উত্তরের পর্বতমালা থেকে ঝিরি ঝিরি হিমেল হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে পূর্ব চীনের শ্যানডং (Shandong) প্রদেশের উপত্যকাগুলোর সবুজের সমারোহকে দোলা দিয়ে। ক্ষনে ক্ষনে বাতাসের ঢেউ খেলানো তরঙ্গের চাপে হেলে-বেঁকে যাচ্ছে উপত্যকার ঘাস-বৃক্ষরাজি। এর মাঝেই দূরে শির উঁচু করে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে টাই (Tai) পর্বত শৃঙ্গ, যেনো দারুণভাবে উপভোগ করছে উপত্যকার বাতাসের সাথে বৃক্ষরাজির চির মান-অভিমানের অম্ল-মধুর সম্পর্ককে। এখন থেকে আনুমানিক ২,৫৭৩ বছর আগে, খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, এ অঞ্চলেই জন্ম নেয় দূর-প্রাচ্যের অতি প্রাচীন রাষ্ট্রদর্শনের অন্যতম প্রভাবশালী চৈনিক চিন্তাবিদ, কনফুসিয়াস (Confucius)। যার দর্শনের প্রভাব এখনো রয়ে গিয়েছে চীনের সমাজের গভীরে।
কনফুসিয়াসেরও জন্মের প্রায় দু’শো বছর আগে থেকেই, আনুমানিক ৭৭০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে চীনে শান্তি ও সমৃদ্ধির স্থিতিশীলতায় তথাকথিত “চিন্তার শত বিদ্যাপাঠ” (Hundreds Schools of Thoughts) উত্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ঐ বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল এই কনফুসিয়াসর বিদ্যাপাঠ। কনফুসিয়াসের রাষ্ট্র-চিন্তার মূল ভিত্তি ছিল বিশ্ব নিয়ে চীনের চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গির তিনটি প্রধান মূল্যবোধ: আনুগত্য, কর্তব্য এবং সম্মান। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একজন রাষ্ট্র বা সমাজের নেতার নৈতিকতা এবং ন্যায় আচরণ ঐ সমাজের মানুষ ও সমাজকে প্রভাবিত করতে পারে প্রচন্ডভাবে। নেতার নৈতিক আচরণ অধিকাংশ জনগোষ্ঠীকে অনুপ্রাণিত করে নেতার ঐ আচরণগুলোকে অনুকরণ করতে। তিনি তার এই রাজনৈতিক দর্শনকে প্রতিকীর মাধ্যমে উপস্থাপন করেন এভাবে: রাষ্ট্র নেতার নৈতিক চরিত্র হলো অনেকটা বাতাসের মতো; আর তার অধীনের সাধারণ জনগোষ্ঠীর চরিত্র হলো জমিনের সবুজ ঘাস। যখন ভূমন্ডলে বাতাস বয়ে যায়, তখন ঘাসও আন্দোলিত হয়। তেমনই, জনগণও প্রভান্বিত হয়, অনুপ্রাণিত হয় নেতার নৈতিক বৈশিষ্টতায়।
কনফুসিয়াস আরও বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্রের নেতা, শাসক, এবং রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টাদের হতে হবে সাধারণ জনগণ থেকে মেধাবী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় তার এই তত্ত্বকে বলা হযে থাকে মেধাতন্ত্র (Meritocracy)। পরবর্তীতে চীনা রাষ্ট্র চিন্তাবিদদের মধ্যে অন্যতম মো ডি (Mo Di) বা মোজি কনফুসিয়াসের মেধাতন্ত্রকে সমর্থন করে গিয়েছেন দৃঢ় ভাবে। মোজি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহিসম (Mohism) বিদ্যালয়, যেখানে তিনি শিক্ষা দেন ছাত্রদের যে, রাষ্ট্রের সবাই প্রকৃতির চোখে “সমান”। এই “সমান”দের মধ্যে যারা মেধাবী, তাদেরকেই দেয়া হবে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা। অর্থাৎ, মেধার কারণে যারা ক্ষমতার যোগ্য, শুধুমাত্র তাদেরকেই রাষ্ট্র পরিচালনার পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া উচিত। কনফুসিয়াস এবং মোজির মেধাতন্ত্রের ধারণার সাথে একমত হন কনফুসিয়াসের চতুর্থ প্রজন্মের শিষ্য, আরেক চৈনিক রাষ্ট্র চিন্তাবিদ, মেসিয়াস (Mencius)।
