খ্রীষ্টপূর্ব ৩৭৫ সালে বিখ্যাত দার্শনিক এবং রাষ্ট্র চিন্তাবিদ প্লেটো যখন “রিপাবলিক” লেখেন, তখন এথেন্সের বেশীরভাগ নারীর স্বাধীনতা বলতে তেমন কিছুই ছিল না। তারা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। নারীর ভোট দেবার অধিকার ছিল না, এমনকি তারা জমির বা বাড়ীর মালিকও হতে পারতো না। আর রাষ্ট্র পরিচালনাতে তো তাদের কোনো ভূমিকাই ছিল না। প্লেটো তাঁর “রিপাবলিকে” একটি “আদর্শ রাষ্ট্রের” (Ideal State) তত্ত্ব, দর্শন এবং দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন। প্লেটোর “রিপাবলিক”কে বলা হয় আধুনিক বিশ্বের দর্শন এবং রাজনৈতিক তত্ত্বের একটি অন্যতম প্রভাবশালী দলিল। আসলে এটি একটি প্লেটোনিক সংলাপ-সামগ্রী যা’র প্রধান চরিত্র হলো সক্রেটিস। রিপাবলিকে তিনি আদর্শ রাষ্ট্রের প্রকৃতি, সেই সমাজে ব্যক্তির ভূমিকা, পাশাপাশি ন্যায়বিচার, রাজনীতি এবং সার্বিক জ্ঞান সম্পর্কিত বিষয়গুলোর বিস্তারিত বর্ণনা করেন। কিন্তু আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র নয়, বরং আমরা আজ দেখবো নারী-অধিকার নিয়ে প্লেটোর ভাবনা কি ছিল। ব্যাপারটি কিন্তু আমার কাছে ইন্টারেষ্টিং মনে হচ্ছে, তাই না?

প্লেটো

প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রে নারীর যে ভূমিকাটি কল্পনা করেছিলেন, তখনকার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে তা’ ছিল এক কথায় বৈপ্লবিক এবং অকল্পনীয়। প্লেটোর মতে, রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ স্তরে নারীরা পুরুষের সাথে সমান ভূমিকা রাখার অধিকার রাখে। রিপাবলিকের আলোকে প্লেটোর এই ধারণাটি আরেকটু খুলে বলি। তিনি তার কল্পনার “আদর্শ রাষ্ট্র” পরিচালনা করার জন্য পুরো শাসন ব্যবস্থাকে তিনটি স্তরে ভাগ করেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের সব নাগরিককেও তিনটি ভাগে ভাগ করতে হবে তাদের কর্ম ক্ষমতা আর মেধা অনুযায়ী। সর্ব নিম্নে থাকবে কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা, দ্বিতীয় স্তরে সেনাবাহিনী, আর সর্বোচ্চ স্তরে থাকবে রাষ্ট্রের “অভিভাবক” (Guardians) যারা হবেন জ্ঞানী, মেধাবী এবং দার্শনিক। এই অভিভাবকরাই হবেন রাষ্ট্র পরিচালনার মূল শক্তি। প্লেটো নারীদের অধিকার দিয়েছেন রাষ্ট্রের এই সর্বোচ্চ স্তরে বসে পুরুষের পাশাপাশি আদর্শ রাষ্ট্র এবং জনজীবন পরিচালনা করতে। তাই বলে, সব নারীরা “অভিভাবক” হতে পারবেন না, শুধুমাত্র জ্ঞানী এবং মেধাবীরাই এই ভূমিকার যোগ্য হবেন। নারীকে তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের এই উচ্চ মর্যাদা দেওয়ায় আপাতদৃষ্টিতে প্লেটোকে নারীবাদী বলেই মনে হচ্ছে, তাই না? ভুল।


আসলে নারীর মর্যাদা নিয়ে প্লেটোর চিন্তা-ভাবনা ছিল স্ববিরোধী। রিপাবলিকের অন্য এক সংলাপে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, “কেউ কি প্রমান করতে পারবে যে, এমন কোনো কাজ আছে যা পুরুষরা নারীর চেয়ে উত্তম নয়”? তাঁর ধারণা, যে কোনো পেশায় নারীরা পুরুষের চেয়ে অনেক দুর্বল এবং কম যোগ্য। স্বাভাবিকভাবেই যে কেউ প্রশ্ন রাখতে পারে, প্লেটোর নারী-অধিকার নিয়ে এমন দ্বিধাগ্রস্ত দ্বৈত মতের কারণ আসলে কি?


এথেন্সের তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা গভীরভাবে পর্যালোচনা করলেই এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। প্লেটো তখনকার পারিপার্শিক অর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে মনে করেছিলেন যে, নারীরা পুরুষের সমকক্ষ নয়, কারণ উচ্চতর পেশায়, যেমন চিকিৎসক বা ভাস্কর্য পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত নগন্য। কিন্তু উচ্চতর পেশায় প্রশিক্ষনে নারীকে যে পুরুষের মতো সমান সুযোগ দেওয়া হয়নি, তা মোটেও বিবেচনায় আনেন নি তিনি। প্লেটোর সময়ে, নারীরা মূলত সন্তান প্রতিপালন, খাবার এবং পোশাক তৈরিতেই বেশী ব্যস্ত থাকতো, চিকিৎসক অথবা দার্শনিক হবার সময় ও সুযোগ তেমন একটা তাদের ছিল না।

প্লেটোর নারী-অধিকার নিয়ে এমন স্ববিরোধী চিন্তা-ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে নারীর উচ্চ আসন আজও আধুনিক বিশ্বে নারীদের সম-অধিকারের প্রেরণা যোগায়। কে জানে, একদিন হয়তো প্লেটোর “আদর্শ রাষ্ট্র” নারী-পুরুষের সমান অধিকার এনে দিবে। আশা তো সবাই করতেই পারে, নয় কি?

তথ্য সূত্র:
* J. Cropsey co-edited, “History of Political Philosophy,” University of Chicago Press, 1987.
* D. Rutledge, “Did Plato have a woman problem?” ABC Radio National (Australia), March 1, 2020.