মিশরীয় চিত্রকলার ইতিহাসে ফাইয়ুম মমি চিত্রকলা হল এক বিশেষ প্যানেল পেইন্টিং যেগুলো হেলেনিস্টিক গ্রিক যুগ (৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মৃত্যুর পর ও রোমান সাম্রাজ্যের পত্তনের আগ পর্যন্ত সময় হেলেনিস্টিক গ্রিক) এবং রোমান শাসিত মিশরের বিভিন্ন জায়গা থেকে খনন করে বের করা হয়েছিল। এক্টিয়ামের যুদ্ধের পর খ্রিস্টপূর্ব ৩১ সালে মিশর রোমানদের অধীনে চলে যায়৷ আর রোমানদের আগমনের পর মিশরীয় মমিকরণ শিল্প অন্য এক শিল্পের সাথে পরিচিত হয়। ফাইয়ুম মমি চিত্রকলা এমন একটি প্রাকৃতিক শিল্প মাধ্যম যা মূলত মিশরের ফারাও ও অভিজাত শ্রেণীকে মমির উপর চিত্রায়িত করে আঁকা হয়েছিল। দুইশো বছর ব্যাপী ব্যাপকভাবে ফাইয়ূম অববাহিকা অঞ্চল জুড়ে এই মমি চিত্রকলা আঁকা হয়। ফাইয়ূম ছাড়াও অন্যান্য অঞ্চলে এই ধারার চিত্রও ফাইয়ূম চিত্রকলা হিসেবে বিকশিত হতে শুরু করে। মিশরে এর আগে মমির ঢাকনার উপর ছবি আঁকা হতো। কিন্তু সেই ছবিগুলো অতোটা বাস্তবসম্মত ও শিল্পগুণ সমৃদ্ধ ছিল না। রোমান যুগে কাঠের উপর ডিম বা মোম রঙের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে এই ছবিগুলো আঁকা হতো। রঙ নেওয়া হতো বিভিন্ন খনিজ উপাদান থেকে। ক্লাসিকাল পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ এই ফাইয়ূম মমি পেইন্টিং ছিল মিশরীয় চিত্রকলার মধ্যে একমাত্র টিকে থাকা শিল্প মাধ্যম। মোট ৯০০ টি মমি চিত্রকলা মিশরের বিভিন্ন জায়গা থেকে আবিষ্কার করা হয়েছে। যার বেশিরভাগ আবিষ্কৃত হয়েছে ফাইয়ূমের নেক্রোপলিস (সমাধি শহর) থেকে। মিশরের উষ্ণ আবহাওয়া এই পেইন্টিংগুলোকে অক্ষত রাখতে সহায়তা করেছে।
ইতালিয়ান পর্যটক পিয়েত্রো দেল্লা ভাল্লে ১৬১৫ সালে সাক্কারা মেম্ফিস শহর পরিদর্শনকালে মমি চিত্রকলা আবিষ্কার ও এর ব্যাখ্যা দান করেন। তিনি এই মমি চিত্রকলাগুলো ইউরোপে নিয়ে যান। ১৮৮৭ সালে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ ফ্লিন্ডার্স পেত্রি হাওয়ারা শহরজুড়ে খননকার্য চালিয়ে ১৫০ টি ফাইয়ূম পোর্ট্রেট আবিষ্কার করেন। এই পেইন্টিংগুলো ছিল যথেষ্ট টেকসই। যা পরবর্তীতে এই চিত্র ধরণ নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা করতে সহায়তা করে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে মিশর রোমান প্রভাবে পড়ে গেলে চিত্রকলায় এক ধরনের পরিবর্তন সূচিত হয়। রোমানদের প্রাকৃতিক অবয়ব পেইন্টিং এর সাথে মিশরীয়দের প্রাচীন মমিকরণ এক নতুন চিত্রধারার বিকাশ ঘটায়। পোর্ট্রেটগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ ছিল শিশুদের চিত্র।এছাড়া অন্যান্য যেসব মানুষের চিত্র আঁকা হয়েছিল যদিও তারা অভিজাত শ্রেণীর ছিল কিন্তু তাদের প্রকৃত পেশাগত ও সামাজিক পরিচয় উদ্ধার করা যায়নি। তবে মমি পোর্ট্রেট সবার সামর্থ্যের মধ্যে ছিল না। উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা, ধর্মীয় নেতারা ফাইয়ূম মমি পোর্ট্রেটের প্রোটাগনিস্ট ছিল। শুধুমাত্র একটি পোর্ট্রেটকে সফলভাবে শনাক্ত করা গেছে- এই পোর্ট্রেটটি ছিল একজন জাহাজ মালিকের চিত্র।
তুলনামুলক কম বয়সী তরুণ ও শিশুদের পোর্ট্রেটের পেছনের কারণ হিসেবে মনে করা হয় তৎকালীন মিশরে মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ূ কম ছিল। সে আমলের অভিজাত মিশরীয়রা নিজেদের জীবদ্দশায়ই মোমের পোর্ট্রেট অংকন করে নিজেদের বাড়িতে ঝুলিয়ে রাখত। পরবর্তীতে সেই ব্যক্তি মারা গেলে তার মমির সাথে পোর্ট্রেটকে সেঁটে দেয়া হতো। এটা মনে রাখতে হবে যে, মমিকরণ শুধু মিশরের ফারাওরাই করতেন না। দেশের উচ্চবিত্তরাও এই মমিকরণ প্রথা চর্চা করত। মমিকরণ খুব ব্যয়বহুল ছিল বলে সাধারণ শ্রেণীর মানুষের পক্ষে এই বিলাসিতা করার সুযোগ ছিল না। যাহোক, মৃত্যুর আগে ঘরে পোর্ট্রেট ঝুলিয়ে রাখা ও পরে মমির সাথে জুড়ে দেয়ার রীতিটি ছিল মিশরের গ্রিক রীতি। কিন্তু ফাইয়ূম চিত্রে সরাসরি মমির কফিনের উপর চিত্র অংকন রোমান ইতিহাসের রেকর্ড থেকে জানা যায়। ফাইয়ূম অববাহিকার ৩০ শতাংশের মত ছিল গ্রিক উপনিবেশিক জনসংখ্যা। আর বাকিরা ছিল মিশরীয়রা। রোমান পিরিয়ডে রোমান সৈন্যরা স্থানীয়দের বিয়ে করে একটি মিশ্র সংস্কৃতির উত্থান ঘটায় মিশরে। এভাবে গ্রিক-রোমান-মিশরীয় মিলে ফাইয়ূমে নতুন এক যুগের উন্মেষ ঘটায়। ফাইয়ূম পোর্ট্রেট শিল্পে তাই এই মিশ্র প্রজাতির মানুষের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। তবে এই মিশ্র প্রজাতি আসলে নেটিভ মিশরীয়রাই ছিল যারা গ্রিকো-রোমান সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে পড়েছিল।
ফাইয়ূম মমি পোর্ট্রেটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল পোর্ট্রেট গুলোকে দেখলে মনে হত একেবারে জীবন্ত কোন চরিত্র বুঝি চোখের সামনে ধরা দিয়েছে। চুলের স্টাইল ও পোশাক আশাক ছিল রোমান স্টাইলের। মেয়েরা বেশ ভারী অলংকার সমৃদ্ধ ছিল। পুরুষদের শরীরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পোশাক পরিধান করতে দেখা যেত। এই মমি পোর্ট্রেট আসলেই কি ব্যক্তির জীবনের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা হতো না শুধুমাত্র চিত্রের মডেলিং এর খাতিরে তাকে প্রকটভাবে শৈল্পিক একটা আবহ তৈরি করার চেষ্টা করা হতো সে সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বুঝা যায়নি। এই মমি পোর্ট্রেটের মাধ্যমগুলো অনেকটা ইতালির পম্পেই শহরের দেয়ালচিত্রের মত আঁকা হয়েছে। যেসব কাঠে পোর্ট্রেট গুলো আঁকা হয়েছে তার বেশিরভাগই আনা হয়েছে ভিন্ন কোন দেশ থেকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিটি স্ক্যান থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে জামির লেবু জাতীয় গাছের কাঠ ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া ব্যবহার করা হয়েছে ওক বৃক্ষের কাঠও যা ইউরোপে দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া লেবানন থেকে সিডার গাছের কাঠও ব্যবহার করা হয়েছিল ফাইয়ূম পোর্ট্রেট অংকনে।
একটা লম্বা সময় ধরে মনে করা হতো সর্বশেষ মমি পোর্ট্রেট আঁকা হয়েছিল চতুর্থ শতাব্দীর শেষ নাগাদ। কিন্তু আধুনিক গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে সর্বশেষ মমি পোর্ট্রেট টি আঁকা হয়েছিল তৃতীয় শতাব্দীর শেষ ভাগে। মমি পোর্ট্রেটের পতনের পেছনে বেশকিছু কারণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। এর মধ্যে প্রধান কারণটি ছিল অর্থনৈতিক। তৃতীয় শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্য বড় এক অর্থনৈতিক স্থবিরতার সম্মুখীন হয়। ফলে অভিজাতদের আর্থিক অবস্থার পতন ঘটে। এছাড়া তারা খেলাধুলা, আনন্দ অনুষ্ঠান ইত্যাদি কাজে দেদারসে অর্থ ব্যয় করতে থাকে। ফলে মমি পোর্ট্রেট আঁকার পেছনে অঢেল অর্থ ব্যয়কে তারা প্রয়োজন মনে করেনি। আবার একসময় মনে করা হতো মিশরের রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্মের প্রভাবে এই মমিকরণ ও মমির পোর্ট্রেট ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারায়। যদিও খ্রিস্টধর্ম মমিকরণ কখনো নিষিদ্ধ করেনি। উপরন্তু রোমানরা মিশরীয় প্রাচীন মন্দিরগুলোর প্রতি এক ধরনের অবহেলা প্রকাশ করে৷ ফলে জনসাধারণের মাঝে প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস ও চর্চার প্রতি অনীহা তৈরি হতে থাকে। ফলে মৃতপ্রায় এই চর্চা চূড়ান্তভাবে পতন ঘটে।