কনফুসিয়াসের মেধাতান্ত্রিক রাষ্ট্র দর্শনের বিপক্ষে বিকল্প রাষ্ট্র-দর্শন, আইনসর্বস্বতা (Legalism), উপস্থাপনা করা হয় আরও পরে। এই দর্শনের যুক্তি ছিল যে, রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে হলে মেধার পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্র (authoritarian) রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই তত্ত্বের পক্ষে তাদের যুক্তি ছিল, শুধুমাত্র মেধা রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে পারে না, প্রয়োজন কর্তৃত্ববাদী শৃঙ্খলা, অর্থাৎ স্বৈরশাসন।
অন্যদিকে, আনুমানিক ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বে ইউরোপীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারার উৎপত্তি হতে থাকে প্রাচীন গ্রীসের পাথুরে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। সক্রেটিসেরও প্রায় দু’শো বছর আগে, খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম এবং ষষ্ঠ শতকে রাষ্ট্র-নীতি প্রণেতা সোলোন (Solon) এথেনিয়ান (Athenian) গণতন্ত্রের প্রথম তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক ভিত্তি প্রণয়ন করে যান। সোলোনের পরে, এথেনিয়ান গণতন্ত্রের বুদ্ধিবৃত্তিক রাষ্ট্র-দর্শনের স্বর্ণযুগে, খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে, সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো তার রাষ্ট্র-চিন্তা বিকাশের স্বাধীনতা পেয়েছিলেন। যদিও তিনি তখনকার সব রকমের রাষ্ট্র-ব্যবস্থার পাশাপাশি গণতন্ত্রকেও করেছিলেন অবজ্ঞা এবং কঠোর সমালোচনা। কারণ, প্লেটো বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্রের উন্নত জীবন-প্রণালীর জন্য প্রয়োজন সদগুণাবলীর, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন, তখনকার রাষ্ট্র-পরিচালনার ব্যবস্থাগুলো, যেমন রাজতন্ত্র, অভিজাতন্ত্র (oligarchy) এবং গণতন্ত্রের উদ্দেশ্যই হলো শাসক সম্প্রদায়ের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া। তাদের সম্মান এবং সম্পদের উন্নয়নই মুখ্য। এই সব রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য মানুষের নৈতিক গুণাবলীর উৎকর্ষ সাধন না করে, শাসকরা শুধুমাত্র নিজেদের সম্মান ও সম্পদ অর্জনের পেছনে মনোযোগ দিয়ে থাকে বেশী। যার ফলে রাষ্ট্রে হয় অবধারিত সংঘাত, অবিচার এবং অবক্ষয়।
