালাইতেছে। সাবধান! তাহাদের বিজ্ঞাপনের চটক দেখিয়া প্রতারিত হইবেন না।

তাঁর প্রতিভার কদর করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে ‘কল্লোল’-পর্বের সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র, মণীশ ঘটক, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু এবং সৈয়দ মুজতবা আলী। তাঁরা সবাই তাঁর লেখার অনুরাগী ছিলেন।এখনো সব বয়সী মানুষই সুকুমার রায়ের লেখার মুগ্ধ পাঠক। বিশ্বের সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানী সৈয়দ মুজতবা আলী সুকুমার রায়ের নাটক সম্পর্কে বাস্টার কিটন আর চার্লি চ্যাপলিনের অভিনয়ের কথা বলেছেন। আরো বলেছেন যে, সুকুমার রায়ের মতো হাস্যরসিকের সন্ধান তিনি পাশ্চাত্য সাহিত্যেও পাননি। কিন্তু একজন জার্মান সাহিত্যিকের নাম করে তিনি বলেন —“একমাত্র জার্মান সাহিত্যের ভিলহেলম বুশ সুকুমারের সমগোত্রীয়। ঠিক সুকুমারের মতো তিনি অল্প কয়েকটি আঁচড় কেটে খাসা ছবি উতরাতে পারতেন। তাই তিনিও সুকুমারের মতো আপন লেখার ইলাসট্রেশন নিজেই করেছেন।”সুকুমার রায়ের মতোই বুশ নিজের ছড়ার সঙ্গে ছবি আঁকতেন।

ইংল্যান্ড-এর দুজন কবি—টমাস হুড এবং হিল্যের বেলক দুজনেই ‘Ode to the Camelopard’ এবং ‘The Camelopard’ নামে দুটি কবিতা লিখেছিলেন ‘ক্যামেল’ ও ‘লেপার্ড’ শব্দদুটির সমম্বয়ে গঠিত এই ‘ক্যামেলোপার্ড’ শব্দটি ‘খিচুড়ি’ কবিতার বকচ্ছপ, জিরাফড়িং, গিরগিটিয়া ইত্যাদি শব্দ মনে করিয়ে দেয়।