তৃতীয় মোঘল সম্রাট আকবরের রাজসভায় ছিলেন নয় অসামান্য জ্ঞানী মনিষী, স্ব-স্ব ক্ষেত্রে এরা ছিলেন শ্রেষ্ঠ ও অতুলনীয়। সম্রাট আকবরের নবরত্ন: তৃতীয় মোঘল সম্রাট আকবর ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আর তারই সভায় তিনি ছাড়াও আরো নয়জন নক্ষত্র ছিলেন, যাদের একত্রে নবরত্ন বলা হতো। নিজেদের কর্মক্ষেত্রে তারা প্রত্যেকেই ছিলেন শ্রেষ্ঠ ও অতুলনীয়। তাদের তুলনা আর কেউ ছিলনা। আজ আমরা এই নবরত্নদের সম্পর্কে জানবো—-

আবুল-ফজল আকবরকে আকবরনামা উপহার দিচ্ছেন, মুঘল মিনিয়েচার Image source: Wikipedia

প্রধানমন্ত্রী আবুল ফজল: আবুল ফজল শুধুমাত্র একজন লেখক ছিলেন না, সম্রাট আকবরের ভালো বন্ধুও ছিলেন। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে মোঘল আমলের ইতিহাস লিখে গেছেন। সম্রাট আকবরের জীবনী নিয়ে লেখা “আকবরনামা” তারই সৃষ্টি। এই বইয়ে তিনি তৈমুর বংশের ইতিহাস থেকে শুরু করে বাবর, হুমায়ুন ও আকবরের রাজত্বকাল পর্যন্ত সমস্ত তথ্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তাছাড়াও আকবরের রাজত্বকালে রাজ্য পরিচালনার জন্য যেসকল রীতিনীতি, নিয়মকানুন প্রচলন করা হয়েছিল তা নিয়ে তিনি “আইন – ই – আকবরি” নাম একটি বইও লিখে গেছেন। তার লেখা বইয়ে বাংলা ও বারো ভূঁইয়াদের চমৎকার বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও তিনি কোনোদিন বাংলা দেখেননি। ১৬০২ সালের পর তার এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার কাজটি আর চালিয়ে যেতে পারেননি। কারণ, সেইসময় শাহজাদা সেলিমের ষড়যন্ত্রে বীর সিং বুন্দেলা তাকে হত্যা করে।

                                   বীরবল Image source: Wikipedia

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বীরবল:- মোঘল সম্রাট আকবরের দরবারে অন্যতম একজন ছিলেন বীরবল। তার প্রকৃত নাম ছিল মহেশ দাস । আকবর ও বীরবলকে নিয়ে যে গল্পগুলো প্রচলিত আছে তাতে বীরবলের তুখোড় বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। আকবরের দরবারে তিনি ছিলেন একজন কবি ও গায়ক। তিনি ব্রজবুলি ভাষায় গান ও কবিতায় পারদর্শী ছিলেন। অসাধারণ বুদ্ধিপ্রতিভার কারণে আকবরের দরবারের একজন হতে তার বেশি সময় লাগে নি। যেকোনো সমস্যায় সম্রাট আকবর বীরবলের সাহায্য নিতেন। তাদের মধ্যে খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিল। উপদেষ্টার কাজ করার পাশাপাশি বীরবল এক সময় রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা ও সেনাবাহিনীর কাজেও যুক্ত হয়েছিলেন। বীরবল আফগান উপজাতিদের সাথে ভারতের স্বাত ঘাঁটিতে হওয়া এক যুদ্ধের সময় বীরবল মারা যান।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী আব্দুর রহিম খান:– সম্রাট হুমায়ূনের মৃত্যুর পর আকবরের একজন অভিভাবক ছিলেন বৈরাম খান। তারই সুযোগ্য সন্তান ছিলেন আব্দুল রহিম খান। তিনি মির্জা খান নামেও পরিচিত ছিলেন। আকবরের দরবারে কবি, গায়ক, গীতিকার এবং জ্যোতিষশাস্ত্রী হিসেবে তার অনেক খ্যাতি ছিল। তার কবিতা ও গান দরবারের সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতেন। জ্যোতিষ শাস্ত্রে তার দক্ষতার কারণে মন্ত্রিসভার সকলের কাছে খুব প্রিয় ছিলেন তিনি।