রাষ্ট্র-ব্যবস্থার এই ত্রুটি সংশোধনের জন্য, চীনের কনফুসিয়াসের মেধাতন্ত্রের আলোকে প্লেটো দার্শনিক রাজাদের নিয়ে প্রজাতন্ত্র (Republic for philosopher kings) গড়ার প্রস্তাব করেছিলেন। প্লেটোর তাত্ত্বিক চিন্তায় এবং বিশ্বাসে, এই দার্শনিক শাসকরা হবেন মেধাবী। দার্শনিক শাসকরা রাষ্ট্রের উন্নত জীবন প্রণালী অর্জনের জন্য নিজেদের স্বার্থ বিবেচনা না করে, প্রয়োজনীয় সার্বজনীন নৈতিক মূল্যবোধকে এবং সাধারণ জনগণের উন্নয়নের প্রতি প্রাধান্য দিবেন অধিক। প্লেটো তার “স্টেটসম্যান” (Statesman) গ্রন্থে সক্রেটিসের সাথে তার সংলাপের মাধ্যমে বর্ণনা করে গিয়েছেন তার দার্শনিক গোষ্ঠী-পরিচালিত প্রজাতন্ত্রের কাঠামো এবং রূপরেখা। তিনি তার “রিপাবলিক” গ্রন্থের দশ খন্ডে বিস্তারিত আলোচনা করেন রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার (justice), আদর্শ নাগরিক, রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের আত্মার সম্পর্ক।
এদিকে, রাষ্ট্র-ভাবনাও বসে নেই প্রাচীন ভারতবর্ষে। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ এবং তৃতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি কোন এক সময়ে ভারতবর্ষের অন্যতম চিন্তাবিদ চানক্য লিখেন প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্র-দর্শনের গ্রন্থ, অর্থশাস্ত্র (Arthashastra)। গ্রন্থটিতে উপস্থাপনা করেন কল্যাণকর রাষ্ট্র গঠন, অর্থনীতি, রাষ্ট্রের দুর্নীতি, এবং রাষ্ট্র পরিচালনার তত্ত্ব। কনফুসিয়াস এবং প্লেটোর মেধাতন্ত্রের মতোই চাণক্য যুক্তি দেখান যে, শাসকদের হতে হবে সর্বোচ্চ নৈতিক মূল্যবোধের প্রতীক। তাদের পরামর্শকারীদেরও হতে হবে অত্যন্ত মেধাবী। চাণক্য রাষ্ট্রে দুর্নীতি নিয়ে তখনি লিখে গিয়েছেন, সরকারি কর্মচারিরা সম্পদ আরোহন করে হয় সরকারকে প্রতারণা করে, অথবা প্রজাদেরকে অত্যাচার করে। চাণক্যের রাষ্ট্র-তত্ত্বে উল্লেখ করা হয়, শত্রুর সাথে যুদ্ধে রাষ্ট্র জয়ী হলে, শত্রুর অনৈতিক, অন্যায় এবং অন্যায্যকে মুছে ফেলতে হবে বিজয়ী রাষ্ট্রের সকল ভালো মূল্যবোধগুলো দিয়ে। চাণক্য আরো এক ধাপ এগিয়ে লিখেন, যদি শত্রুর নৈতিক মূল্যবোধ হয় বিজয়ী রাষ্ট্রের মূল্যবোধ থেকে উন্নত, তাহলে বিজয়ীকে হতে হবে শত্রুর নৈতিক মূল্যবোধের চেয়ে দ্বিগুন উন্নত। চাণক্যের আগে ভারতের মনু (Manu) উন্নত রাষ্ট্র-ব্যবস্থার তাত্ত্বিক বর্ণনা দিয়ে লিখেছিলেন “মনুস্মৃতি” (Laws of Manu)।
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বিশ্বে এই তিনটি অঞ্চলে প্রাচীন রাষ্ট্র-দর্শনের সূচনালগ্ন থেকে আজো পাহাড়ে-কি-সমতলে অবিরত তরঙ্গ সৃষ্টি করে চলেছে বাতাস, হেলে যাচ্ছে ঘাস, আন্দোলিত হচ্ছে গাছ-গাছালি। থেমে থেমে আদর্শ রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন রাষ্ট্র-বিজ্ঞানীরা, কিন্তু সেই আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রাচীনতম প্রশ্নে আজো হয়নি কোন সমাধান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নিরন্তর হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছেন আদর্শ সেই রাষ্ট্রের রূপরেখাকে নাগালে পেতে, রাষ্ট্রের নাগরিককে স্বস্তি দিতে। অপেক্ষায় আছে সাধারণ জনগণও!