শিক্ষামন্ত্রী ফইজি: একজন সফল অনুবাদক হিসেবে যার নাম প্রথমে আসে তিনি আর কেউ নন, আবুল ফজলের বড় ভাই, আকবরের দরবারের আরেক রত্ন- ফইজি। পঞ্চতন্ত্র, রামায়ণ, মহাভারতের মতো গ্রন্থগুলো তিনিই ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। ফার্সি ভাষায় তার অসাধারণ দক্ষতার কারণে আকবর তাকে সম্মান করতেন এবং নিজের ছেলেদের শিক্ষক হিসেবে তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা ফকির আজিওদ্দিন: সম্রাট আকবরের পরামর্শদাতাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন ফকির আজিওদ্দিন। তিনি ছিলেন একজন সূফী সাধক এবং ধর্মীয় বিষয়ে ছিল তার অগাধ জ্ঞান। ধর্মীয় বিষয়গুলোতে তিনি আকবরকে নানা উপদেশ দিতেন। আর তাই আকবরের সভায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন মুখ্য উপদেষ্টা। আকবরও তার উপদেশগুলো শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করতেন।

গৃহমন্ত্রী মোল্লা দো পিয়াজা: মোল্লা দো পিয়াজা আসলে কোনো নাম নয়, এটি একটি উপাধি। এই মানুষটিই জনপ্রিয় মোঘল খাবার “দো – পিঁয়াজা”- র উদ্ভাবক। কিন্তু শুধু সুস্বাদু খাবার উদ্ভাবনের জন্য কিন্তু আকবরের নবরত্নে তার জায়গা হয়নি। বলা হতো, বীরবলের মতো দো পিয়াজাও অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষন ছিলেন। লোকগাথা ও লোকসংঙ্গীতে তার দক্ষতা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার ছিল।

অর্থমন্ত্রী টোডরমল: পুরো পৃথিবীতে যিনি সেরা গণিতবিদ হিসেবে বিখ্যাত তিনি আর কেউ নন, আকবরের সভার আরেকজন নবরত্ন- টোডরমল। তিনি প্রথমে শের শাহের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। শের শাহের মৃত্যুর পর আকবর তার প্রতিভা, যোগ্যতা ও নিষ্ঠা দেখে নিজের অর্থমন্ত্রী পদে তাকে নিয়োগ দেন। এখনো ভারতের অনেক প্রদেশে টোডরমলের নিয়মে আয় দেখে কর আদায় করা হয়। তিনি ফার্সি ভাষায় “ভাগবত পুরাণ” অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু টোডরমল মূলত ১৫৮৫ সালে বিশ্বনাথ মন্দির পুনরায় নির্মাণের মধ্য দিয়ে এখনো স্মরণীয় হয়ে আছেন।

                                                    সেনাপতি মানসিংহ

সেনাপতি মানসিংহ: অম্বরের রাজা ছিলেন মানসিংহ। তিনি মির্জা রাজা নামেও পরিচিত ছিলেন। সম্রাট আকবরের বিশ্বস্ত বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিলেন মানসিংহ। অনেক যুদ্ধে আকবর মানসিংহের সাহায্য পেয়েছিলেন। মানসিংহও আকবরের বিপদে সবসময় ঝাঁপিয়ে পড়েছে সাহায্য করার জন্যে। তার মধ্যে একটি ছিল ১৫৯৬ সালে বারো ভূঁইয়া ঈশা খাঁর সাথে মানসিংহের যুদ্ধ, যা ইতিহাসের পাতায় আজও অম্লান। মানসিংহের এইসব ভালো গুণাবলীর জন্য সম্রাট আকবর তাকে ভালোবেসে “ফরজন্দ’ বা ‘পুত্র’ উপাধি দিয়েছিলেন।

সংস্কৃতি মন্ত্রী তানসেন– আকবরের সভার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন তানসেন। তানসেনকে ভারতের সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ সংগীতশিল্পী বলা হয়ে থাকে। সুর আর রাগ নিয়ে তিনি রচনা করেছেন অপূর্ব সব সংগীত। তানসেনের গান শুনে মুগ্ধ হননি এমন ব্যাক্তি পাওয়া কঠিন। তার পূর্ব নাম নিয়ে নানা মতভেদ আছে। কেউ বলেন রামতনু মিশ্র, কেউ বা বলেন রাম পান্ডে। যে যাই বলুক সেনাপতি মানসিংহের দেয়া তানসেন নামেই তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। হিন্দু পরিবারে জন্ম হলেও পরবর্তীতে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং আমৃত্যু এই ধর্মই পালন করেছিলেন।

আজকে আমরা আপনাদের কাছে সম্রাট আকবরের নবরত্নদের পরিচিত করলাম। তবে বাস্তবে আকবরের নবরত্নদের অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে। আমরা পরবর্তীতে এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

                                                    সম্রাট আকবরের নবরত্ন